somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

♠ চর্যাপদ- বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ♠

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চর্যাপদ বা চর্যাগীতি নব্য ভারতীয় আর্যভাষার পূর্বাঞ্চলীয় উপশাখার (পূর্বাঞ্চলীয় আর্য ভাষা ) অন্তর্গত, বাংলা-অহমিয়া ভাষা গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ভাষা হিসেব বিবেচিত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন।

১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধপুথির একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকাটির নাম ছিল- Sanskrit Buddhist Literature in Nepal। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (২৬.৭.১৮৯১) মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যা অঞ্চলের পুথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)’র উপর। এই সূত্রে তিনি ১৯০৭ সালে নেপালে যান (তৃতীয় অনুসন্ধান-ভ্রমণ)। এই ভ্রমণের সময় তিনি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে কিছু নতুন পুথির সন্ধান পান। এই পুথিগুলোসহ হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামেএকটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ)। এই সংকলনের একটি গ্রন্থ ছিল চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়




গ্রন্থনাম
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপালে প্রাপ্ত তালপাতার পুথি সম্পর্কে একটি তালিকা প্রকাশ করেন। এই তালিকার নাম ছিলো- A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS belonging to the Durbar Library, Nepal। এর দ্বিতীয় খণ্ডের তালিকায় এই পুথির নাম হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন -চর্য্যাচর্য্যটীকা। এই নামটি পুথির মলাটে লিখা ছিল। কিন্তু ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামক গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন- চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়। কেন তিনি গ্রন্থটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেন নি।
এই পুথির বন্দনা শ্লোকে আছে- 'শ্রীলূয়ীচরণাদিতিসিদ্ধরচিতেহপ্যাশ্চর্য্যাচেয়সদ্বার্ত্মাবগমায়নির্মলগিরাং......। এই শ্লোকে উল্লিখিত 'আশ্চার্য্যচর্য্যাচয়' শব্দটিকে এই গ্রন্থের নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। প্রবোধকুমার বাগচী এবং সুকুমার সেন এর যথার্থ নাম হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন- চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চিয়। এই গ্রন্থের মনুদত্তের তিব্বতী অনুবাদ অনুসরণে এই পুথির নাম চর্যাগীতিকোষবৃত্তি নামকরণের প্রস্তাব করেছেন। নামকরণের এই বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে এই পুথি চর্যাপদ বা চর্যাগীতি নামেই পরিচিত।

রচনাকাল
বিভিন্ন গবেষকগণ এই পুথির পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু মত দেওয়া হলো। যেমন‒

সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ঃ খ্রিষ্টীয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত "চর্য্যাপদ" নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই।
[ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। রূপা।বৈশাখ ১৩৯৬]

সুকুমার সেনঃ বাঙ্গালা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য-চতুর্দশ শতাব্দ (৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা' নামক বইটির প্রথম গ্রন্থ "চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়" অংশে সঙ্কলিত চর্যাগীতিগুলি আদি স্তরের অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালার নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইলেও এগুলির ভাষা খাঁটি আদি স্তরের বাঙ্গালা নহে। [ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪]

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহঃ আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়। [বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮]

চর্যাগীতির ভাষা
চর্যাপদের সংগ্রহ প্রকাশিত হওয়ার পর এর ভাষা নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ভাষাবাষীরা তাদের নিজ ভাষার প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে দাবি করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যাগীতিকে বাংলার প্রাচীন নমুনা হিসেবে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে‒ তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে, এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন নি।



সন্ধ্যাভাষা
চর্যাপদগুলোর ভিতরে রয়েছে নানা ধরনের দুর্বোধ্য ভাব। এর আক্ষরিক অর্থের সাথে ভাবগত অর্থের ব্যাপক ব্যবধান আছে। ফলে এই পদগুলোতে বুঝা-না-বুঝার দ্বন্দ্ব রয়ে যায়। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা। তাঁর মতে-

'সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।'

বজ্রযানী ও সহজযানী গ্রন্থকাররাও একে 'সন্ধ্যাভাষয়া বোদ্ধব্যম্' বলে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। বজ্রযানী গ্রন্থগুলিতে 'সন্ধ্যাভাষা' শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। তিব্বতি ভাষায় 'সন্ধ্যাভাষা'র অর্থ 'প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা'। ম্যাক্সমুলার 'সন্ধ্যা 'র অর্থ করেছিলেন 'প্রচ্ছন্ন উক্তি' (hidden saying)।


চর্যাপদের কবিতা
চর্যাপদ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লিখিত হয় নি। মূলত বৌদ্ধ সহজযানপন্থী সহজিয়াগণ তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য গান হিশেবে এই পদগুলি রচনা করেছিল। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, যোগ ও নাথধর্মের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় চর্যাপদ সৃষ্টির পিছনে। প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্পের ব্যবহারে বৌদ্ধ সহজযান ধর্ম, সাধনপ্রণালী, দর্শনতত্ত্ব ও নির্বাণলাভ সম্পর্কে পদ রচনা করেছেন কবিগণ। এছাড়া বাংলা, মিথিলা, উড়িষ্যা, কামরূপের সাধারণ জনগণের প্রতিদিনের ধূলি-মলিন জীবনচিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ইত্যাদি বাঙালি আবেগ বিভিন্ন কল্পনাময় রেখাচিত্রের মাধ্যমে কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

চর্যাপদের কবিগণের নাম উল্লেখ পূর্বক চর্যায় কবিতা কয়টি ছিল তা নিয়ে মতভেদটি বর্ণনা করা যেতে পারে। চর্যাপদের মোট গানের সংখ্যা সুকুমার সেনের মতে ৫১ টি। সুকুমার সেন তাঁর ‘চর্যাগীতি পদাবলী (১৯৫৬)’ গ্রন্থে প্রথমত ৫০ টি কবিতার কথা উল্লেখ করলেও সংযোজন করেছেন যে- “মুনি দত্ত পঞ্চাশটি চর্যার ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। টীকাকারের কাছে মূল চর্যার পুঁথিতে আরো অন্তত একটি বেশি চর্যা ছিল (একাদশ ও দ্বাদশ চর্যার মাধ্যখানে)। এই চর্যাটির ব্যাখ্যা না থাকায় লিপিকর উদ্ধৃত করেন নাই, শুধু ‘টিকা নাই’ এই মন্তব্যটুকু করিয়াছেন।” উল্লেখ্য যে, মুনিদত্ত ছিলেন সংস্কৃত টীকাকার। বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন বলে চর্যাপদের ব্যাখ্যা হিশেবে ওই সংস্কৃত টীকার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা একান্ত আবশ্যক। সত্য বলতে, মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা এবং ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক আবিষ্কৃত চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদের কারণেই আমরা চর্যার আক্ষরিক অর্থ ও গূঢ়ার্থ অনেকটা সহজে ব্যাখ্যা করতে পারি। অন্যদিকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, চর্যায় গানের সংখ্যা ৫০ টি। আসলে চর্যাপদ ছিন্নাবস্থায় পাওয়া যায় বলে এই মতান্তরের সৃষ্টি হয়েছে।




কবির সংখ্যা
চর্যাপদে কবি সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তাঁর ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে ২৩ জন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড)’ গ্রন্থে ২৪ জন কবির কথা উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন নেপাল-তিব্বতে প্রাপ্ত তালপাতার পুঁথিতে আরো করেকজন নতুন কবির চর্যাগীতি পেয়ে ‘দোহা-কোষ (১৯৫৭)’ গ্রন্থে সংযোজন করেছেন। ফলে এককথায় বলা যায়, চর্যাপদের মোট কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪ জন।

চর্যাপদ কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও পদ
চর্যাপদ কবিদের জীবনী যা জানা যায়, তা শুধুমাত্র তিব্বতী বিভিন্ন গ্রন্থাবলী থেকে। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষা বিজ্ঞানী ও ইতিহাস গবেষকরা তিব্বতী বইগুলোর জার্মান অনুবাদ থেকে চর্যাপদ গীতিকারদের জীবনী খুঁজে পেয়েছেন। যেসব তিব্বতী বইগুলোতে তাঁদের জীবনী রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- Geschichte des Buddhismus in Indien, Edelsteinmine, Die Geschichten des Vierundachtzig Zauberer (Mahasiddhas), Buddhist Philosophy in India and Ceylon, History of Buddhism in India and Tibet, Catalogue du Fonds Tibetain ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত, দু’ভাবেই বৌদ্ধ সহজিয়াদের জীবন কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
চর্যাপদ কবিদেরকে দু’ভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়। প্রথমত, গুরু পরম্পরার ভিত্তিতে; দ্বিতীয়ত, চর্যাপদ গীতিকায় তাদের পদের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে। প্রথমভাগের ব্যাখ্যা জটিলতর। কেননা বিভিন্ন ভাষা-ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে এই গুরু পরম্পরা নিয়ে। ফলে নিম্নে চর্যাপদ গীতিকায় কবিদের লিখিত পদের অবস্থান অনুযায়ী ক্রমানুসারে চিহ্নিত করা হল-

১। লুইপা > পদ নং-১/২৯
লুইপা বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, এই মত প্রকাশ করেছেন অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তাই তিনি প্রথম কবি হতে পারেন না। তাঁর মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীঃ মধ্যে জীবিত ছিলেন। লুইপা বাংলাদেশের লোক ছিলেন। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ‘ব্‌স্তন্‌-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়’ নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে। আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক। এবং শ্রীযুক্ত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর একটি হিন্দী অভিভাষণে বলেছেন – “লূয়িপা মহারাজ ধর্মাপালকে কায়েস্থ বা লেখক থে।” লুইপা রচিত পদ দুটি- ১ ও ২৯ নং। তার রচিত সংস্কৃতগ্রস্থগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়- অভিসময় বিভঙ্গ, বজ্রস্তত্ত্ব সাধন, বুদ্ধোদয়, ভগবদাভসার, তত্ত্ব সভাব। লুইপার প্রথম পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-

“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”


আধুনিক বাংলায়ঃ
“দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।”

২। কুক্কুরীপা > পদ নং- ২/২০/৪৮
চর্যাপদের দ্বিতীয় পদটি কুক্কুরীপা রচিত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য অনেকে মনে করেন তিনি তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। নিশ্চিতভাবে বললে কপিলসক্র। মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন, কুক্কুরীপা বাঙ্গালা দেশের লোক। তার জন্মকাল নিয়ে দ্বিধামত নেই। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কুক্কুরীপার নাম নিয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপার ভাষার সাথে নারীদের ভাষাগত মিল আছে। তাই তিনি নারীও হতে পারেন। আবার তার সহচারী যোগিনী পূর্বজন্মে লুম্বিনী বলে কুক্কুরী ছিলেন বলে, তার এই নাম হয়েছে; এমতও পোষণ করেন অনেক ঐতিহাসিক। চর্যাপদে কুক্কুরীপার তিনটি বৌদ্ধগান ছিল। কিন্তু একটি অপ্রাপ্ত। ২ ও ২০ নং তার লিখিত পদ। এবং চর্যাপদে খুঁজে না পাওয়া ৪৮ নং পদটিও তার রচিত বলে ধরা হয়। কুক্কুরীপার পদযুগল ছিল গ্রাম্য ও ইতর ভাষার। কুক্কুরীপার দ্বিতীয় পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-

“দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই ।।”

আধুনিক বাংলায়ঃ
“দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায় ।”

৩। বিরুপা > পদ নং- ৩
বিরুপা বা সংস্কৃতে বিরুপ পাদ রচনা করেছিলেন চর্যাপদের তৃতীয় পদটি। বিরুপার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ নেই। তিনি রাজা দেবপালের রাজ্য ত্রিপুরায় জন্মেছিলেন। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে করা হয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কিন্তু মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌র মতে বিরুপা নামে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন। একজন জয়দেব পণ্ডিতের শিষ্য, যিনি সপ্তম শতাব্দীর লোক। আর অন্য জন জালন্ধরীপার শিষ্য। ইনি বাংলার লোক। কিন্তু চর্যাপদের বিরুপার প্রকৃত গুরু ছিলেন জলন্ধরীপাদ। ফলে এখানে হেঁয়ালি রয়েছে। বিরুপা অন্যান্য কবিগণের তুলনায় সামান্য পৃথক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলন বলে জানা যায়। যেমন- তিনি মদ্যমাংসভোজনের অপরাধে বিহার থেকে বিতাড়িত হয়ে এক আশ্চর্য ক্ষমতা বলে গঙ্গা পার হয়ে উড়িষ্যার কনসতি নগরে আসেন। এবং এখানেও নানা বুজরুকি দেখান। বিরুপার ৩য় পদটি ছিল ‘শুঁড়িবাড়ি’ নিয়ে লিখিত। পদটির দুটি চরণ-

“এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ।।”


আধুনিক বাংলায়ঃ
“এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায় / চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।”

৪। গুণ্ডরীপা > পদ নং- ৪
গুণ্ডরীপা চর্যাপদের চতুর্থ পদটি রচনা করেন। তার নাম নিয়ে মতভেদ আছে। কার্দিয়ার ক্যাটালগে তার এই নাম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন গুণ্ডরীপা তার বৃতি বা জাতিবাচক নাম। যেমন- এ যুগের কর্মকার বা সরকার। প্রথমত তিনি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের কবি বলে জ্ঞাত হলেও, অনেকে মনে করেন তিনি বিহারের লোক। রাজা দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৯-৮৪১) সময়ের মধ্যে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তার চার নং পদের দু’টি চরণ-

“জোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমল রস পিব্‌মি ।।” (পদ ৪)


আধুনিক বাংলায়ঃ
“রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না / তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি।”

৫। চাটিল্লপা > পদ নং- ৫
চাটিল্লপা সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, পাঁচ নং পদটি তার শিষ্যের রচিত। জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের বর্ণ-রত্নাকরে চাটিল্লের নাম লিপিকর প্রমাদে চাটল রয়েছে। তিনি ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছে দক্ষিণবঙ্গের অধিবাসী হিশেবে জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার পদে নদীমাতৃক অঞ্চলের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ নদী, সাঁকো, কাদা, জলের বেগ, গাছ, খনন করা ইত্যাদি। সহজ সাধনভজন তত্ত্বকথা এসবের আলোকেই ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য দুটি চরণ-

“ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী।।” (পদ ৫)


আধুনিক বাংলায়ঃ
"ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান। তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল।"

৬। ভুসুকুপা > পদ নং- ৬/২১/২৩/২৭/৩০/৪১/৪৩/৪৯
পঞ্চাশটি চর্যা-পদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক রচনা করেন কাহ্নপা। এবং তার পরেই ভুসুকুপার স্থান। তিনি মোট আটটি পদ রচনা করেন। তার নাম নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। মনে করা হয়, তার আসল নাম শান্তিদেব। সুম্‌পা ম্‌খন্‌-পো (১৭৪৭ খ্রীঃ অঃ) তার দ্‌পদ্‌-ব্‌-সম-লজোন্‌-বজন্‌ বইয়ে ভুসুকু সম্পর্কে বলেছেন- “ভুসুকু অষ্টম থেকে এগার শতকের মধ্যে সৌরাষ্ট্রের রাজা কল্যাণবর্মার পুত্র ছিলেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম শান্তিবর্মা ছিল।” এজন্য তাকে শান্তিদেব নামেও ডাকা হয়। বৌদ্ধাচার্য জয়দেব ভুসুকুকে শিক্ষাসমুচ্চয়, সূত্রসমুচ্চয় ও বোধিচর্যাবতার নামক তিনটি বই দেন। ভুসুকু নিজের আবাসে একমনে লেখাপড়া করতেন বলে অন্য ভিক্ষুরা তাকে অলস মনে করত। এজন্য তারা তাকে উপহাস কোরে ভুসুকু নামে ডাকত। যেখানে, ভু অর্থ ভুক্তি (ভোজন), সু অর্থ সুপ্ত (শয়ন/নিদ্রা), কু অর্থ কুটির ! ভুসুকুপা বাঙালি ছিলেন। অনুমান করা হয় তিনি পূর্ব বাংলা কবি। তার পদে বাংলার বিভিন্ন চিত্র উজ্জ্বলভাবে ফুঁটে উঠেছে। তার ৪৯ চর্যাটির চারখানা চরণ হল-

“বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।” (পদ ৪৯)

আধুনিক বাংলায়ঃ
“ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।

৭। কাহ্ণপা > পদ নং- ৭/৯/১০/১১/১২/১৩/১৮/১৯/২৪ (পাওয়া যায় নি)/৩৬/৪০/৪২/৪৫
কাহ্নপা চর্যাপদকে আলাদা বিশিষ্টতা দান করেছেন। কেননা তিনি সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছেন। তার মোট পদের সংখ্যা ১৩ টি। যদিও ২৪ নং পদটি তার কি-না, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেননা চর্যাপদে ২৪ নং পদটিই খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই মনে করা হয় এটি 'কাহ্ণপা’র রচনা। সর্বাধিক পদ রচনার জন্য তাকে চর্যাপদের সমস্ত কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। কাহ্নপা তার সমকালে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন। চর্যার বিভিন্ন পদে আমরা তার ভিন্ন ভিন্ন নাম খুঁজে পাই। যেমনঃ- কাহ্ন, কাহ্নূ, কাহ্নু, কাহ্ণ, কাহ্ণি, কাহ্ণিলা, কাহ্ণিল্য, কৃষ্ণ, কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণবজ্র ইত্যাদি। কাহ্ণপা মূলত খ্রীঃ অষ্টম শতকের লোক ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, কাহ্ণপা উড়িষ্যার কবি। তিনি থাকতেন সোমপুরী বিহারে। বর্তমানে পাহাড়পুরে যে বিহারটি আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটিই কাহ্ণপার বসতভিটা বলে ধারণা করেন অনেকে। চর্যাগীতিতে যেসকল কবিগণের উল্লেখ আছে, তারা প্রত্যেকেই অন্য কোনো কবির শিষ্য অথবা গুরু। এক্ষেত্রে কাহ্ণপার গুরু ছিলেন জালন্ধরী; যার অন্যনাম হাড়িপা। এবং জালন্ধরীর গুরু ছিলেন ইন্দ্রভূতি। ইন্দ্রভূতির সময়কাল আনুমানিক ৭০০ খ্রীঃ। যেহেতু সোমপুরে কাহ্ণপার একটি লিপি পাওয়া যায়, তাই বলা যায়- গোপীঁচাদের যুগের লেখক। যিনি ৭ম শতকের শেষভাগে ধর্মপাল দেবের রাজত্বকালে সোমপুর বিহারে অবস্থান করেছেন। তাই মোটামুটি সন্দেহাতীতভাবে ৭৬০-৭৭৫ এর মধ্যকার সময়কালে কাহ্ণপা চর্যার পদ রচনা করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। কাহ্ণপা ব্রাহ্মণগোত্রের এবং সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধযোগী। বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র এবং প্রাচীন সঙ্গীতকলায় তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। এজন্য তাকে পণ্ডিত-ভিক্ষু উপাধি দেওয়া হয়। চর্যায় তিনি যেসকল পদ রচনা করেছেন তাতে, তত্কালীন সমাজচিত্র ও প্রেম বিষয়ক বিভিন্ন শৈল্পিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ড.সুকুমার সেন এ ব্যাপারে মন্তব্য করেন- “কাহ্নুর চর্যাগীতির রচনারীতিতে অস্পষ্টতা নাই। কয়েকটি প্রেমলীলা-রূপকমণ্ডিত চর্যাকে সেকালের প্রেমের কবিতার নিদর্শন বলিয়া লইতে পারি।” এছাড়া তার কাব্যে সহজিয়া বৌদ্ধযান সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব এসেছে। সহজ সম্বন্ধে তার একটি উল্লেখযোগ্য পদ-

“ভন কইসেঁ সহজ বোলবা জাই
কাআবাক্‌চিঅ জসু ন সমাই ।।
আলেঁ গুরু উএসই সীস ।।
জেতই বোলী তেতবি টাল ।
গুরু বোব সে সীসা কাল ।।”


আধুনিক বাংলায়ঃ
"বল কেমনে সহজ বলা যায়, যাহাতে কায়বাক্‌চিত প্রবেশ করিতে পারে না ? গুরু শিষ্যকে বৃথা উপদেশ দেন। বাক্‌পথাতীতকে কেমনে বলিবে ? যতই তিনি বলেন সে সবই টালবাহানা। গুরু বোবা, সে শিষ্য কালা।"


৮। কম্বলারম্বপা > পদ নং- ৮
চর্যার আট নং বৌদ্ধগানটি কম্বলারম্বপার রচিত। তিনি ইন্দ্রভূতি ও জালন্ধরীপার গুরু ছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি কানুপার পূর্ববর্তী এবং কুক্কুরীপা ও লুইপার (কারণ তিনি লুইপার একটি গ্রন্থের টীকা লিখে দিয়েছিলেন) সমকালীন কবি ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার সময়কাল আনুমানিক ৭৫০ শতকের দিকে। এবং জীবৎকাল ৮৪০ অবধি। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন, কম্বলারম্বপা কঙ্কারামের বা কঙ্করের রাজপুত্র ছিলেন। এবং দেবপালের রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। অবশ্য অন্য অনেকে মনে করেন- তিনি উড়িষ্যা কিংবা পূর্ব-ভারতবাসী (কার্দিয়ের মতে) ছিলেন। তিনি চর্যায় ভিক্ষু ও সিদ্ধা হিশেবে পরিচিত। প্রচীন বাঙলায় তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেন। লোকজীবনের বিভিন্ন জীবন গাঁথা তার কাব্যের অলঙ্কারে বিশেষ শিল্পসুষমারূপ লাভ করেছে। তার রচিত ৮ নং পদটির সংক্ষিপ্ত অংশ হলো-

“সোনে ভরিতী করুণা নাবী ।
রূপা থোই নাহিক ঠাবী ।।
বাহতু কাম্লি গঅন উবেসেঁ।
গেলী জাম বাহুড়ই কইসেঁ ।।
ঘুণ্টি উপাড়ি মেলিল কাচ্ছি ।
বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি ।।
মাঙ্গত চড়াহিলে চউদিস চাহঅ।
কেড়ুআল নাহি কেঁ কি বাহবকে পারঅ ।।
বাম দাহিণ চাপী মিলি মিলি মাঙ্গা ।
বাচত মিলিল মাহাসুহ সাঙ্গা ।।”


আধুনিক বাংলায়ঃ
“আমার করুণা-নৌকা সোনায় ভর্তি রয়েছে; তাতে রূপা রাখার ঠাঁই নেই। অরে কম্বলি পা, গগনের (নির্বাণের) উদ্দেশ্যে তুমি বেয়ে চলো; যে জন্ম গেছে সে ফিরবে কি কোরে ? (নৌকা বাইতে গিয়ে) খুঁটি উপড়ে ফেলো, কাছি মেলে দাও। সদগুরুকে জিজ্ঞেস করো, হে কম্বলি পা, তুমি বেয়ে যাও। পথে বেরিয়ে চারদিকে চেয়ে এগিয়ো; কেড়ুয়াল ছাড়া কি বাইতে পারে ? বাম- ডানে চেপে পথ বেয়ে গেলে ওই পথেই মহাসুখের সঙ্গে মিলে যাবে”।


৯। ডোম্বীপা > পদ নং- ১৪
ডোম্বীপা চর্যার অষ্টম পদটি রচনা করেছেন। চর্যায় রহস্যময় চরিত্রগুলোর মধ্যে ডোম্বীপা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতা তার ছিল বলে ধারণা করা হয়। লামা তারকানাথের ‘ব্‌ক’- বব্‌স্‌-ব্‌দুন-ল্‌দন্‌’ নামক গ্রন্থে তার জীবনী পাওয়া যায়। জার্মান লেখক Albert Gruenwedel এই গ্রন্থটির অনুবাদ করেন ‘Edelsteinmine’ নামে। ডোম্বীপা ছিলেন হেরুক পূর্ব দিকের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা। তখন তার নাম ডোম্বী ছিল না। আচার্য তান্ত্রিকের কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যখন দেশ ছেড়ে তিনি বনে-জঙ্গলে ঘুরতে শুরু করেন, তখন তার নাম ডোম্বী হয়। তার সঙ্গী ছিল ডুমনি নামক এক ডোম জাতীয়া পদ্মিনী। ডোম্বী রাজার যে অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই উপাখ্যানে- ডোম্বীপা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভ করায় তার প্রজারা তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এতে দেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী শুরু হয়। যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন তখন তা দূর হয়। এতে তান্ত্রিকরা রাজাকে ধর্মবান মনে করেন এবং দেশের প্রজারাও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভে অনুপ্রাণিত হয়। এছাড়া রাঢ়দেশের হিন্দু রাজা বৌদ্ধধর্মের ক্ষতি সাধন করায় ডোম্বী সেখানে উপস্থিত হন এবং অলৌকিক বলে রাজা-প্রজা সকলকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি কর্ণাটকের সমুচ্চয় নামক রাজার তৈরি লিঙ্গাইত মথে ৮০০ টি স্তূপ আধ্যত্মিক শক্তি বলে মাটিতে মিশিয়ে দেন। এসবই আল্‌বার্ট গ্র্যুন্‌ভেডেলের অনুবাদ বইয়ে উল্লেখ আছে। এছাড়া তার অন্য আরেকটি তিব্বতী বই- ‘গ্রুব্‌-থোব্‌-ব্‌-র্গ্যদ্‌-চু-র্চ-ব্‌ জিই-র্ণম-থর’ এর জার্মান অনুবাদ Die Geschichten der Vierundachtzig Zauberes (Mahasiddhas)-এ ডোম্বী সম্পর্কে ভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ হয়েছে, ডোম্বী মগধের রাজা। বিরূপা তার গুরু। অবশ্য তার সঙ্গিনী ডুমনির কথা এখানেও উল্লেখ করা হয়েছে। একটি অলৌকিক ঘটনা হল- প্রজাদের অনুরোধে যখন রাজা বন হতে দেশে ফিরে আসেন তখন তিনি ডুমনিসহ নিজেকে সাত দিন অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে রেখে নতুন দেহ নিয়ে বের হয়ে আসেন। তখন তার নাম হয় আচার্য ডোম্বী। ডোম্বীপা ছিলেন দীর্ঘজীবী পুরুষ। তার সময়কাল মোটামুটি ৭৯০ থেকে ৮৯০ খ্রীষ্ঠব্দের মধ্যে, দেবপালের রাজত্বকালে (৮০৬-৪৯ খ্রীঃ)। চর্যায় ১৪ নং গানটি মূলত ধনসী রাগে রচনা করেছিলেন তিনি। এখানে গঙ্গা ও যমুনা নদীর দৃশ্য, কড়ি ছাড়াই মাঝিদের নৌকা পার করে দেওয়ার কথা রয়েছে। তার ১৪ নং পদটির সংক্ষেপ হলো-

“গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ
তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই ।।
বাহ তু তোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা
সদ্গুরু পাও-পসাএঁ জাইব পুণু জিণউরা ।।
পাঞ্চ কেডুআল পড়ন্তেঁ মাঙ্গে পীঠত কাছী বান্ধী
গতণ দুখোলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি ।।
চান্দ সূজ্জ দুই চাকা সিঠিসংহার পুলিন্দা
বাম দাহিণ দুই মাগ ন চেবই বাহ তু ছন্দা ।।
কাবড়ী ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছলে পার করেই
জো রথে চড়িলা বাহ্বা ণ জানি কুলেঁ কুল বুলই ।।”*

আধুনিক বাংলায়ঃ
"গঙ্গা যমুনা মাঝে রে বয় নৌকা,
তাউ চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অনায়াসে পার করে ।।
বা তুই ডুমনি ! বা লো ডুমনি ! পথে হইল সাঁঝ,
সদ্‌গুণ পায়ের প্রসাদে যাইব পুনরায় জিনপুর ।।
পাঁচ দাঁড় প্রিতে নৌকার গলুইয়ে, পিঠে কাছি বাঁধিয়া
গগন-রূপ সেচনী দিয়ে ছেঁচ, পানি পশে না ছেঁদায় ।।
চাঁদ সূর্য্য দুই চাকা, সৃষ্টি সংহার মাস্তুল,
বাঁ-ডাইন দুই রাস্তা বোধ হয় না, বা তুই স্বচ্ছন্দে ।।
কড়ি লয় না, পয়সা লয় না, মাগনা পার করে,
যে রথে চড়িল (পথ) বাহিতে না জানিয়া কূলে কূলে বেড়ায় ।।"

*ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচীর তিব্বতী তর্জমার আলোকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মূল পদ সংশোধিত অংশ।

১০। শান্তিপা > পদ নং- ১৫/২৬
শান্তিপা চর্যার পনের এবং ছাব্বিশ নং পদ রচনা করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল রত্নাকর শান্তি। খ্রিষ্টীয় এগার শতকের প্রথম দিকে তার কাল নির্ধারণ করা হয়। বিহারের বিক্রমশীলায় বাস করতেন তিনি। বিক্রমশীল বিহারের দ্বার পণ্ডিত হিশেবেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের গুরু ছিলেন তিনি। বৌদ্ধধর্মের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। এবং একাদশ শতকে সজহযান বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহল যাত্রা করেন। তার গীতে নদীমাতৃক দেশের রূপ ফুঁটে উঠেছে। নৌকার উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করে নৌকা চালনা, গুণ টানা, জল সেচা, নৌকা বাওয়া ইত্যাদির চিত্র উঠে এসেছে। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার কোরে তিনি রচনা করেছেন এই বৌদ্ধগান দুটি। গান দুটির একটি হল-

“সঅসম্বেঅণসরুঅবিআরেঁ অলক্‌খ লক্‌খণ ন জাই।
জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোই॥ ধ্রু॥
কুলেঁ কুল মা হোই রে মূঢ়া উজূবাট সংসারা।
বাল ভিণ একু বাকু ণ্ ভূলহ রাজ পথ কন্ধারা॥ ধ্রু॥
মায়ামোহসমুদা রে অন্ত ন বুঝসি থাহা।
অগে নাব ন ভেলা দীসঅ ভন্তি ন পুচ্ছসি নাহা॥ ধ্রু॥
সুনা পান্তর উহ ন দীসই ভান্তি ন বাসসি জান্তে।
এষা অটমহাসিদ্ধি সিঝই উজূবাট জাঅন্তে॥ ধ্রু॥
বাম দাহিণ দোবাটা চ্ছাড়ী শান্তি বুলথেউ সংকেলিউ।
ঘাট ন গুমা খড় তড়ি ণ হোই আখি বুজিঅ বাট জাইউ॥ ধ্রু ।।”


আধুনিক বাংলায়ঃ
"স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে
অলখ হয় না লক্ষণ;
সোজা পথে গেল যে-যে, আর হয় না রে
তাদের প্রত্যাবর্তন!
কূলে-কূলে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ো না, মূঢ়,
সোজা পথ এই সংসার–
ভুল পথে তিলার্ধ না যেন রে ঘুরো,
কানাত-মোড়ানো রাজ-দ্বার।
মোহের মায়ার এই মহাসিন্ধুর
না-বুঝিস কূল আর থৈ,
নাও নাই, ভেলা নাই, দেখ যত দূর,
নাথে না শুধাও, পাবে কই।
শূন্য এ পাথারের পরিসীমা নেই,
তথাপি রেখো না মনে দ্বিধা–
অষ্টসিদ্ধিলাভ হবে এখানেই
হামেশা চলিস যদি সিধা।
শান্তি বলেন, বৃথা মরিস না খুঁজে,
তাকাস নে বামে দক্ষিণে;
সোজা পথে অবিরত চল্ চোখ বুজে,
সহজিয়া পথ নে রে চিনে।"



১১। মহীধরপা > পদ নং- ১৬
মহীধরপা চর্যার ষোল নং পদ রচনা করেন। তার অন্য নাম মহিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন বলেন ধরা হয়। এবং তার জীবৎকালের নিম্নসীমা ৮৭৫ সাল। তিনি ত্রিপুরা অঞ্চলে ছিলেন। কিন্তু তার সময়ে ত্রিপুরা মগধ অন্ধলের মধ্যে ছিল। তাই প্রকৃতই তিনি মগধ অঞ্চলে বাস করতেন। বিগ্রহ পাল-নারায়ন পালের রাজত্বকালে তিনি চর্যায় পদ রচনা করেছিলেন। চর্যার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কবি কাহ্ণপার শিষ্য ছিলেন তিনি। কারও মতে তিনি দারিক পার শিষ্য। কাহ্ণপার সাথে তিনি চটিগায়েঁ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এবং মহিত্তা ভণিতা দিয়েছেন। প্রাচীন মৈথিলী ভাষা ব্যবহার করেছেন তিনি, কাব্য রচনার জন্য। তার পদে পাপ ও পুণ্যকে দুটি শিকলের সাথে তুলনা করে তা ছিন্ন করে মহারস পান করার কথা বলা হয়েছে।


১২। বীণাপা > পদ নং- ১৭
বীণাপা চর্যার সতের তম পদটি রচনা করেন। মনে করা হয়, বীণা তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র হওয়ার কারণে তার নাম বীণা ছিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন বলে সর্বজন গৃহীত। তবে সুখময় মুখোপাধ্যায় তার ‘প্রাচীন কবিদের পরিচয় ও সময়’ গ্রন্থে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মত তুলে ধরেছেন এ সম্পর্কে। তার মতে, বীণাপা দশম শতকের শেষভাগের কবি। এবং তার গুরু ভাদ্রপা। অথচ অন্য সকল ভাষাবিদের মতে, তিনি বুদ্ধপার শিষ্য ছিলেন। তিনি গহুর (গৌড়) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিষ্য ছিলেন বিলস্যবজ্র এবং তিনি দোম্বীপাদের সমকালীন। প্রাচীন বাংলা ভাষা ব্যবহার করে চর্যায় গীত রচনার পাশাপাশি তিনি একটি গ্রন্থ ‘ব্জ্রডাকিনীনিষ্পন্নক্রম’ রচনা করেন। তার সতের নং পদে সূর্য-চন্দ্রকে উপমা ধরে চমৎকার পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে।


১৩। সরহপা > পদ নং- ২২/৩২/৩৮/৩৯
চর্যায় আরেকজন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হলেন সরহপা। তৎকালীন একাধিক সরহ থাকায় কিছুটা গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, অনেকে মনে করেন, নাগার্জুনের গুরু হলেন সরহপা। আসলে, তিনিও সরহ ছিলেন। কিন্তু চর্যার সরহের নামের সাথে বিশেষ সম্মানসূচক পদবি ‘পা / পাদ’ যুক্ত ছিল। সরহপা পূর্ববঙ্গের রাজ্ঞীদেশের উত্তরবঙ্গ-কামরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তখন কামরূপের রাজা ছিলেন রত্নপাল। তার সময়কাল ১০০০ থেকে ১৩০০ খ্রীঃ অঃ। সরহের শিষ্য ছিলেন এই রাজা। সরহ তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে রাজাকে দীক্ষা দেন। সরহের নিজ জাতি ছিল বাহ্মণ। পরে তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। এগার শতকের দিকে জীবিত এই কবি বহুগ্রন্থ রচনা করেন। ২২১ নেপাল সংবৎ (১১০১ খ্রীঃ) লেখা সরহের একটি দোহা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। এছাড়া অপভ্রংশ ভাষায় তার একটি দোহাকোষ পাওয়া যায়। চর্যায় রচিত তার চারটি পদাবলির ভাষা ছিল বঙ্গকামরূপী। তার পদে শবর-শবরীর প্রেমকাহিনী এবং কতিপয় সরলত্ব কথা প্রকাশ পেয়েছে। তার ৩৮ নং পদের দুটি চরণ-

“কাঅ ণাবডহি খান্টি মন কেডুয়াল।
সদগুরুবঅণে ধর পতবাল। ।“ (পদ ৩৮)


আধুনিক বাংলায়ঃ
"কায় [হইল] ছোট নৌকাখানি, মন [হইল] কেরোয়াল। সদ্গুরু-বচনে পতবাল (পাল) ধর।" (অনুবাদ: সুকুমার সেন)



১৪। তন্ত্রীপা > পদ নং- ২৫ (পাওয়া যায় নি)
চর্যাপদ গীতিকায় একমাত্র তন্ত্রীপার পদটিই খুঁজে পাওয়া যায় নি। এজন্য তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তার ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন- “তন্ত্রীপাদের পদটি বৌদ্ধগানের খণ্ডিত অংশে থাকায় আমরা তা পাই না।” অন্যক্ষেত্রে বৌদ্ধাগানের সংকল ‘Buddist Mystic Songs’ গ্রন্থে বলেছেন- “Tantripa is the author of the song no. 25. He was a disciple of Jalandharipa and afterwards of Kanhapa. In the ms. He is missing.”

১৫। শবরপা > পদ নং- ২৮/৫০
মুহঃ শহীদুল্লাহর মতে, শবরপা’র জীবনকাল ৬৮০ থেকে ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। তাই মুহঃ শহীদুল্লাহ মনে করেন, শবরপা চর্যার কবিদের মধ্যে প্রাচীন কবি এবং তিনি বাংলাদেশের লোক। শবরপা লুইপা’র গুরু এবং নাগার্জুনের শিষ্য ছিলেন।সংস্কৃত ও অপভ্রংশ মিলে তিনি মোট ১৬টি গ্রন্থ লিখেছেন। চর্যাপদে ২৮ ও ৫০ নং পদ দুটি তার রচনা।
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ-

"উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।" (পদ ২৮)

আধুনিক বাংলায়ঃ
"উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।"


১৬। আর্যদেবপা > ৩১
আর্যদেবপা চর্যার একত্রিশ নং পদটি রচনা করেন। তার আসল নাম হল আজদেব। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের প্রথমার্ধের কবি ছিলেন তিনি। সিংহল দ্বীপে তার জন্ম হয়। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি কম্বলারপার সমকালীন ছিলেন। আর্যদেব মূলত মেবারের রাজা রাজা ছিলেন। পরে গোরক্ষনাথের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে পদলাভ করেন। তার ভাষা বাংলা ও উড়িয়া মিশ্রিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “তাঁহার ভাষা অনেকটা বাঙ্গালা বটে, কিন্তু উড়িয়া ভাষা বলাই সঙ্গত।”

১৭। ঢেণ্ডণপা > ৩৩
ঢেণ্ডণপা চর্যার একটিমাত্র পদ (তেত্রিশ নং) রচনা করেন। তার আসল নাম হল ঢেণ্‌ঢস। যা জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ‘বর্ণ-রত্নাকর’-এ লিপিবদ্ধ রয়েছে। খ্রিষ্ট্রীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন। তার জন্মস্থান অবন্তিনগরত-উজ্জয়িনী। তার জীবৎকাল ৮৪৫ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি দেবপাল-বিগ্রহপালের সমকালে ছিলেন। ঢেণ্ডণপা মূলত তাঁতি এবং সিদ্ধা ছিলেন। এজন্য তার পদে বাঙালি জীবনের চিরায়ত দারিদ্রের চিত্র ফুটে উঠেছে কাব্যিক সুষমায়। তার এই পদযুগলটি উল্লেখযোগ্য-

“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী” (পদ ৩৩)


আধুনিক বাংলায়ঃ
"টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে।"


১৮। দারিকপা > ৩৪
দারিকপা চৌত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন। তার আসল নাম ইন্দ্রপাল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষভাগে ও নবম শতকের শুরুতে তার সময়কাল ছিল বলে ধারণা করা যায়। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে তিনি সালিপুত্র নামক স্থানের রাজা ছিলেন। যার জন্মস্থান উড়িষ্যার শালীপুত্রে। সিদ্ধা পদলাভের পরে তিনি দারিক নাম ধারণ করেন। লুইপার কাছ থেকে তিনি সিদ্ধ লাভ করেন এবং তার শিষ্য হিসেবে মর্যাদা পান। তবে এক্ষেত্রে মতবিরোধ রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে, “দারিকপা লুইপার সাক্ষাৎ শিষ্য নন, শিষ্য পরম্পরার একজন”। চর্যায় তার রচিত পদটি প্রাচীন বাংলা ভাষার। তথাদৃষ্টি ও সপ্তম সিদ্ধান্ত গ্রন্থদুটিও দারিকপাদ রচনা করেন।


১৯। ভাদেপা > ৩৫
ভাদেপার চর্যায় ভদ্রপাদ নামে পরিচিত। পঁয়ত্রিশ নং বৌদ্ধগানটি তিনি রচনা করেছেন। তার জন্ম হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে। এবং বিখ্যাত পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে তার জীবনের নিম্নসীমা ৮৭৫ সাল। এথেকে বোঝা যায় যে, ভাদেপা বিগ্রহ ও নারায়ন পালের রাজত্বকালের সময়ে বর্তমান ছিলেন। তার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র মতে তার জন্ম মণিভদ্র। কিন্তু অন্য অনেকে মনে করেন শ্রাবন্তী এলাকায়। তিনি কাহ্নপা, মতান্তরে জালন্ধরীপার শিষ্য ছিলেন। তিনি পেশায় চিত্রকর চিলেন। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভের পর সিদ্ধা হন। ভাদেপার পদে মূলত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিভিন্ন বিষয় ফুটে উঠেছে। তার পদের প্রথম দুই পঙক্তি-

“এতকাল হঁউ আচ্ছিলোঁ স্বমোহেঁ
এবেঁ মই বুঝিল সদ্‌ গুরু বোহেঁ” ।। (পদ ৩৫)


আধুনিক বাংলায়ঃ
"এতকাল আমি স্বমোহে ছিলাম
এখন সদগুরু বুঝলাম।"



২০। তাড়কপা > ৩৭
চর্যায় যেসব কবি পদ রচনা করেছেন, তাদের প্রত্যেককে “গ্রুব্‌-ছেন-গ্যব্‌শি” বা মহাসিদ্ধ বলা হয়ে থাকে। Albert Gruenwedel যে ৮৪ জন মহাসিদ্ধের নাম প্রকাশ করেন, তার মধ্যে তাড়কপা উল্লেখ নেই। ফলে তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে তাড়কপার আসল নাম হল ‘নাড়কপা’। তবে ড.মুহম্মদ শহিদুল্লাহ্‌ এটিকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেন। চর্যার সাইত্রিশ নং পদটি তাড়কপা রচিত।


২১। কঙ্কণপা > ৪৪
কঙ্কণপা চর্যার চুয়াল্লিশ নং বৌদ্ধগানটি রচনা করেন। তিনি খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শেষভাগের কবি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে অনেক গবেষক এ মত প্রকাশ করেন- কঙ্কণপা ৯৮০ থেকে ১১২০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি বিষ্ণুনগরের রাজা ছিলেন। পরবর্তিতে তার গুরু কম্বলাম্বরের কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষা লাভ করে সিদ্ধ হন। তবে অনেক ভাষাবিদ এ মত-ও প্রকাশ করেন যে- তিনি কম্বলাম্বরের বংশধর ছিলেন এবং দারিকপাদের শিষ্য ছিলেন। কঙ্কণপার রচিত বৌদ্ধগানটির ভাষা অপভ্রংশ। এ থেকে বলা যায় তার ভাষা ছিল বাঙলা এবং অপভ্রংশ মিশ্রিত।


২২। জয়নন্দীপা > ৪৬
জয়নন্দীপা-এর আসল নাম জয়ানন্দ। চর্যার ছেচল্লিশ নং পদটি তিনি রচনা করেন। তার জন্ম বাংলাদেশে। বলা হয় বাংলাদেশের কোনো এক রাজার মন্ত্রী নিযুক্ত ছিলেন তিনি। জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার রচিত পদে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমনঃ তার মূল ভাষা ছিল গৌড় অপভ্রংশের পরবর্তী আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন রূপ। যা মিথিলা প্রদেশের ভাষা মৈথীলা, উড়িষ্যার ওড়িয়া, বঙ্গঅঞ্চলের বাংলা ও আসামের ভাষার সংমিশ্রণ বা সদৃশরূপ।


২৩। ধর্মপা > ৪৭
চর্যার সর্বশেষ কবি হলেন ধর্মপা। তিনি চর্যার সাতচল্লিশ নং পদটি রচনা করেন। ধর্মপা বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের শুরুর দিকে তার জন্ম হয় এবং প্রায় ৮৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। গোত্র ছিল ব্রাহ্মণ। এ থেকে বোঝা যায় বিগ্রহ নারায়ণ পালের রাজত্বকালে তিনি জীবিত ছিলেন এব এবং ঢেণ্ডণপার সমকালীন ছিলেন। ধর্মপা কাহ্নপার শিষ্য। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষালাভের পর তিনি ভিক্ষু ও সিদ্ধা হন। চর্যায় তার রচিত পদটির ভাষা বাংলা। উক্ত পদে অগ্নিকাণ্ডের প্রতীকে গভীর যোগতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে।

● ●● তথ্যসূত্রঃ● ●●
১. বাংলা সাহিত্যের কথা – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌
২. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য- দীনেশচন্দ্র সেন
৩. বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য- প্রবোধচন্দ্র বাগচী
৪. প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যের কালক্রম- সুখময় মুখোপাধ্যায়
৫. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত- ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. কতো নদী সরোবর- হুমায়ুন আজাদ
৭. সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা- আহমদ শরীফ
৮. লাল নীল দীপাবলি- হুমায়ুন আজাদ
৯. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা- সৌমিত্র শেখর
১০. ভাষার ইতিবৃত- সুকুমার সেন
১১. The Origin and Development of the Bengali language- C. Suniti Kumar
১২. ভাষা-শিক্ষা – হায়াৎ মামুদ
১৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম


____________________________________________

● ● ● ●সহায়ক লিঙ্ক● ● ●

উইকিপিডিয়া

চর্যাগীতি

চর্যাপদ থেকে অনুবাদ ___ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

চর্যাপদ' কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

_____________________________________________
●●●একটি চর্যাগান●●●
_____________________________________________
॥১২॥
কৃষ্ণপাদানাম্ (কাহ্নপাদানাম্)
রাগ-ভৈরবী


করুণা পীঢ়িহি১ খেলহুঁ নঅবলা ।
সদ্‌গুরু বোহেঁ জিতেল ভববল ॥ধ্রু॥
ফীটিউ২ দুআ আদেসি রে৩ ঠাকুর ।
উআরি৪ উএসেঁ৫ কাহ্ণ৬ ণিঅড় জিনউর ॥ধ্রু॥
পহিলেঁ তোলিআ৭ বড়িআ ৮ ।
গঅবরেঁ তোলিআ পাঞ্চজনা ঘোলিউ৯ ॥ধ্রু॥
মতিএঁ১০ ঠাকুরক পরিনিবিত্তা ।
অবস১১ করিআ ভববল জিত্তা১২ ॥ধ্রু॥
ভণই কাহ্ণ৬ আম্‌হে১৩ ভলি দাহ১৪ দেহুঁ ।
চউসট্‌ঠী১৫ কোঠা গুণিআ লেহুঁ ॥ধ্রু॥


চর্যাগানটির অডিও লিঙ্কঃ গানঃ চর্যা- ১২

সূত্রঃ গানঃ চর্যা- ১২ _ অচিন্ত্য

_____________________________________________


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২৫
২৫টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×