somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আল মাহমুদঃ ছায়াহীন বৃক্ষ

২৭ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
তিনি মিটিমিটি হাসছেন, চোখ দু'টো বুজে আছে সে হাসির রেনু ছড়িয়ে দিতে শশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলে। তিনি বাংলা কবিতার এসময়ের মহীরূহ- আল মাহমুদ। তাঁর সাহিত্যের দিপ্তী কবিতার গেরস্থালি পেরিয়ে গল্পে-উপন্যাসে সুগভীর শেকড় বিস্তার করেছে- তাও অনেক দিন। ছোটখাট সমসাময়িক কড়চার অর্কিড শোভা বাড়িয়েছে তাঁর লেখালেখির বাগানবাড়ীর। যদিও বয়সের ভার, স্মৃতি কাতরতা, দৃষ্টিক্ষীণতা, স্বজনের প্রতারনা, অনুমান নির্ভর ইতিহাসচারন- সেই বাহারী গুল্মের কীটদষ্ট পাতার মতো কখনো কখনো। 'প্রধান কবি'র গালভারা শব্দটি আল মাহমুদের ভাগ্যে জোটেনি। কবি ভ্রুকুটি করেন এ তকমা; আবার ভুলেও থাকতে পারেন না। নিজের আর্থিক দীনদশার কাহিনীর পাশে এই না-পাওয়াটিরও একটা দীর্ঘশ্বাস বাজারের ফর্দের মতো দশ দিগন্তের এক কোণে পড়ে থাকে। রাজনীতির নেকাবও দুলে ওঠে দশ দিগন্তের ঈশান-অগ্নী কোণে। নেকাবের আড়ালে যে মুখটি, সে অনুযোগ করে অন্যের নামে- লোকে তাঁকে মৌলবাদী বলেন। আবার প্রতিপক্ষকে মোক্ষম জবাবও দেয় সে মুখোশ- আমিতো মৌলবাদী!

'বাংলাদেশ থাকলে আপনিও থাকবেন'- আল মাহমুদ জানিয়েছেন আমাদের। আমরা মায়ের সোনার নোলক হারিয়েছি একদিন, এবার বুঝি মা'কেই হারানোর ভয় পাচ্ছেন কবি। কারা ভাবেন বাংলাদেশ না থাকলেও তারা থাকবেন? আল মাহমুদ জানান, 'তথাকথিত নাস্তিক আর প্রগতিবাদীরাই এ ধরনের চিন্তা করে চলেছে'। কবির 'সেই সত্য রচিবে যা তুমি'- কলামিস্টের বাণী হয়ে গেলে অন্য রকম শোনায়। কবির পক্ষ থাকে, পক্ষপাতও থাকে- প্রতিপক্ষ থাকেনা। কখনোই না। দশ দিগন্তে উড়ালের অধিকার কবিরই জন্য, কলামিস্ট সেখানে বড়ই বেমানান।

'কোন নাস্তিক্যবাদী আদর্শই বাংলাদেশের অস্তিত্বের গ্যারাণ্টি নয়। বাংলাদেশ টিকতে পারে শুধু ইসলামী আদর্শের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়েই'- আল মাহমুদ যখন একথা বলেন, আমি সেখানে কবিতা খুঁজে পাইনা- কেবল এক অ-কবির আস্ফালন দেখি। বাংলাদেশের অস্তিত্বের গ্যারাণ্টি হিসেবে 'নাস্তিক্যবাদ' কে উপহার দিয়েছে? কেউ দেয়নি। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের যারা স্বপ্ন দেখেন তারা কি নাস্তিক? আল মাহমুদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতাই কি নাস্তিক্যবাদ? তিনি আরো বলেছেন, 'এ দেশের ওইসব কুচক্রী শয়তানকে হজম করে ফেলার শক্তি যে বাংলাদেশের আছে, তা একবার দেখিয়ে দিলে মন্দ হয়না।' আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া শীতল এক অনুভূতি টের পাই। একজন কবি বলছেন এ কথা! আমি অবাক হই, হতাশাও আমার করোটির মধ্যে পেরেক ঠুকে দেয়না- আল মাহমুদ তরবারী হাতে সেখানে যে বসে!

আল মাহমুদের এই গোষ্ঠীটি শক্তি যে একেবারে প্রদর্শন করছে না তাতো আর নয়! ছায়ানটের বর্ষবরণে হামলা হয়েছে- হত্যা করা হয়েছে উৎসব দেখতে আসা কয়েকজন সাধারন মানুষকে, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে- খুন করা হয়েছে তেইশজনকে, ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা হয়েছে, সিপিবি'র মিটিং-এ বোমা হামলা হয়েছে, উদিচি'র অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছে, আদালতে কর্মরত বিচারকে হত্যা করা হয়েছে, সারাদেশে একসাথে বোমা ফাটিয়ে আতংক তৈরী করা হয়েছে- আল মাহমুদ এতেও তুষ্ট নন! ২০০৮-এ প্রস্তাবিত নারী নীতির বিপক্ষে মরিয়া প্রতিক্রিয়াশীল যে গোষ্ঠীটি তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে সারা দেশে তাতেও কি আল মাহমুদ নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, তাঁর 'নাস্তিকেরা' যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন উদিয়মান এই যমদূতদের সম্পর্কে?

আল মাহমুদের ভাষায়, 'বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। এখানকার ধর্ম আর ভাষা এক। আশা-আকাঙ্ক্ষাও এর অনুকূলেই থাকতে হবে। তা না হলে এর অস্তিত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়বে'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের বক্তব্যটি এত নিখুঁতভাবে আল মাহমুদ কবে রপ্ত করলেন? ধর্মের দোহাই দিয়ে কীটের মত যে গোষ্ঠীটি টিকে আছে বাংলাদেশে, তাদের অনুরনন এতোটাই অবিকৃতভাবে তিনি করছেন যে, কখনো কখনো মনে হয় যুদ্ধাপরাধীর কোন প্রেতাত্মার কথা শুনছি। ভাবতেও অবাক লাগে আল মাহমুদ একদিন এদেরই বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

আল মাহমুদ শারীরিক দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতার সাথে সাথে নিজের নৈতিক শক্তির অবলোপ ঘটিয়েছেন। বার্লিন প্রাচির ভেঙ্গেছে আর সাথে সাথে এককালের বামপন্থী অনেকের মতই তিনিও চরম ডানপন্থীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এ যেন এক তামাশাপূর্ণ ডিগবাজী প্রতিযোগিতা- সার্কাসের সঙরাই যা এককালে দেখাতো।

দুই
ছেলেবালায়- যে বয়সে মানুষ সুতোছেঁড়া ঘুড়ির পেছনে দৌঁড়ায়, পুষবে বলে পাখি ধরে আনে জঙ্গল থেকে- সে বয়সে আমি আর আমার বয়সী অনেকে- গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন এক মানুষের লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম লাশটি তখনও গাছে ঝুলে আছে। ভয় পেয়েছিলাম বাড়ী ফেরার পথে, অনেক বয়সেও আত্মঘাতী সেই মানুষটিকে আমি দুঃস্বপ্নে দেখতাম। যে গাছে মানুষটি নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল কোন এক ঝিম ধরা দুপুরে- সে গাছটিকে পুরোপুরি কেউ কেটে ফেলেনি; শুধু একটি ডাল কেটে দিয়েছিল- যেখানে সে ঝুলে ছিল পরের দিন পুলিশ আশা অব্দি। অন্ধকার মতো সেই ভূতেধরা জংলা জায়গাটিকে আমরা এড়িয়ে যেতাম; তবু সে আমাদের পিছু নিত প্রতিটি নির্জন দুপুরে, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় আর প্রতিটি দুঃস্বপ্নের রাতে।

আল মাহমুদের সৃজনশীলতা কি আমার ছেলেবেলার 'শুধু একটি ডাল কেটে নেয়া' সেই বৃক্ষের মতো? আমি জানি না। দশ দিগন্তে উড়াল দিয়ে আল মাহমুদ কোন পালক ফেলে রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য?
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×