somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ দেয়ালের ওপাশে

৩১ শে জুলাই, ২০০৮ রাত ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেয়ালের ওপাশে আমার বাবা-মা, এপাশে আমি। গতকালও যে বালিশে আমি ঘুমিয়েছি, যার গায়ে নাম না জানা কী একটা সুতোর ফুল আমার গালে লেপ্টে ছিল, আমি তাকে কোন এক পেট-মোটা বাক্সে লুকিয়ে দেয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাবার দিকে চোখ পড়ল এক ঝলক। আমি যত এগিয়ে যাচ্ছি অলৌকিক জাহাজের দিকে, বাবা ততই দেয়ালের কাঁচ বেয়ে এগিয়ে চলছেন, যেন আমার সুখে থাকা নিশ্চিত করতেই তার এই দেয়াল-যাত্রা। আমি থামি, এখানে-ওখানে ঝোলানো নোটিশগুলো দেখি। আমি না দেখেও বুঝি, খাটো-লম্বা ঘাড়ের চিলতে ফোঁকর দিয়ে বাবা আমাকে দেখছেন।

যখন এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে আমি ঢুকলাম, শুনলাম দূরে কে যেন বাঁশী বাজাচ্ছে। কোন এক আব্দুল আলীম কুমড়ো ডগার মতো বাতাসে দুলে উঠছেন। বাঁশিওয়ালা হলুদিয়া পাখি ওড়াচ্ছেন একাঁধে-ওকাঁধে। এক সময় পেটমোটা বাক্স আর চোখের পানির সাথে পাখিটি দেয়ালের এপাশে আসে। অনভ্যস্ত কোটে সোনা-বরণ পাখিটি বোতাম হয়ে ঝুলে থাকে।

দেয়ালের ওপাশে কিছু মানুষ চাদর বিছিয়ে শুয়ে-বসে আছে। ওরা দীর্ঘ সময় ওখানে থাকবে। ওদের বিয়ে করা নতুন বউয়েরা লাল শাড়ির আঁচলে চোখ মুছবে। ওদের কান্নায় শব্দ হয়, যেন ব্যথা পেয়েছে। ওদের রোগা শরীরে কটকটে টি-শার্ট, তাতে প্রমান সাইজের কোন সাংকেতিক চিহ্ন। ওরা দল বেঁধে ঘুরবে, রাস্তায় বসে কেডসের ফিতেয় বিষগেঁড়ো দেবে, যেন এজন্মেও তা ঢিলে নাহয়ে যায়। ওদের পায়ের জুতোগুলো মরা মাছের মতো ভেসে থাকে। আমরা সহযাত্রী; জলদস্যুর দূরবিন চোখে আমাদের। শস্যদানা-মুখে উড়ে-যাওয়া পায়রার গোপন পৃথিবীতে আমরা যেন প্রেরিত পুরুষ।

জুতো পড়ার আগমূহুর্তেও যাদের পায়ে কাদামাটি লেগেছিল, আর আমরা যারা এক পুরুষ আগে জুতো চিনেছি- তারা গন্তব্য-ঠিকানায় অচেনা পোষ্টকোড বসাই। তমোহর সেইসব সংকেত ডুবন্ত ব-দ্বীপে নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে। দেয়ালের এপাশে আমরা দশ হাজার কাছিম দীর্ঘ জীবনের আশায় কলম্বাস হয়ে ওঠি। ওপাশের বাতাসে বুক ভরে সিসা টানে আমাদের পরম স্বজন।

একটি হাওয়াই জাহাজ পাখি হয়ে আমার পায়ের কাছে এসে থামে, নাকি উড়ে যায়- আমি শব্দ শুনে অনুমানের অভিধান খুজি। ওপাশ থেকে দু' জোড়া চোখ আমাকে খোঁজে, কিংবা মোটা কাঁচের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে পাঠ করে আমার মুখের রেখা।

দেয়ালের এপাশটা যেন মহাভারতের রক্ষাচক্র। ওপাশের দশমুখো রাবনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবে আমাদের মতো অলৌকিক চিঠিওয়ালাদের। সুখে থাকার ঐশ্বরিক আদেশ আমরা হাতে নিয়ে ঘুরছি। ওপাশের থতমত প্রিয়মুখ ঝাঁপসা চোখে আমাদের দেখে। আমাদের ধকল-পোহানো চেহারা আর পেটমোটা বাক্সগুলোর ছায়াপথে লেপ্টে থাকে সে দৃষ্টি। আমরা ডানে যাই, ওদের আগ্রহের চুম্বক ডানে ঘুরে যায়; আর বায়ে গেলে বায়ে। ওপাশের মানুষেরা কাঁচের গায়ে হাত রাখলে, এপাশে আমাদের হাত ছুটে যায় সেখানে। শেষবারের মতো স্পর্শ করি ওপাশের উষ্ণতা; নাকি দেয়ালটাকে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করি কত দূরে এলাম?

আমি আবার দেয়ালটির কাছে এগিয়ে যাই। মা আঁচলে মুখ চেপে রেখেছেন। 'তোমরা এবার যাও', আমি মাকে বলি। মা কি যেন বলেন। এপাশে শব্দ পৌঁছেনা। বাবা আমাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিংবা ভীড় ঠেলে আসতে দেরী হলো তার, তিনিও হাত নেড়ে কিছু একটা বলেন। আমি মাথা ঝাঁকাই, যেন বুঝতে পেরেছি। বাবা আবারো কি যেন বলেন, দেয়ালে দু'বার ফু দেন। দরুদের ভালবাসা কাঁচের গায়ে মেঘ হয়ে জমে। দেয়ালের এপাশে, হাওয়াই জাহাজে, আর চিরসুখের দেশে এ মেঘ ঠিকই আমার অমঙ্গলকে তাড়া করবে, আমি জানি। কয়েক অনুপলের সাদা মেঘ কি কুয়াশা কেটে গেলে বাবার চোখ স্পষ্ট হয়।

বাবা ঠোঁটের রেখায়, হাতের জ্যামিতিক সংকেতে পাসপোর্ট আর টিকেটের কথা মনে করিয়ে দেন। আমি নিরাপদ জীবনের সন্ধানে ততোধিক নিরাপদে ওগুলো জমা রেখেছি বুকের খুব কাছাকাছি, বুকপকেটে। শ্বাস টানলেই যার স্পর্শে বেজে উঠছে সুবেশী-সুখী জীবন, আর অধরা স্বপ্নের কর্নেট।

কোথায় যেন বাঁশি বাজে। আব্দুল আলীম নাকি আব্বাস উদ্দীন বাঁশির লতানো সুরে দেয়ালে-দেয়ালে আছড়ে পড়েন; বরফ-কুচি হয়ে তৃষ্ণার জলে ভেসে থাকেন। কখনো কাজে লাগবে ভেবে জ্যামিতি বক্সে যে কিশোর টুকরো কাগজ জমায়, তার মতো কে যেন বাঁশির সুর গুজে দেয় আমার করোটিতে।

জীবন একটা জ্যামিতি বক্সের মতো; সূক্ষ্ম কাঁটা-কম্পাসের সাথে সাথে সেখানে টুকরো কাগজও জমে।

সিমেনার শেষ দৃশ্যের মতো ইচ্ছে করে- দেয়ালের ওপাশে বের হয়ে আসি; চোখে কান্না নিয়ে, কিংবা কান্না চেপে যারা তাকিয়ে আছে এদিকে, অবাক করে দেবার জন্য ওদের পেছনে সন্তর্পণে দাঁড়াই। আমি জানি, মুখ ফেরালেই সাতান্নটি মোমবাতি আলো ছড়াবে ওই চোখগুলোতে।

আমি সিদ্ধান্ত নিই- নাটকই হোক।

দেয়ালের ওপাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে, যারা আমার পরম স্বজন, তাদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব, কোন পরবাসে? ড্রয়িং-রুমের সেই সবুজ রং-এর ফ্যানের নীচে, খাওয়ার টেবিলে, বুজে যাওয়া পুকুর ঘাটে, দেয়ালের বেঢপ তক্ষকটাকে দেখে, আর আজন্ম চেনা বৃষ্টিজলে না হয় কেটে যাক আমাদের অনিরাপদ জীবন। বালতি জলে ভিজিয়ে রাখা শাড়ীর মতোই না-হয় সাতার কাঁটব সুখে-অসুখে! আমি বাইরে আসি। এবার কাঁচের এপাশ থেকে ওপাশের মানুষদের দেখি, যাদের সবুজ বইয়ের কোন এক পাতায় সুখের ছাড়পত্র।

মা আমাকে লক্ষ্য করেনি। আমি তার পাশে দাঁড়াই। বাবা কোথা থেকে ছুটে আসেন। চোখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে প্রশ্ন করেন, 'কিরে খোকা?' মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি হাসি। মা হেসে ওঠেন; ভারী চশমার পেছনে তার চোখও হাসে। বাবার হাত আমার কাঁধে এসে থামে। তার দুশ্চিন্তা চোখ থেকে আঙ্গুলে এসে জমা হয়। আঙ্গুলগুলোও আমাকে প্রশ্ন করে, 'সব ঠিক আছে খোকা?' আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হাসি। যারা আনন্দ কিংবা কষ্টের সশব্দ রূপ দেন, তাদের মতো করে বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মা আমার মাথায় হাত রাখেন। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলে, যে মানুষগুলো আমাদের দেখছিলো- তারা পিকাসোর পায়রা হয়ে শস্যমুখে ইতিউতি উড়ে যায়। স্বজনের স্পর্শ পায়রার পালকের মতো আমার গায়ে লেগে থাকে।

'যেতে ইচ্ছে করেনা?' মা জানতে চান। মায়ের কথায় কি যেন গলার কাছে আটকে থাকে আমার। 'বাড়ী ফিরে যাবি?' বাবা আমাকে ছোটবেলার মতোই পড়তে পারেন। মুখের রেখাগুলো এত পাঠযোগ্য করে কোথায় লুকাব আমি! 'বাড়ী চল', বাবা আমার পিঠ চাপড়ে দেন। আমি পাসপোর্ট আর টিকেট মায়ের কাছে দেই। মা যেভাবে যত্ন করে উলবোনে, সেলাই করে, তেমন করে সেসব ঐশী কাগজগুলো ধরে রাখেন। আমি পকেট হাতড়াই। ছেঁড়া দু' টাকার একটা নোট খুঁজে পাই টুকরো কাগজের জঙ্গলে। সেটি বাবাকে দিয়ে বলি, 'যে লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল, তাকে দিও।'

গেয়ো কোন সুরে বাঁশিটি বেজে ওঠার আগেই আমি ফিরে আসি কাঁচ ঘেরা দেয়ালের এপাশে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০০৮ সকাল ৭:৩১
৪৩টি মন্তব্য ৪২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×