somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ জলের রঙে জলছবি

০৪ ঠা আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক

কাকচক্ষু জল ছিল, আর ছিল হেলেঞ্চার গায়েপড়া বসত। কলমীর বেগুনী ফুলও ছিল জল ছুঁয়ে। জলের ওপর পাথরকুচি ঢেউ, ঢেউয়ের মাথায় পানি-মাকড়সা আর দু'টো হলদে পাতা। হিজল গাছের পানি-ছোঁয়া ডালে একটা মাছরাঙা পাখিও ছিল হয়ত। হেরা-গুহার ধ্যানীর মতো শান্ত দুপুর। দুপুর জড়ানো সাদা-তুলোট মেঘ। মেঘ পেরিয়ে নীল আকাশ, আর তার নীচে সদ্য নারী হয়ে ওঠা একটা পানপাতা-মুখ। আর কেউ ছিলনা সেখানে, এমনকি ঘুঘুর ডাকও।

এটাই বুঝি জলের আরশি!

পানপাতা-মুখ জলের আয়নায় চোখ রাখে, হাতের আঙ্গুলে নকশা কাটে পানিতে। চারটে পাপড়ীর কী একটা ফুল, আর একটা পাখি আঁকা শেষ হলে সেগুলো মুছে দেয়, যেভাবে বর্ষা মুছে দেয় বৃষ্টির দাগ। জলের দাগ মুছে গেলে, কিংবা একটা ফড়িং কলমী ডগায় স্থির-বসে-থাকে বলেই মেয়েটির কেমন যেন লাগে। এ যেন বেদনা চেপে 'পথের পাঁচালী' পাঠের আনন্দ। হয়তো এও নয়; এরচেয়ে বেশী কিছু।

মুখের আলপনায় দৃষ্টি ফেরায় মেয়েটি। নিজেকে দেখে। ভ্রু-পল্লব আর অলক-চূর্ণ গীতবিতানের মিলিত অক্ষর যেন। বোগেনভিলার মতো একগুচ্ছ চুল চোখের ওপর নেমে এলে মেয়েটি বুড়ো রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি বসে গেয়ে ওঠে- 'আকাশমুখর ছিল যে তখন ঝরঝর বারিধারা'। মাস্টার মশাই বলেন, 'আকাশ দেখেছো কখনো?' জানালার বাইরে মেয়েটি আকাশ দেখে। মাস্টার মশাই বলেন, 'চোখ মেলে নয়, চোখ বুজে দেখ'। মাস্টার মশাই হারমোনিয়ামটি কাছে টানলে তার আঙ্গুল মেয়েটির হাত ছুঁয়ে যায়। আর মেয়েটির গালে ত্বরিত বিদ্যুৎ খেলে যায় বলেই, চোখে আদিগন্ত লজ্জা নামে। তার দৃষ্টি আনত হয়, যেন চোখ পড়লেই বুড়ো মানুষটির কাছে ধরা পড়ে যাবে সে। রবীন্দ্রনাথ তখনো চোখবুজে আকাশ দেখছিলেন বলেই মেয়েটির মন কেমন করে, ব্রীড়া-অবনত-চোখে জল জমে, অসহ্য লাগে সবকিছু। মাস্টার মশাই 'গোধূলি গগনে মেঘে'র অস্থায়ীতে ফিরে যখন চোখ মেললেন, দেখলেন তার কিশোরী ছাত্রীটির চোখে জল। চোখের জলে কী পাঠ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ কে জানে, তিনি আর কাউকে গান শেখাননি।

মেয়েটি কি জানে, অমন ঘুম না-ভাঙ্গা গান-শেখা-ভোরে সলতে হাতে আগুন সে খোজে নি, নিজেই দাহ্য হয়ে উঠেছিল ভেতরে ভেতরে? তবুও বুড়ো গানের মাস্টার তারে দাঁড় করে দিয়েছে অগম বৃষ্টি-ধারায়। কখনো আকাশ মুখর হলে সুদূর অতীত থেকে গানের মানুষটি বুড়ো রবীন্দ্রনাথ হয়ে সামনে এসে বসেন, আর হাত ছুঁয়ে দিয়ে মিলিয়ে যান জলরেখায়। আর জলরেখায় কেউ মিশে থাকে বলেই, পানপাতা-মুখ নিজেরে দেখে জলের আয়নায়।

মেয়েটি হাতবালা খুলে ভাসিয়ে দেয় পুকুর জলে। শ্যাওলা পিছল ঘাটে লুকিয়ে থাকা কয়েকটা ডানকিনে আড়মোড়া ভাঙ্গে, ঢেউ হয়ে ওঠার আগেই মিইয়ে যাওয়া অনুচ্চ জলের দোলা ক'টি ঘূর্ণীপোকাকে নাগরদোলায় চড়ায়। তারপর আবার সব মৌনব্রত পালন করে বোধীদ্রুম বৃক্ষতলে। আকাশের তুলো-মেঘ বর্ণমালার বইয়ে হাশেম খান হয়ে উঠলে মেয়েটি জলের গায়ে লিখে- আকাশলীনা। লীনা আপুকে কি নামে ডাকে তার স্বামী?

ভালবাসলেই রক্তজবা নারীর গ্রীবায় ফুটে থাকে প্রায়ই।

লীনা আপু আকাশে বিলীন সন্ধ্যার মুখে কার জন্য অধীর বসে থাকত? আর ঘরে ফিরলে গলা আর বুকের মোরগজবা ফুল ওড়নায় কোন উষ্ণতা ছড়াত চোখে আর আঙ্গুলের নাচের মুদ্রায়? লীনা আপু লাল পাতাবাহারের মতো অমন ফুটে উঠেছিল বলেই মায়ের ঘুম হতোনা, বাবা ঘনঘন ডাক্তার ডাকতেন। সন্ধ্যার সেই মানুষটিকে লীনা আপু পায়নি বলেই তার গ্রীবায় আর কখনো কোন লাল ফুল ফুটে ওঠেনি। আর কোন ফুল ফোটেনা বলেই কি পিঠে কালসিটে দাগ জমে? কালসিটে বাড়ন্ত হয় বলেই মাঝরাতে কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদে। লীনা আপু, যে ছেলেটি তোকে আকাশলীনা নামে ডেকেছিল, সেও কি আর কোনদিন নারীর গ্রীবায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়নি? অন্যকোন পিঠের ইজেলে সেও কি কালসিটে আঁকে, সংসার সাজায়?

পানপাতা-মুখ জলের আয়নায় চোখ মেলে আবার। কেউ সাবধান করেনি বলেই কি সে রুমাল কিনেছিল কারো নামে? সুদীপ্ত না আর কারো চোখে তাকাবে বলেই কাজল এঁকেছিল সে? কাঁচ-ভাঙ্গার শব্দে বড় ভাইয়ের বাল্য-সহচর সুদীপ্ত যেদিন হেসে উঠেছিল মেয়েটির কথায়, তার বুকের ভেতর মাস্টার মশাইয়ের ভৈরবী বেজে ছিল। সেদিনের বিদ্যুত-চমকে নয়, মোমের আলোয়- দেখা না-দেখার আবছায়ায় মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কোন এক সুদীপ্তের হাত ছোঁবে বলে; যেন কেউ ছুঁয়ে দিলেই পুনর্জন্ম ঘটে যায়। আর হয়ত ভালবেসে কিশোরীটি কারো জন্য রুমাল কিনেছিল বলেই, সুদীপ্তদের এপারের বসতভিটার নটে গাছ মুড়োয়। ওপারে আশ্রিত হয় এপাড়ার তুলশী গাছ।

অলকচূর্ণ চুলের আড়ালে গুজে দিতেই মেয়েটির কানেরদুল হাতের তালুতে এসে থামে এবং এক সময় পানপাতা মুখের জল-বালিকার নোলক হবে বলে সেগুলো পানিতে ডুব দেয়। মেয়েটি গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে জলের অতলে। জলের ভেতরে মুছে যাওয়া জলছবির মতো ডানকিনে মাছ সাঁতরায়। আরো গভীরে কিছু প্রিয় মুখ সবুজ শ্যাওলার গায়ে কানাকানি করে। কোরান শেখানো মওলানার বেতের মতো সপাং করে একটা মাছরাঙ্গা পাখি জলে ঝাঁপ দেয়। তার ঠোঁটে কী একটা মাছ ঝুলে থাকে। মওলানার সপাং-বেত গৌতম বুদ্ধের মতো আবার হিজলের ডাল খুঁজে নেয়; ধ্যানমগ্ন হয়।

জোহরের নামাজ শেষ হলে মেয়েটি যখন আরবী শিখত, আর সাথে থাকত এপাড়ার উঠতি বয়সী কিশোরীরা, ওরা কেন অমন করে তার দিকে তাকিয়ে থাকত? তার চিবুকে তিল ছিল বলে? নাকি হায়েজ-নেফাজ না-কি সব বুঝিয়ে হুজুর তাকে লজ্জা দিলেও সে বোকার মতো হেসেছিল বলে? বুকে বড় ওড়না-টানা মেয়েরা যখন এর-ওর গা ঠেলাঠেলি করছিল, আর লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল, তখন পানপাতা-মুখ অবাক হয়ে দেখছিল মসজিদের শীতল বারান্দায় রক্তের দাগ। তখনো সে কিছু বোঝেনি। হুজুরের লকলকে বেত কুৎসিত গালির সাথে পিঠে, বুকে, আর রক্তমাখা পাজামায় সপাং সপাং নেমে এলে মেয়েটি চড়ুই পাখির মতো ছটফট করেছিল মসজিদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা, করিবর্গা আর মিনারের ঘুলঘুলিতে। পানপাতা-মুখ বাড়ী ফিরে লতার মতো মাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা লজ্জায়-মাথা-হেট করে কিশোরী কন্যার অস্পৃশ্যতা মুছে দিয়ে আসে মসজিদের সিঁড়ি থেকে কোরানের গিলাফ অব্দি।

শরীরটা এতখানি অচ্ছুত বলেই বুঝি ভীড়ের মাঝে কালকেউটে হাত গায়ে উঠে আসতে চায়; উঠে আসে!


দুই

ভালবাসার আড়ালে মানুষের বিপন্ন-বোধ কি জলের রঙে জলছবি আঁকে? বর্ষায় বৃষ্টির দাগ মুছে গেলেও জলের গভীর অতলে কেউও কি প্রথম বৃষ্টিপাতের কথা মনে রাখেনা? কেউ হয়ত রাখে, কেউ হয়ত রাখেনা। কোমল-গোপন-অতীতের মতো বিষন্ন নিঝুম দুপুরে মেয়েটি যেন মেয়েটিরই সহচর। যেমন মধ্যদুপুরে ছায়ার পার্শ্বচর একলা মানুষ। ঝিমধরা দুপুরে শ্যাওলা জমা দীঘির গভীরে প্রিয় কোন মুখ লুকিয়ে থাকে বলেই মানুষ রুমালে নকশা আঁকে। আর তাকে আলিঙ্গনের তীব্র বাসনা জাগে বলেই মানুষ ডুব সাঁতার দেয়। এই ডুব সাঁতার শেষে কেউ কেউ ঘরে ফিরে, কেউ কেউ ফেরেনা। যারা ঘরে ফিরে- তারাও একদিন ফিরবে না বলে জলের কাছে ফিরে আসে।

পানপাতা-মুখ জলের সিঁড়িতে পা ডোবায়। যে মাছেরা এতক্ষণ তাকে দেখছিল আড়চোখে- তারা যেন খবর রটাতে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। মেয়েটির বিষন্নতা সব ধুয়ে নেয়া দীঘির জলে তীব্র আলিঙ্গনের মতো হাসফাঁস করে। হিজলের মৌন মাছরাঙ্গা ঘাড় বাঁকা করে সে দৃশ্য দেখে। জল-মাকড়সাটা রণপায়ে তারে পথ ছেড়ে দেয়। ঢেউয়ের মাথায় চড়বে বলেই হেলেঞ্চা ঝোঁপ দুলে ওঠে। আর মেয়েটি নামতে থাকে গভীর থেকে গভীরে।

দূর থেকে কে যেন ডাকেন, 'বেনু, আবার পুকুর ঘাটে গেলি নাকি! আর কতবার বারন করলে ওখানে যাওয়া বন্ধ হবে তোর?'
৩৬টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×