মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে।।
এই অসামান্য গানটির সাথে আমার পরিচয় মায়ের মাধ্যমে। তিনি রান্না করার ফাঁকে অথবা কাজের অবসরে এই গানটি গুনগুন করে গাইতেন। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিরগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ক্যাসেটে এই গানটি বাজছে আর আমার মা তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখা ফ্রেমের মাঝে বাবার সাথে তাঁর যুগল ছবিটি মুছছেন। তখন যদিও খুব বেশি কিছু বুঝতাম না, তারপরও আমার কেন যেন ভীষন আনন্দ হতো।
এর বেশ কয়েক বছর পর স্কুল জীবনে যখন ছায়ানটে তবলা শিখতে গেলাম, তখন আবার এই গানটির সাথে আমার নতুন করে পরিচয় ঘটল। আমার মাঝেও গানটা ঢুকে পড়ল। সুযোগ পেলে আমিও গুন গুন করে এই গানটি গাইতাম। তবলা বাজানো কতটুকু শিখেছি জানি না তবে সেই সময়টাতেই এই 'ফিরোজা বেগমের' গানের সাথে আমার পরিচয়। নিউমার্কেটে গিয়ে খুঁজে খুঁজে কিনে ছিলাম তাঁর বেশ কিছু গানের ক্যাসেট। আহা! কি অদ্ভুত সুরেলা মায়াবী কন্ঠ। আমার কেন যেন মনে হয়, নজরুলের গানগুলো তাঁর গাওয়ার মাধ্যমেই আরো বেশি পূর্নতা লাভ করেছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর গাওয়া নজরুলের গান নিয়ে প্রথম রেকর্ড বের হয়। তাঁর কন্ঠে অনেক বৈচিত্রময়তা ছিল। নজরুল সংগীতের পাশাপাশি তিনি ইসলামিক গানও গেয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ভারতের বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁর গাওয়া ইসলামিক গানের রেকর্ড বের করে।
আজকে বাসায় ফেরার পথে শুনলাম, উপমহাদেশের এই কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই। খবরটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। হূমায়ূন আহমেদের মৃত্যূর পর এই আরেকটি মৃত্যূ আমাকে অসম্ভব কষ্ট দিল। আমাদের মাঝে একটি বিশাল শূন্যস্থান সৃষ্টি করে তিনি পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। প্রায় সাত দশক ধরে তিনি তাঁর কন্ঠে নজরুলের সুর আর বানী কন্ঠে ধারন করেছেন আর রাজত্ব করেছেন আমাদের অন্তরে। এমন শিল্পী হয়ত আমরা আর পাব না। আমাদের বর্তমান এবং আগের প্রজন্মের অনেকেই নজরুল সংগীত চিনেছে তার হাত ধরে। আমি কিছুটা হলেও হয়ত ভাগ্যবান তার গান সরাসরি শোনার সুযোগ পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই মহান শিল্পী তাঁর গানের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। সেই সাথে পরম করুনাময় মহান আল্লাহপাকের কাছে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁর গাওয়া আমার প্রিয় কিছু গানের লিরিক্স এবং ইউটিউব ভিডিওর লিংক এখানে যোগ করা হলো।
মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম
মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম
ছিলাম নদীর চরে
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে।।
তমাল তরু চাঁপা-লতার মত
জড়িয়ে কত জনম হ’ল গত
সেই বাঁধনের চিহ্ন আজো জাগে
জাগে হিয়ার থরে থরে।।
বাহুর ডোরে বেঁধে আজো ঘুমের ঘোরে যেন
ঝড়ের বন-লতার মত লুটিয়ে কাঁদ কেন
বনের কপোত কপোতাক্ষীর তীরে
পাখায় পাখায় বাঁধা ছিলাম নীড়ে
চিরতরে হ’ল ছাড়াছাড়ি
নিঠুর ব্যাধের শরে।।
আমায় নহে গো
আমায় নহে গো
ভালোবাস শুধু, ভালোবাস মোর গান
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে
গান হলে অবসান
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে
গীতশেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলিমাঝে
তুমি বুঝিবে না, বুঝিবে না,
আলো দিতে কত পুড়ে কত প্রদীপের প্রাণ।
যে কাঁটালতার আঁখিজল হায়
ফুল হয়ে ওঠে ফুটে
ফুল নিয়ে তার দিয়েছ কি কিছু
শূন্য পত্রপুটে?
সবাই তৃষ্ণা মেটায় নদীর জলে
কি তৃষা জাগে সে নদীর হিয়াতলে
বেদনার মহাসাগরের কাছে
করো করো সন্ধান।।
আমার গানের মালা
আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান।।
চোখে মলিন কাজল রেখা
কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা।
কপোলে যার অশ্রু রেখা
একা যাহার প্রাণ।।
শাখায় ছিল কাঁটার বেদন
মালায় সূচির জ্বালা।
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা।
বিরহে যার প্রেমারতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতী।
নাম না জানা সেই তপতী
তার তরে এই গান।।
আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর
আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর
কে সেই সুন্দর, কে?
আমি যার বিলাস যমুনা, বিরহ বিধুর
কে সেই সুন্দর, কে?
যাহার গলে আমি বনমালা
আমি যার কথার কুসুমডালা
না দেখা সুদূর
কে সেই সুন্দর, কে?
যার শিখীপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়?
আমি যার বরষার আনন্দ কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনীরেখা
যে মম অঙ্গের কাঁকন-কেয়ূর
কে সেই সুন্দর, কে?
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
নাচিছে ঘুর্ণিবায়
জল তরঙ্গে ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্
ঢেউ তুলে সে যায়।।
দীঘির বুকে শতদল দলি’
ঝরায়ে বকুল–চাঁপার কলি
চঞ্চল ঝরনার জল ছল ছলি
মাঠের পথে সে ধায়।।
বন–ফুল আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া
আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া
পাগলিনী নেচে যায় হেলিয়া দুলিয়া
ধূলি–ধূসর কায়।।
ইরানি বালিকা যেন মরু–চারিণী
পল্লীর–প্রান্তর–বনমনোহারিণী
আসে ধেয়ে সহসা গৈরিক বরণী
বালুকার উড়্নি গায়।।
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরী টিপ,
জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ,
মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই।।
তুমি আসিবে বলে সুদূর অতিথি
জাগে চাঁদের তৃষা লয়ে কৃষ্ণা তিথি,
কভু ঘরে আসি কভু বাহিরে চাই।।
আজি আকাশে বাতাসে কানাকানি,
জাগে বনে বনে নব ফুলের বাণী,
আজি আমার কথা যেন বলিতে পাই।।
দূর দ্বীপবাসীনি, চিনি তোমারে চিনি
দূর দ্বীপবাসীনি, চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরো দেশে, তুমি বিদেশীনিগো
সুমন্দভাসীনি।।
প্রশান্ত সাগরে তুফানেও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি অশান্ত রাগীনি।।
বাজাও কি বুণো সুর পাহাড়ী বাশীতে
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী হাসিতে।।
তব কবরী মূলে, নব এলাচীরো ফুল
দুলে কুসুম বিলাসিনী।।
আমি বনফুল গো
আমি বনফুল গো
ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে
আমি বনফুল গো
বাসন্তীকার কন্ঠে আমি
মালিকা দোদুল গো
বনের পরী আমার সনে
খেলতে আসে কুঞ্জবনে
ফুল ফোটানো গান গেয়ে যায়
পাপিয়া বুলবুল গো, আমি বনফুল
পথিক ভ্রমর শুধায় মোরে
সোনার মেয়ে নাম কি তোর
বলি ফুলের দেশের কন্যা আমি চম্পাবতী নামটি মোর
লতার কোলে চাঁদনীরাতে, বাসর জাগে চাঁদের সাথে
ভোরের বেলা নয়ন কোলে দোলে শিশির দুল গো
আমি বনফুল।
নুরজাহান নুরজাহান
নুরজাহান নুরজাহান
সিন্ধু নদীতে ভেসে
এলে মেঘলামতির দেশে
ইরানি গুলিস্তান ।।
নার্গিস লালা গোলাপ আঙ্গুর লতা
শিরি ফরহাদ শিরাজের উপকথা
এনেছিলে তুমি তনুর পিয়ালা ভরি
বুলবুলি দিলরুবা রবারের গান ।।
তব প্রেমে উন্মাদ ভুলিল সেলিম সে যে রাজাধিরাজ ,
চন্দন সম মাখিল অঙ্গে কলঙ্ক লোক লাজ ।
যে কলঙ্ক লয়ে হাসে চাঁদ নীলাকাশে
যাহা লেখা থাকে শুধু প্রেমিকের ইতিহাসে
দেবে চিরদিন নন্দন লোকচারী
তব সেই কলঙ্ক সে প্রেমের সম্মান ।
শাওনও রাতে যদি
শাওনও রাতে যদি,স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে।।
ভুলিও স্মৃতি মম,নিশীথ স্বপন-সম
আঁচলের গাঁথা মালা,ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে।।
ঝরিবে পুবালি বায়,গহনও দূর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে
বিরহি কুহু কেকা,গাহিবে নীপশাখে
যমুনা নদী পাড়ে,শুনিবে কে যেন ডাকে,
বিজলি দীপশিখা খুজিবে তোমায় প্রিয়া
দুহাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে
বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে...
এই কি গো শেষ দান
এই কি গো শেষ দান
এই কি গো শেষ দান
বিরহ দিয়ে গেলে
এই কি গো শেষ দান।
মোর আরো কথা, আরো কথা ছিলো বাকি
আরো প্রেম আরো গান।
ক্ষনিকের মালাখানি
তবে কেন দিয়েছিলে আনি
কেন হয়েছিলো শুরু
হবে যদি অবসান।
যে পথে গিয়াছো তুমি
আজ সেই পথে হায়
আমার ভুবন হতে বসন্ত চলে যায়।
হারানো দিনের লাগি
প্রেম তবু রহে জাগি
নয়নে দুলিয়া উঠে
হৃদয়ের অভিমান।
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।।
কুল- মখলুকে আজ ধ্বনি ওঠে,- কে এলো ঐ,
কলেমা শাহাদাতের বাণী ঠোঁটে,- কে এলো ঐ,
খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে, -কে এলো ঐ,
আকাশ গোহ তারা পড়ে লুটে- কে এলো ঐ,
পড়ে দরুদ ফেরেশতা, বেহেশতে সব দুয়ার খোলে।।
মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে জন,
“এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই”, কহিল যে জন,
মানুষের লাগি চির –দীন বেশ ধরিল যে জন,
বাদশাহ ফকিরের এক শামিল করিল যে জন,-
এল ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী,
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব- নিখিল মুক্তি- কলরোলে।।
আপাতত এই কয়টি গানের কথা উল্লেখ্য করলাম। এই গানগুলো আমার বেশ প্রিয়। আসলে ফিরোজা বেগমের মত একজন শিল্পীর গাওয়া গান থেকে পছন্দের গান নির্বাচন করা খুবই কঠিন একটি ব্যাপার। এই উল্লেখ্যকৃত গানগুলোর লিরিকস সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলা লিরিক্স ডট কম সহ আরো বেশ কিছু সাইট থেকে এবং ছবি গুলো সংগ্রহ করা হয়েছে গুগল ডট কম থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৯