সেদিন হঠাৎ করেই আল-খাফজি শহরে আমার অফিসের কাজ এসে গেল।এই শহরটা কুয়েতের সীমান্ত শহর এবং আল-খুবার থেকে ৩২০কিঃমিঃ দূরে।একাকী গাড়ী চালিয়ে যেতে যেতে আমার অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে গেল।
কিং আব্দুল আজিজ মসজিদ,খাফজী
সে প্রায় একযুগ হবে এই শহরেই আমার কোম্পানী কিং আব্দুল আজিজ জামে মসজিদের কাজ পেয়েছিল। অফিস থেকে আমাকেই ঐ কাজটা করার জন্য সিলেক্ট করলেন।আমি তখনও কারো সাথে ঘাট বাধিনি,কিন্তু অফিসে বললাম ঐ কাজে আমি যাবো যদি আমাকে ফ্যামিলি স্ট্যাটাস দেয়া হয়। বস আমার কথায় রাজি হলেন।
কিং আব্দুল আজিজ মসজিদ,খাফজী
আমিও চলে এলাম দেশে পাত্রী খুজে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে। ভাই বোনেরাও লেগে গেল পাত্রীর সন্ধ্যানে এবং গড়ে দিনে দুতিনটে করে কনে দেখালো আমাকে।ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে নিয়ে গিয়ে।এছারা মফস্থল শহরের আত্মীয়রাও কম গেলনা।মজার ব্যপার বাড়ীর কাজের বুয়ারাও ঘটকালি শুরু করেদিল!তারা খোজ এনেদিতো অমুক বাড়ীতে …আছে।যাক এভাবে আমার দু-একজন কনে পছন্দও হয়েছিল।কিন্তু আমি সৌদি আরবে কাজ করি শুনে অনেক কনের আত্মীয়রাই আবার পিছু হটেছিল।তাদের ধারনা ওখানে যারা কাজ করে তাদের বেতন খুব কম,ছোটখাট অড কাজ়ে তারা সৌদিতে মানবেতর অবস্থায় থাকে।তারা বছরের পর বছর বৌ-পোলাপান রেখে প্রবাসী জীবন অতিবাহিত করেন।ফলে বউয়ের মায়ের বাড়ী ও শশুরবাড়ির মধ্যে স্মৃস্টি হয় সম্পর্কের টানাপরন।আর তাই আমি অনেক কস্ট করেও তাদের অনেককেই বুঝাতে পারিনি যে আমার বৌ সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আমার আছে। কিন্তু তাই বলেতো আর বিয়ে আটকে থাকেনা !অবশেষে আমার মেয়ে পছন্দ হলো মেয়েরও আমাকে পছন্দ হয়ে গেল আর আমিও বিয়ে করতে পারলাম।তবে সৌদি আরবে এসে শুনেছিলাম আমার অফিসে দেশ থেকে কে বা কাহারা আমার বেতন,পজিশন ইত্যাদি সম্বন্ধ্যে ফোন করে জেনে নিয়েছিল!
যাইহোক আমি বিয়ের পর পরই কাবিননামা,আমার সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের আরবী তরজমা ও এভিডেবিট,সৌদি এম্ব্যাসির সত্যায়ন এবং বৌয়ের পাসপোর্ট করে ফেললাম। এরপর চুটিয়ে প্রেম করে নুতন বৌকে চোখের জলে ভাসিয়ে ছুটি শেষ করে চলে এলাম।
সৌদিতে এসেই লেগে গেলাম কিভাবে ফ্যামিলি ভিসা পাওয়া যায় তার পেছনে।তখন ফ্যামিলি নিয়ে আসা ছিল এদেশে আরেক সোনার হরিণের মতো!বাংলাদেশী ফ্যামিলির সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা।আমি সেইসব ফ্যামিলির নিকট গেলাম জানতে যে আমাকে কি কি করতে হবে এই ফ্যামিলি ভিজা পেতে হলে।তারা প্রায় সবাই আমাকে হতাশাজনক কাহিনী শুনালেন।কেউ বললেন ২০হাজার রিয়াল খরচ করে কেউবা আমিরের (গভর্নর) নিকট আবেদন করে আবার কেউ পাসপোর্ট প্রফেসন পরিবর্তন করে তবেই ভিসা পেয়েছেন!!
আমি একদিন খুব ভয়ে ভয়ে রেকি করার জন্যএস্তেকডামে (ভিসা অফিস) গেলাম।সেদিন শুধুমাত্র দেখে এলাম সেখানে কি কি করতে হয়।সেখান থেকে আমি দরখাস্ত ফরমও নিয়ে এসে ফিলআপ করে চেম্বারস অফ কমার্সের সত্যায়ন করলাম। তারপর সেই নিকাহনামা ও আমার সার্টিফিকেটের আরবী কপি ফাইলে ভরলাম।একদিন সকালে খুব সেজে গুজে এস্তেকডামে গিয়ে সিরিয়াল নাম্বার নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ জপতে লাগলাম। আমার নাম্বার ফ্লাস হতেই কাউন্টারে গিয়ে ছালাম দিয়ে দাড়ালাম। অফিসার আমার নাম জিজ্ঞেস করে আমার কাগজপত্র উলটে পালটে দেখে বললেন যাও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতার পেপারে সত্যায়ন করে নিয়ে আস। অফিসটা আমার জানা ছিল,সৌদি এম্ব্যাসির ঢাকার সত্যায়ন দেখে চোখ বুজে তারা সই করে দিল। তাই এক ঘন্টার মধ্যেই কাজ সেরে আমি ফিরে এসে ফাইলটা সেই অফিসারের হাতে দিতেই আমাকে একটা নাম্বার দিয়ে বললেন দিন চারেকের মধ্যে তোমার ফ্যামিলি ভিসা হাতে পাবে।কথা শুনে আমি তাকে শুকুরান জানিয়ে উড়তে উড়তে বাসায় চলে এলাম।তখনও মোবাইল চালু হয়নি তাই কল কেবিন থেকে ওকে এই সুখবরটা দিলাম।
এদিকে আমার এই দ্রুত ফ্যামিলি ভিসা পাওয়াটা তখন অনেককেই অবাক করেছিল।তবে আমার বিশ্বাস সঠিক কাগজপত্র,চাকুরীতে ভাল পদ এবং পাসপোর্টে ও আকামায় ভাল প্রফেসন থাকলে ভিসা পেতে বেগ পেতে হয়না।কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশী ভাইদের এই প্রফেসনে এসেই মার খেতে হতো।তখন ভাল প্রফেসনের ভিসা খুব কম বের হতো।এখন আর আগের অবস্থা নেই।ভাল প্রফেশন ছাড়াও ফ্যামিলি ভিসা বের করার অনেক পথ খুলে গিয়েছে।
খাফজী রোডে বেদুঈন তাবু
হাতে ভিসাটা পেয়েই দেশে পাঠিয়ে দিলাম আর আমি আল-খাফজী শহরে ফ্লাট ভাড়া নিলাম।খাফজী ছোট্ট একটা শহর,দশ মিনিট গাড়ী চালালেই শহর শেষ।দোকানপাট একদম বেদুইন টাইপ।এমনকি বাংলাদেশী পত্রপত্রিকা পেতে হলে আমাকে সদস্য হতে হবে আর সাপ্তাহিক খবর,দিনকাল জাতীয় তৃতীয় শ্রেনীর বস্তা-পচা ম্যাগাজিন ছাড়া ভাল কোন পত্রিকা নেই।তখনও এদেশে ডিস লাইন চালু হয়নি।এছাড়া ইন্টারনেটের যুগও শুরু হয়নি!মাত্র দুটি বাংলাদেশী পরিবার থাকেন সেখানে।বরিশালের একজন অন্যজন নারায়নগঞ্জের। আমি ভেবে পাচ্ছিলামনা ঢাকা শহরে বড় হওয়া মেয়েটি এসে এখানে টিকে থাকতে পারবে কিনা!
খাবজী রোডে বেদুঈনের দোকান
একদিন সত্যিই সে এসে গেল।দাহরান এয়ারপোর্টে সৌদিয়ার প্লেনটি দুপুর ২-৩০মিঃ মাটি স্পর্শ করতেই আনন্দে বুক ভরে গেল।কিছুক্ষন পরই কাস্টমস পুলিশের একজন আমার নাম ডাকতেই আমি এগিয়ে গেলাম।তিনি আমার আকামা নিয়ে ভেতরে চলে গেল এবং কিছুক্ষন পরই ওকে নিয়ে এসে আমার নিকট বুঝিয়ে দিলেন।আমি তাকে নিয়ে গাড়ীতে উঠালাম কিন্তু আমার স্থানীয় বন্ধু তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে তারাতারি খেয়ে দেয়ে খাফজীর পথে (৩২০কিঃমিঃ) রওয়ানা হলাম।বলা যায় সৌদি আরবে আমাদের যাত্রা হয়েছিল সুমধুর লংড্রাইবের মাধ্যমে।রাস্তার পাশে কোন গাও গেরাম নেই শুধু ধু ধু মরুভুমি। মাঝে মধ্যে বিশাল আয়তনের পেট্টোল পাম্প আর রাস্তার পাশে বেদুঈনদের ছোট্ট দোকান।তবে সত্যি বলতে কি সেদিন আমি ভয়ে কোন জায়গায়ই গাড়ী থামাইনি।একটানে আমার ফ্লাট এবং কাত।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



