somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছবিব্লগঃ জাহাজী জীবন-২

১৭ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



‘রাডারে কি চাঁদ দেখা যায়না?’ এই প্রশ্নটা যদি আমি বাইরের কারো কাছে শুনতাম তাইলে অবাক হইতাম না। কিন্তু স্বয়ং একজন মেরিনার যদি এই প্রশ্ন কইর‍্যা বসে তাইলে কি না কাইন্দা উপায় আছে? আমরা চায়নার ফেংচ্যাং পোর্ট থেকে সিঙ্গাপুরের দিকে আসছিলাম। কাল থেকে রোজা শুরু হইবো কি হইবো না সিওর না। আমরা ডেক অফিসাররা হলাম জাহাজের চাঁদ দেখা কমিটি। সন্ধ্যার পরে উপরোক্ত কোশ্চেন খানি কইরা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাকে কাইন্দাইয়া ছাড়িল। তবে আমি তার সামনে কান্তেও পার্লাম না হাসতেও পার্লাম না। বয়সে সিনিয়র। তাচ্ছিল্ল করতাছি ভাইব্যা দিলে কষ্ট পাইবার পারে।

ব্যাপারটা হল জাহাজে এ্যকচ্যুয়ালি ডিপার্টমেন্ট দুইটা। ডেক(নটিক্যাল) আর ইঞ্জিন। এই দুই ডিপার্টমেন্টের কাজ কর্ম পুরোটায় ভিন্ন। কোন ডেক অফিসারই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার না যদিও দেশে সবাই নিজেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বলেই পরিচয় দেয়, কারন মেরিন অফিসার বললে পাবলিকে খায় না। আবার জাহাজে একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার তার নামের সাথে অফিসার যোগ করে দেয়। ‘মেরিন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার’। আর ইলেক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যার কথা বললাম তিনি এই দুই ডিপার্টমেন্টের মাঝখানে অবস্থান করেন। তিনি ডেক অফিসার তো নয়ই আবার পুরোপুরি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারও নয়। তিনি হলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। জাহাজে ইনারা ‘বাত্তিসাব’ নামে আখ্যায়িত হন। সেই আদ্দিকাল থেকেই। তার কাজ জাহাজের যত বাত্তি আই মিন লাইট আছে সেগুলোর তদারকি করা। সেইজন্যইতার এই নাম। তবে আমার গত জাহাজের বাত্তিসাব কে কেউ যদি বাত্তিসাব বলতো তবে তার সাথে তিনি কথা বলতেন না। এজন্য চীফ ইঞ্জিনিয়ার তাকে ‘ইলেক’ বলে ডাকতো।



জাহাজের রাডার পিকচার। ব্লু বৃত্তের মধ্যে যে হলুদ ডট গুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো জাহাজের আশেপাশে অবস্থিত অন্য জাহাজের প্রতিচ্ছবি। রাডার স্ক্যানারের মাধ্যমে জাহাজ থেকে একটা বিশেষ ধরনের ‘রে’ (ray) ছড়িয়ে দেয়া হয় আশেপাশে। সেই ‘রে’ কোন অবজেক্টে আঘাত পেলে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। রাডার স্ক্যানার সে ফিরে আসা ‘রে’ টা ধরে ফেলে সাথে সাথে এবং রাডার স্ক্রীনে তার একটা ছবি তৈরি করে। এই প্রতিফলিত ছবিকে আমরা ইকো বলে। স্ক্যানারের এই রে ছুড়ে দেয়া এবং তা গ্রহণ করার প্রক্রিয়াটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। রাডারে এই সব ইকো অ্যানালাইসিস করে তার গতি প্রকৃতি জানার ফ্যাসিলিটি থাকে যার মাধ্যমে আমরা বুঝে থাকি আমাদের আশেপাশের কোন জাহাজের সাথে আমাদের সংঘর্ষের কোন সম্ভাবনা আছে কিনা। এই রে টা ম্যাক্সিমাম ছিয়ানব্বই মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তার স্ট্রেইনথ(Strength) কমে যায়। সাধারনত বারো থেকে চব্বিশ মাইলের মধ্যের ইকো গুলো ভালো ভাবে পাওয়া যায়। কাজেই বুঝতেই পারছেন রাডারে চাঁদ দেখা সম্ভবপর কিনা???



আমার ক্যামেরায় ধরা সত্যিকারের চাঁদ (লাল বৃত্তের মধ্যে)। কোন রাডার স্ক্রীনের ইকো না। যদিও দেখে মনে হল এই চাঁদের বয়স কখনোই এক দিন হইতে পারে না। কিন্তু আমরা ম্যাক্সিমাম টাইমেই সঠিক সময়ে রোজা শুরু করতে পারি না। আমরা মানে আমরা জাহাজীরা না। আমাদের দেশের সবার কথা বললাম। আমাদের দেশের চাঁদ দেখা কমিটির এই গড়বড়ের কারনে আমার কপালে একবার দুইটা ঈদ জুটছিল। মানে সেবার আমি কোন এক কারনে ঈদের আগে ইন্ডিয়া গেছিলাম(জাহাজ থেকে নয়)। ইন্ডিয়া থেকে আমি ঈদের দিন নামাজ পড়ে বিকেল বেলা দেশে ফেরত আসি। এসে শুনি আমাদের দেশে আগামী কাল ঈদ। সেই বছরে আমার তিনটা ঈদ হইছিল। মনে হয় আমি অনেক ভাগ্যবানই ছিলাম।



ক্রিসমাস ট্রি। জীবনে হয়তো অনেক ক্রিসমাস ট্রি দেখেছেন কিন্তু এইরাম ক্রিসমাস ট্রি কি দেখেছেন কখনো? আমার বিশ্বাস দেখেন নি। হ্যা এটাই জাহাজের ক্রিসমাস ট্রি। তবে বড়দিনের অনুষ্ঠানে সাজানোর জন্য এই ট্রি জাহাজে বসানো হয়নি। এটা জাহাজের মাষ্ট(Mast) বা মাস্তুল। এই মাস্তুলের নাম যে কিভাবে ক্রিসমাস ট্রি হল আল্লাহ মালুম। তবে এই লোহার তৈরি গাছে জাহাজের নেভিগেশন লাইট, রাডার স্ক্যানার বসানোর হয়। জাহাজের নেভিগেশন লাইট অনেক দূর থেকে দেখা যাবার জন্য এবং রাডারের ‘রে’ অনেক দুরে ছুড়ে দেবার জন্য এগুলো একটা উচু স্থানে বসানোর বসানোর লক্ষ্যে এই মাস্তুল তৈরি। এটা আমাদের ফ্লাগ(পতাকা) স্টান্ডও বটে। আমরা যখন কোন দেশে যাই তখন সেই দেশের পতাকা উঠাতে হয়। তবে বিভিন্ন উৎসবে আমরা কখনো কখনো অনেকগুলো পতাকা দিয়ে এই ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে থাকি।



এই ক্রিসমাস ট্রি টা যেখানে অবস্থিত সেটার নাম মাঙ্কি আইল্যান্ড। কি অবাক হইলেন? হওনেরই কথা। জাহাজে আছে একটা ক্রিসমাস গাছ সেটা আবার বান্দরের দ্বীপে অবস্থিত। ক্যামনে সম্ভব? আসলেই ব্যাপারটা বেশ রসিকতাপূর্ন। জাহাজের মাঙ্কি আইল্যান্ড হল সব থেকে উপরের ছাদ। সব একোমোডেশনের ওপরে থাকে ব্রীজ। আর মাঙ্কি আইল্যান্ড হইলো ব্রীজের ছাদ। তবে এইরকম নামকরনের হেতু আমার জানা নেই। হতে পারে রামায়ণের হনুমান সাহেব আসলে এক লাফে লঙ্কা যাননি। তিনি লাফিয়ে এসে পড়েন কোন এক জাহাজের ছাদে। তারপর আরাম করে এখানে বসে বসে কলা খাইতে খাইতে সমূদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন।
মাঙ্কি আইল্যান্ডে ক্রিসমাস ট্রি ছাড়াও জাহাজের সবধরনের এন্টেনা বসানো থাকে। সব ধরনের রেডিও যোগাযোগের এন্টেনা, GPS এর এন্টেনা ,স্যাটেলাইট টেলিফোনের এন্টেনা ছাড়াও এখানে থাকে জাহাজের ব্লাক বক্স, ম্যাগনেটিক কম্পাস আরো হাবিজাবি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মজার মজার নাম যখন বলতে শুরু করেছি তখন আর একটা জিনিসের নাম বা বললেই নয়। শুনে আবার টাস্কি খাইয়েন না। জাহাজে একটা কাকের বাসাও আছে। আর সব থেকে মজার কথা হল টাইটানিকের রোজ আর জ্যাকের খুব প্রিয় ছিল এই কাকের বাসা। তারা সুযোগ পেলেই বিলাস বহুল কেবিন ফেলে চলে আসতো এই কাকের বাসায়। এমনকি জাহাজটি যখন ডুবে যায় তখনও তার দুইজন হাত ধরাধরি করে এই কাকের বাসাই অবস্থান করছিল। কি কিছু বুঝতে পারছেন? নাকি মনে হচ্ছে আমি ভুল বকছি? না ভাই আমি ভুল বকছি না। আমি জাহাজী হইতে পারি কিন্তু বেতাল(মাতাল) না। বিশাস না হয় ছবিতে দেখুন।



ছবিতে যেটা দেখছেন সেটার নাম ক্রো নেষ্ট(Crow nest)। জাহাজের একেবারে সামনের যে জায়গায় আপনারা টাইটানিকের নায়ক নায়িকার দুই হাত প্রসারিত করে সমুদ্রের হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার সেই বিখ্যাত পোজ দেখেছেন এটি সেই জায়গা। যদিও এইখানে কখনো কোন কাকের বসবাসের উপযোগি কোন খড়কুটো নেই, কোন কাক এখানে কোনদিন বাসা বাধেনি তবু এটার নাম ক্রো নেষ্ট।

জাহাজী জীবনের প্রথম পর্বে আপনাদের ব্যাপক সাড়া পেয়ে কন্টিনিউ করার আগ্রহ পেয়েছি। সেজন্য আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ। নিজের কর্ম ক্ষেত্র নিয়ে লিখতে ভালো লাগছে। যদি সাহস দেন আর পাশে থাকেন তবে শুধুমাত্র জাহাজ পরিচিতি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন পোর্টে পোর্টে ঘোরার অভিজ্ঞতাগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪১
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×