somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০১০: একজন বার্গাস য়োসা

০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৯:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১৯৩৬ সালের ২৮ মার্চ পেরুর দক্ষিণাঞ্চলীয় আরেথিফা শহরে মারিও বার্গাস য়োসা জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রথম ১০ বছর তিনি মা ও নানা-নানীর সঙ্গে বলিভিয়ার কোচাকাম্বায় কাটান। য়োসার জন্মের আগেই তার বাবা-মা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। ১৯৪৬ সালে তারা আবার একসঙ্গে বসবাস শুরু করলে য়োসা পেরুতে ফিরে যান। তখন য়োসার পরিবার লিমার উপশহর ম্যাগদেলিনা দিল মার-এ বাস করতে শুরু করেন। ১৬ বছর বয়স থেকে য়োসা লিমার বিভিন্ন ট্যাবলয়েড পত্রিকায় মূলতঃ ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৫৮ সালে সান মার্কোস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২২ বছর বয়সে কয়েকটি গল্প নিয়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘লস কেফিস’ প্রকাশিত হয়।

এ সময় তিনি পেরু ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রী নেওয়ার জন্য ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৫৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় য়োসার ইউরোপ জীবন। সেখানেই তিনি রচনা করেন জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর বেশ কয়েকটি। দুই বছর মাদ্রিদে কাটিয়ে তিনি চলে যান প্যারিসে। সেখানে তিনি ফরাসি বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় য়োসা মাতৃভূমি নিয়ে চিন্তা করতে ও লিখতে শুরু করেন। জীবন অভিজ্ঞতা ও কল্পনা হয়ে ওঠে তার লেখক সত্তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। ছেলেবেলায় যখন তিনি প্রথম লিখতে শুরু করেন, তখন থেকেই স্বদেশের প্রতি ছিলো য়োসার ক্ষোভ মিশ্রিত তীব্র ভালোবাসা।

পেরুর সে দিনগুলো ছিলো বার্গাস য়োসা’র জীবনের চরমতম কষ্টের সময়। য়োসা ও তার বাবার মধ্যে ছিলো বৈরী সম্পর্ক। বাবা তার লেখালেখি একদম পচ্ছন্দ করতেন না। এ সম্পর্কে য়োসা নিজেই বলেন, “আমরা ছিলাম পরস্পরের বিরোধী এবং আমরা একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধা করতাম না।” তিনি আরো বলেন, “বলিভিয়ায় থাকতে আমার নানা-নানি ও মা লেখালেখির জন্য আমাকে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু আমি লেখি এটা জেনে আমার বাবা উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখালেন। লিমার ধনী ব্যক্তিরা তখন লেখালেখি ঘৃণা করতো। তারা মনে করতো এটা অলসদের সময় কাটানোর একটা অজুহাত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাজ।” লেখালেখির প্রতি প্রবল অনুরাগের কারণে তার পৌরুষ হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করতেন তাঁর বাবা। এ আশঙ্কায় বাবা বার্গাস য়োসাকে পাঠিয়ে দেন সামরিক নিয়মে পরিচালিত (ক্যাডেট কলেজ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লিওনসিও প্রাদোয়।

ঐ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বার্গাস য়োসা বলেন, “এটা ছিলো আমার জন্য নরকের সমান। জীবন যুদ্ধে ডারউনের তত্ত্বের কি মানে তা আমি বুঝেছিলাম।” আর এ লিওনসিও প্রাদোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাই য়োসার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টাইম অফ দ্য হিরো’র প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। উপন্যাসটি ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পেরুর সামরিক নেতারা এর তীব্র নিন্দা জানায় এবং তারা লিওনসিও প্রাদোর আঙ্গিনায় বইটির এক হাজার কপি পুড়িয়ে ফেলে। উপন্যাসটির স্টাইল ও গঠন শৈলীর অভিনবত্বে তা বেশ প্রশংসিত হয়। একটি সামরিক প্রতিষ্ঠানের নিষ্ঠুরতা এবং আনুষ্ঠানিক দুর্ণীতির বিষয়কে উপন্যাসটির মধ্যে তিনি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। উপন্যাসটির জন্য য়োসা ইউরোপের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন এবং এ উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি সমাজ সমালোচক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান।

বার্গাস য়োসা পরবর্তী উপন্যাস দুটি হচ্ছে, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রিন হাউস’ এবং ঐ একই বছর প্রকাশিত ‘কনভারসেশন ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’। দ্য গ্রিন হাউস উপন্যাসটি একটি বেশ্যালয়ের জাদুকরী কর্মকাণ্ড নিয়ে জাদু বাস্তবতার কাহিনী। আর দ্বিতীয় উপন্যাসটি ১৯৫০ এর দশকে স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল অর্দিয়ার সময়কালে পেরুর সমাজ জীবনের নৈতিক অবক্ষয়ের বর্ণনা। বইটির ছয় শ’ এক পৃষ্ঠা জুড়ে তিনি রূপায়িত করেছেন অবক্ষয়িত জীবনের শিল্পভাষ্য। পেরুর সমাজ ও রাজনীতির ভণ্ডামি ও দূর্নীতি নিয়ে তার পরবর্তী রচনাসমূহের ভিত্তি সৃষ্টি করে দেয় এ উপন্যাস দুইটি।

১৯৭৩ সালে বার্গাস য়োসার প্রথম হাস্যরসাত্মক উপন্যাস ‘ক্যাপটেইন পান্তোহা অ্যান্ড দ্য স্পেশাল সার্ভিস’ প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের কাহিনীতে দিসোলতি জঙ্গলের সামরিক ঘাঁটির এক কর্মকর্তা তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী সেনাদের সরবরাহের জন্য একদল পতিতাকে সংগঠিত করে। সামরিক বাহিনীর আমলাতন্ত্র ও অদক্ষতাকে য়োসা এ উপন্যাসে অসাধারণ হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছেন। এর চার বছর পর আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্ট রাইটার’। উপন্যাসটি তার প্রথম স্ত্রী আন্ট জুলিয়া ও তাঁর বিয়ের কাহিনীর শৈল্পিক রূপায়ন। জুলিয়া ছিলেন য়োসার দশ বছরের বড়। উপন্যাসে মারিও নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ ও তার সহকর্মী এবং বন্ধুদের নানা ধরনের অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের বর্ণনা আছে। এখানে পেদ্রো কামাচো নামের একটি চরিত্র সোপ অপেরার গল্প লেখক। প্রতিদিন প্রেম, বিরহ ও পাওয়া-না পাওয়ার কাহিনী লিখতে লিখতে এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে চরিত্রটি।

বৈচিত্র্যময় চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলা য়োসার স্বাতন্ত্র্য। এবং তার পরবর্তী দুটি উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯৮১) এবং ‘দ্য রিয়েল লাইফ অফ আলেহান্দ্রো মাইতা’র (১৯৮৪) গঠন শৈলীর বিবেচনায়ও সমালোচকরা একথাই বলেন। ১৯৮৬ সালে বার্গাস য়োসা থ্রিলার লেখা শুরু করেন। তিনি লেখেন ‘হু কিলড পালোমিনো মোলেরো?’ বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণের প্রয়োগে গল্প বলার রীতিতে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্য স্টোরিটেলার’ উপন্যাসটি।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ভিন্নধর্মী উপন্যাস ‘এলিহিও দে লা মাদ্রাস্ত্রা’। ১৯৯০ সালে উপন্যাসটির ইংরেজি অসুবাদ বের হয় ‘ইন প্রেইজ অফ দ্য স্টেপ মাদার’ নামে। এখানে সৎ মায়ের প্রতি ছেলেটির যৌন ফ্যান্টাসি তুলে ধরেছেন য়োসা। তিনি এ উপন্যাসের ঘটনাকে ‘বৈচিত্র্য’ বলে বর্ণনা করেছেন।

১৯৯০ সালে বার্গাস য়োসা পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আলবের্তো ফুহিমোরির কাছে পরাজিত হন। রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ১৯৯৪ সালে রচনা করেন ‘টেল অফ অ্যা স্যাকরিফিসিয়াল লিয়ামা’।

১৯৯৭ সালে তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্য নোটবুকস অফ ডন রিগোবার্তো’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের প্রথম মাসে উপন্যাসটির আড়াই লাখ কপি বিক্রি হয়। আর সেগুলোর মধ্যে কেবল লাতিন আমেরিকায়ই হয় এক লাখ কপি।

সুইডিশ একাডেমি মারিও বার্গাস য়োসা’কে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, “his cartography of structures of power and his trenchant images of the individual’s resistance, revolt, and defeat”-এর কথা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৯:১৪
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×