উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাংলা এবং বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য এবং শিল্পের জগতে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বিপুলায়তন সাহিত্য এবং শিল্পকর্মের গভীরতা এত বেশি যে সর্ববিষয়ের সঠিক মূল্যায়ন, অন্তর্ধানের প্রায় পচাত্তর বছর পরেও সম্ভব হয় নি। আজকের পোস্টের আলোচ্য বিষয় রবীন্দ্র চিত্রকলা। রবীন্দ্র চিত্রকলার নানামাত্রিকতা এবং রেখায় রঙে তিনি যে আধুনিকতার সূচনা করেছেন ভারতবর্ষের চিত্র জগতে সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে।
চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ
এ কথা মোটামুটি প্রচলিত যে, রবীন্দ্রনাথ আঁকার কাজে হাত দেন একেবারেই পরিণত অর্থাৎ প্রৌঢ় বয়সে। প্রধানত পান্ডুলিপিতে কাঁটাকুঁটি ঢেকে দেবার জন্য উদ্দেশ্যহীন আঁকা আঁকি থেকে রেখায় রেখায় মেলবন্ধন থেকে রবিকবির চিত্রশিল্প চর্চার শুরু।
চিত্রকলার জগতে সচ্ছন্দ বিচরণ এবং ড্রয়িং এর সমালোচনামূলক মূল্যায়নে তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয় বেশ দেরিতে- জীবনের মোটামুটি শেষ সতের বছরে। রবীন্দ্রমানষে চিত্রকলার উন্মেষ কখন ঘটে এই প্রশ্নের সদৃত্তর পাওয়া কিছুটা দুষ্কর বৈকি! কারণ রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থে কবে থেকে আর্টের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেটা অত পাকাপোক্ত ভাবে জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন তিনি প্রথম জীবনে চিত্রশিল্পের চর্চায় মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষিতীশ রায় উল্লেখ করেন তিনি রবি ঠাকুরের কিছু ড্রয়িং দেখেছেন। যদিও রবিঠাকুর নিজেই আমার ছবি নামক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন,
(ষোল বছর বয়সে) ... ততদিনে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ঐতিহ্য মেনে আধুনিক শিল্প আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। ততদিনে আমার সম্পূর্ণ বোঝা হয়ে গিয়েছে যে শব্দের আঁটোসাঁটো চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার ছাড়পত্র ভাগ্য আমাকে মঞ্জুর করেনি।
----------------- (আমার ছবি) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আবার ১৮৯৩ সালে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রা ইন্দিরা দেবীকে এক চিঠিতে চিত্রশিল্প বিষয়ক আকাঙ্খার কথা জানান, যদিও তখন তিনি ছিলেন প্রায় ৩২ বছর বয়স্ক এবং কবি সমাজে তিনি ততদিনেই মোটামুটি উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত।
আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা চলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারিবারিক শিক্ষাসূত্রে চিত্রকলা এবং আধুনিক চিত্রজগতের বৈচিত্র্যময়তার স্বাদ পেলেও চিত্রকর্ম বিষয়টি সেই রূপে চর্চা করেননি। সর্বোতভাবে চিত্রশিল্পের প্রতি ঝোক দেখা যায় বিশের দশকের শেষের দিকে। চিত্র সমালোচক প্রতিভা ঠাকুর বলেন,
১৯২৭ সালের দিকে গুরুদেব তুলি ও কলমে আকার কাজ শুরু করেন। পরে পাণ্ডলিপি সংশোধনের অছিলায় তিনি তাতে ডিজাইন বা নক্সা আঁকা শুরু করেন, যেটা আজ সুধীমহলে সুপরিচিত।
--------------------- গুরুদেবের চিত্রকর্ম
রবীন্দ্র চিত্রকলার পরিনয় এবং গন্তব্য বুঝতে হলে আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে এই সময়টির দিকে। রবীন্দ্রমানষের এক নতুন বোধনের উন্মেষপর্ব এ সময়টি। অন্যান্য সৃষ্টি মাধ্যমে ইতোমধ্যেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত তিনি। বিশ্বসাহিত্য এবং চিত্রকলার জগতে চলছিল ভাঙাগড়ার নিদারূণ খেলা। চিত্র শিল্পের প্রকৃতি কী- তার প্রেরণা, উদ্দেশ্য, ধ্যাণ ধারণা এমনকি তাকে হৃদয়ঙ্গম করার প্রক্রিয়া- সর্বক্ষেত্রেই প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে অস্বীকার করা হচ্ছিল। বাস্তবতার প্রতি নিষ্ঠা আর আস্থায় চিড় ধরল। আবির্ভাব ঘটল নানা বিকল্প কল্পরূপের, যা শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে উৎসরিত।
বিশ্বযুদ্ধত্তর সময়ে সাহিত্য এবং চিত্রকলার এই যে ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্য এবং আধুনিকতার খোলসবদল, এটা কবি মানষে এনেছিল নতুন এক বোধ, নতুন এক ভাবনা। তাইত আমরা দেখতে পাই পূর্বপরিকল্পিত ধ্যান ধারনা এবং শিক্ষাকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ আঁকতে শুরু করেন। যেন অজানা সাগরে পাড়ি দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। তার শিল্পকীর্তির অন্যসব শাখায় আমরা দেখি, তার সৃষ্টিশীলতা বাস্তব থেকে তার প্রতিফলণ অর্থাৎ বাস্তবকে বিশেষণ, পুননির্মান বা পুনমূল্যায়নের মাধ্যমে সৃষ্টকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন (প্রায় সকল ক্ষেত্রেই )। কিন্তু চিত্রশিল্পে ঘটেছে উল্টোটা।ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আঁকিবুঁকির মধ্যে থেকে দৈবক্রমে লব্ধ সৃষ্টকে বাস্তবতায় আনতে চেয়েছেন রেখায় রঙে।
রবিঠাকুর আঁকতে শুরু করলেন মনের আনন্দ মিশিয়ে। নির্ঝরের স্বপ্ন যেন অবশেষে ভঙ্গ হল। রুধিয়া রাখা আবেগের ধারা ঝরঝর করে ঝরতে শুরু করল। জীবনের শেষ সতেরটি বছর তিনি একে গেছেন দু হাতে। এই সময়ে তিনি প্রায় ২০০০ এর অধিক ছবি আঁকেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ একে ( রবিঠাকুরের আঁকা ) তুলনা করেছেন আগ্নেয়গিরির অগ্লুৎপাতের সাথে। প্রায় দিনেই তিনি চার পাঁচটি ছবি একে শেষ করতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই ব্যবহার করতেন- ভাঙা কলম পেন্সিল, ফেলনা কাগজ-সব। তিনি প্রধানত ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। বলাবাহুল্য আকার কাজে তিনি নির্ভর করেন সহজাত শিল্প প্রবৃত্তি এবং শিল্প চেতনার উপর। প্রয়োজনীয় অঙ্কন দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা তিনি করেননি।
এই প্রসঙ্গে রানী চন্দকে করা কবিগুরুর উক্তি স্মরণ করা যাক,
তুমি জান আমি চিত্রশিল্পী নই। যাই আকি না জেনেশুনেই আকি। ভেবেচিন্তে আঁকা বা কোন সুনির্দিষ্ট রূপ দেবার অভিপ্রায়ে সচেতন ভাবে আঁকা, আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার কাজে নানান ইতস্তত আঁকাআঁকি থেকে কোন এক পর্যায়ে একটা অবয়ব রূপ ধারণ করে। এমন লোককে কি শিল্পী বলা চলে? নিশ্চয়ই বলা চলে, যদি এই কথা আমরা মনে রাখি যে এই শিল্পী কোন রকম খোঁজ ছাড়াই পাওয়ার আশায় আঁকেন, ফলে তাঁর প্রাপ্তিতে ভালমন্দের বেশ বড়ো হেরফের রয়েছে।
রবীন্দ্র চিত্রকলা ও আধুনিকতা
রবীন্দ্র চিত্রকলার সবচাইতে প্রধান বৈশিষ্ট্য যেটা লক্ষ্যনীয় সেটা হল তদানীন্তন ভারতবর্ষের চিত্রকলার হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে উপমহাদেশের চিত্রজগতে নতুন এক ধারার সৃষ্টি। এ কাজটি রবিবাবু করেছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন থেকে এবং শিল্পের আধুনিকায়নের বিষয়ে বিশ্বস্ত থেকে। তাঁর আঁকার ভঙ্গি প্রসঙ্গে প্রতিমা ঠাকুর বলেন,
" তাঁর আঁকার ভঙ্গিটি সম্পূর্ণ নিজস্ব ছিল, তিনি স্বদেশি বা বিদেশি কোন অঙ্কন পদ্ধতি অনুসরণ করতেন না।"
রবীন্দ্রনাথে ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ লাভের পরে মোটামুটি সারা বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেন। এই সময়ের বিশ্বভ্রমণ এবং বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের অগ্রপথিক দেশ গুলোর সাহিত্য এবং শিল্প আন্দোলনের ভাবধারা এবং বিকাশ তাঁর মানষে গভীর রেখাপাত করে। ইউরোপের রেনেঁসা প্রসূত বিজ্ঞান চেতনা, মানবতাবাদ, কিউবিজম, ফভিজম, ফিউচারিজম, সুরিয়্যালিজমের চেতনা চিত্র জগতকে যে নাড়া দিয়েছিল এবং সূচনা করেছিল পরাবাস্তবতার, তার ফলশ্রুতি আমরা দেখতে পাই রবিচিত্রে। ভারতীয় মিথ ভিত্তিক এবং মুঘল চিত্রকলার সুদীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে রবি ঠাকুর আসেন নিজের মত করে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রচ্ছন্ন অবদান অস্বীকার করা যায় না।
তাঁর বিশ্ব ভ্রমনের উল্লেখযোগ্য একটি পর্যায় ছিল জাপান ভ্রমন। ১৯১৬ সালে সেখানে চলমান শিল্প আন্দোলন বিষয়ে অবহিত হন। জাপানি চিত্রশিল্পীদের উদাহরণ দিয়ে ভারতীয় শিল্পীদের আবেদন জানিয়ে চিঠি লেখেন। তিনি সাথে করে কিছু চিত্রকর্ম তৈরি করিয়ে আনেন যা এখন বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় আছে। এ সময়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিল্পী সাহিত্যের গোষ্ঠী-বিচিত্রা ক্লাব। তার আশা ছিল এই এ গোষ্ঠী ভারতীয় সাহিত্য এবং চিত্র কলার এক নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটাবে। তবে তার এ আশা পূর্ণ হয়নি। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে আধুনিক চিত্রকলা চর্চার একটি পীঠস্থান। এ থেকে ধারণা করা যায় যখন তিনি আঁকতে শুরু করেননি তখনও তিনি তথাকথিত পেশাদারি চিত্রশিল্পজগতের প্রয়োজন এবং আয়তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা সম্পর্কে আমরা যদি একটু পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরি তে চোখ বুলাই তবে ভাল হয়,
.... আর্টিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর্টের সাধনা কী? আর্টের একটা বাইরের দিক আছে সেটা হচ্ছে আঙ্গিক, টেকনিক, তার কথা বলতে পারি নে। কিন্তু ভেতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তাহলে সমস্ত সত্বা দিয়ে দিয়ে দেখো, দেখো, দেখো।... দেখতে পাওয়া মানে প্রকাশকে পাওয়া। বিশ্বের প্রকাশকে মন দিয়ে গ্রহন করাই হচ্ছে আর্টিস্টের সাধনা।
মোট কথা তিনি প্রকাশ করেছেন এই যে, আমাদের চোখ দিয়ে যা দেখছি তাকে আমরা কোন আঙ্গিকে, কোন প্রকাশভঙ্গিতে প্রকাশ করব, সেইটাই শিল্পীর মূল সাধনা। আর শিল্প হল আমাদের প্রকাশ। ভারতীয় চিত্রকলার তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটাই রবিকবির বিশিষ্টতা। বহুকাল ধরে ভারতীয় চিত্রকলা ছিল বর্ণনাত্নক, চিত্রে ধর্মীয়, পৌরাণিক-ঐতিহাসিক আখ্যানের প্রাধান্য বা বর্ননাই ছিল চিত্রকলার প্রধান কাজ। সে ছিল ইলাস্ট্রেশন ধর্মী। তার স্বাধীনতা ধর্ম, পুরাণ বা ইতিহাসের কাছে যেন বন্ধক রাখা ছিল। তৎকালীন ইউরোপীয় শিল্পীরা যারা এ অঞ্চলে চিত্রকলার চর্চায় ছিলেন তাদের চর্চাতে এ বন্ধন ঘোঁচেনি বরং সামান্য রঙ বদল ঘটেছে। রবিঠাকুর এখানেই অনন্য। ভারতীয় চিত্রকলায় নবরূপ দিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
রবীন্দ্র চিত্রকলার সাধারণ বিভাগ
মোটা দাগে রবীন্দ্র চিত্রকলাকে তিনশ্রেনীতে ভাগ করা যায়। প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্র, মানব দেহের চিত্র আর পাখি এবং জীবজন্তুর চিত্র। যদিও এই শ্রেনীকরণ দ্বারা রবীন্দ্র চিত্রকলার ব্যাপকতাকে ধারণ করা যায় না তথাপি মোটামুটি সরলীকরণের সুবিধার্থে করা।
প্রথমে আলোচনা করা যাক মানব দেহের চিত্রাবলী নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রচুর প্রোট্রেট সহ বহু
প্রোট্রেট ধর্মী কাজ করেছেন ।
এসব চিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই চেনা মুখ ছায়ার আড়ালে কেমন যেন আড়ষ্ট একটা অন্যরকম রূপ নিচ্ছে। তার অনেক কিছু বলবার আছে। ভীষণ রকম এক্সপ্রেসিভ কিন্তু বিষণ্ণ কিছু মানব মানবীর ছবি একেছেন রবিঠাকুর।
এসব ছবি আমাদের নিয়ত ভাঙাগড়ার এক আশ্চর্য উপলব্ধির মাথে এনে দাড় করিয়ে দেয়। এ সব চিত্র অঙ্কনে প্রধানত রেখাচিত্রের প্রাধান্য দেখা গেলেও সুস্পষ্ট কোন নিয়ম বা রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দেখা যায় না। ফলশ্রুতিতে ছবিগুলো হয়ে উঠেছে অনেক বেশি ধোয়াশা পূর্ণ। যেন অঙ্কিত মানব মূর্তি গুলি নীরব অথচ চঞ্চল, অংশ নিচ্ছে মুকাভিনয়ে। এসব ছবি আমাদের আবিষ্ট করে বোধ হয় এ কারণেই।
এবারে আসি তাঁর জীবজন্তু এবং পাখি বিষয়ক চিত্র কলায়। শুরুর দিকে তাঁর জীবজন্তুরা যেন ছিল এক অন্ধ লোকের বাসিন্দা। শরীরের নাড়াচাড়া ছিল অবিন্যস্ত থাকলেও প্রানসঞ্চারী অনুভূতিটা ছিল অটুট। তার আকা বাঘের ছবিতে দেখতে পাই অদ্ভুত এক হিংস্র লিপ্সায় আক্রান্ত বাঘ যা বাস্তবতা বা আকার আকৃতি গত দিকটা মুখ্য না হয়ে প্রকৃতিতে মুখ্য হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। প্রানীজ চিত্রকলায় গতিময়তার বিষয়টি বাঙ্ময় হয়ে উঠেচে অতি সুচারুরূপে।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ পশুপাখির ছবিতে তাদের আকার আকৃতিগত দিকটি আমাদের চেনা জানা পরিচিত জগতের সাথে মেলে না বরং মনে হয় এটা একান্তই কবিমানষের ব্যক্তিগত ভুবন থেকে বের হয়েছে। যারা প্রথাবদ্ধতার পথেই আস্থা রাখেন তাদের উদ্দেশ্য কবির বক্তব্য,
" লোকে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার ছবির মানে কি। ছবির সাথে সাথে আমিও নীরব থাকি। ছবির কাজ প্রকাশ করা, ব্যাখ্যা করা নয়"
রবীন্দ্র চিত্রকলার একটি উল্লেখ যোগ্য দিক ছিল রেখাচিত্র। কালি এবং কলমে আকা বেশি কিছু লিনিয়ার রেখার খেলাতে ফুটে উঠেছে বেশ কিছু চিত্রকর্ম। এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন,
"আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করি আমার আক রেখাগুলো নানান ছন্দ:স্পন্দে পরস্পর যুক্ত হয়ে প্রাণ পায়,তাদের স্বভাব তৈরি হয় আর তারা নানান আকারে ইঙ্গিতে পরস্পরের সাথে কথা কয়"
রবীন্দ্র চিত্রকলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রঙের ব্যবহার। চিত্রকলার অনুরাগী এবং নিবিষ্ট দর্শক একটু ভাল ভাব খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন তার কাজে সবুজ এবং নীল লক্ষনীয় অনুপস্থিতি এবং গাঢ় খয়েরী, বা কালচে খয়েরী রঙের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ তার দৃষ্টির অস্বাভাবিকতাকে দায়ী করেছেন। ব্রিটিশ জার্নাল অভ অ্যাস্থেটিক্স এর ১৯৮৭ সালের এক সংখ্যায় লেখা হয় রবীন্দ্রনাথ প্রোটোন্যাপ ছিলেন। তিনি নীল আর বেগুনি রং দেখার সময় লাল রঙের সাথে গাঢ় খয়েরি বা কালো রং এর সাথে গুলিয়ে ফেলতেন। এই বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি না হলেও এর কিছুটা সত্যতা বিদ্যমান তা রবি চিত্রকলার প্রকাশ দেখলে মোটামুটি বুঝতে পারা যায়।
রবীন্দ্র চিত্রকলা প্রদর্শনী এবং সমালোচনা :
রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে তার চিত্রকর্ম নিয়ে বেশ শঙ্কিত ছিলেন। অঙ্কণশিল্পে তাঁর প্রথাগত দখল ছিল না বলেই তিনি এক ধরণের সঙ্কোচে ভুগতেন। এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য শোনা যাক,
"আমি জানি আমি লিখতে পারি, ঐ ক্ষেত্রে আমি আমার ক্ষমতা সম্বন্ধে নি:সন্দেহ, কিন্তু ছবি আঁকার ব্যাপারে কিছুতেই আমি সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। আসলে আমি নন্দলাল বা অবনীন্দ্রনাথের মতো আঁকা শিখিনি তো, তাই প্রায়ই আমার মনে হয় এ আমার শিল্পসৃষ্টির পথ নয়।"
১৯৩০ সালে ফ্রান্সের গ্যালারি পিগ্যাল ( Gallarie pigalle ) চিত্রপ্রদর্শণীতে তার চিত্রকলা প্রশংসিত হয়। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক এবং সমালোচক পল ভ্যালোরি, আদ্রে জিদ প্রমুখ বলেন,
"আমাদের সময়ের বিভিন্ন চিত্র আন্দোলনগুলো কী করতে চেষ্টা করছে, সে বিষয়ে আমরা সবেমাত্র যা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি, আপনি এতটা অনায়াসে কি করে তা আমাদের দৃষ্টির সামনে নিয়ে এলেন?"
এর পরে জার্মানি এবং লন্ডনে তাঁর চিত্রকলা ব্যাপক প্রশংসা এবং সমালোচকদের সুদৃষ্টি লাভ করতে সমর্থ হয়। এইখানে লক্ষ্যনীয় ফ্রান্সে তাঁর আঁকা জীবজন্তু এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জার্মানিতে তাঁর মনুষ্য চেহারার চিত্র্য বেশি প্রশংসা লাভ করে। মস্কোতে তাকে একজন বড়ো মাপের চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এতে চিত্রশিল্পী হিসেবে কবির আত্মবিশ্বাসের পারদটি বেশ উঁচুতে উঠে এবং যুক্তরাষ্ট্রে যখন তার চিত্র প্রদর্শণী হয় তখন তিনি সেখানে একথা বলতে দ্বিধা বোধ করেননি যে তিনি একজন দার্শনিক বা মহান কবি হিসেবে নয়, চিত্র শিল্পী হিসেবেই এসেছেন। তথাপি মার্কিন মুলুকে রবিকবির ছবি তেমন একটা প্রশংসা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এর পরে ১৯৩৮ সালে লন্ডন ছাড়া জীবদ্দশায় আর তার ছবির পাশ্চাত্যে কোন প্রদর্শণী হয় নি।
ইউরোপীয় চিত্রজগতে রবীন্দ্রনাথ আলোচিত হলেও এবং ইউরোপের বাইরে পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের চিত্রজগতে রবীন্দ্র চিত্রাবলীর আবেদন ছিল মিশ্র। মূলত পাশ্চাত্যের চিত্রকলায় রৈখিক অঙ্কন শৈলীর উপর অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে যেদিকটাতে কবিগুরু অত বেশি শুদ্ধ ছিলেন না।
সমালোচক কেইন্স স্মিথ লেখেন
রবীন্দ্রনাথের ড্রয়িং এর বিচারে চিত্রশিল্প সমালোচনার স্বাভাবিক মানদন্ড ব্যবহার করা অসম্ভব। এই ড্রয়িংগুচ্ছ দেখে ভারি আনন্দ হয়, তথাপি একথা সত্য রূপসৃষ্টির যে বীজ থেকে চিত্রশিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটা নেহায়েতই কাকতালীয় ভাবে লব্ধ।
রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীর একশত পচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৮৬ সালে লণ্ডনে বার্বিকান গ্যালারিতে রবীন্দ্র চিত্রকলার একটি বিশাল প্রদর্শনী হয়। এ প্রদর্শনী উপলক্ষে পত্রিকায় সমালোচনা বের হয়।
* সান্ডে টাইমস পত্রিকায় তার কবিতাকে "মরমী সত্তা সম্বন্ধে একধরণের বিবরণ" বলে প্রশংসা করা হলেও চিত্রকলা সম্বন্ধে বলা হয় অতিসরল শিশুসুলভ ড্রয়িং।
* স্প্রেক্টেটর পত্রিকায় জাইলাস জাডি আবার এসকল কাজের বেশ প্রশংসা করেন এবং তার কাজকে আলফ্রেড ওয়ালিশ, এ্যাডভার্ড মাঞ্চ,, স্যামুয়েল পামার এর সাথে তুলনা করেন।
* অক্সফোর্ডের মিউজিয়াম অভ মর্ডান আর্ট এর পক্ষ থেকে বলা হয়
শিল্পী হিসেবে তিনি খুব গুনী নন-বড্ড বেশি ভাবলেশহীনমুখ, অবিন্যস্ত অবয়ব, অতি কারুকার্যময় কালির কাজ- কাজ দেখে আগ্রহ জাগে, কিছু কাজ অসাধারণ। কিন্তু অল্প কিছু শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেই যেখানে কাজ সারা যেত, সেখানে ১২৪ টা শিল্পকর্ম প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয়।
* চিত্রকর্মের কট্টর সমালোচনা করেছেন ব্রায়ান সুওয়েল। তিনি স্টাটার্ন্ড পত্রিকায় লেখেন, তার চিত্র দুর্বোধ্য, পরিশীলিত নয়। তার মতে রবীন্দ্রনাথ এক বিরক্তি উদ্রেককারী বৃদ্ধ, যিনি সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন এবং নানা মানুষের চিত্র আর ড্রয়িং থেকে ভাব চুরি করে বৃদ্ধ বয়সে চর্বিতচর্বন পরিবেশন করেছেন। ছবিগুলো অতি নিকৃষ্টমানের।
* চিত্র সমালোচক টিমোথি হাইমেন এবং অ্যান্ডু রবিনসন রবি চিত্রকলা নিয়ে বিস্তারিত বই লেখেন এবং বেশ প্রশংসা করেন।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়া রবি চিত্রের বিষয়ে বেশ দোদুল্যমান ছিল। তবে প্রথম দিকে পাশ্চাত্য থেকে তিনি যে ইতিবাচক সমালোচনা লাভ করেছিলেন তাই তাঁকে চিত্রকর হিসেবে নিজেকে প্রকাশের একটি পথ খুলে দেয়। কারণ তখন অব্ধি তাঁর চিত্র কলার অগ্রসর ধারণা ভারত বর্ষে গৃহীত হয় নি। পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি চিত্রকলার চর্চা অব্যাহত রাখেন।
রবীন্দ্র চিত্রকলা বিগত আশি নব্বই বছরে আমাদের সামনে নানা মাত্রায় ধরা দিয়েছে এটা মোটামুটি স্বীকৃত। ভারতীয় চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ ডাব্লিউ বি আর্চার, অমৃতা শেরগিল এবং যামিনী রায়ের সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথকেও আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার পথিকৃৎ বলে চিহ্ণিত করেছেন। তার মতে শিল্পী তাঁর অবচেতন অনুভব থেকে মশলা জোগাড় করেছেন এবং শিল্পকে ক্রমাগত নতুন রূপ দিয়ে গেছেন। লেখাটি শেষ করছি সরসীলাল সরকারকে লিখিত একটা পত্রের উদ্ধৃতি থেকে-
"ছবির কথা কিছুই বুঝিনে। ওগুলো স্বপ্নের ঝাক, ওদের ঝোক রঙিন নৃত্যে। এই রূপের জগৎ বিধাতার স্বপ্ন- রঙে রেখায় নানাখানা হয়ে ফুলে উঠচে।... অজানার স্বপ্ন উৎসব থেকে বিচিত্র রূপে উৎসারিত- এ সম্বন্ধে বিশ্বকর্মার কোন কৈফিয়ত নেই।"
উৎসর্গ : যার সঙ্গে প্রচুর অম্ল মধুর বাক্য বিনিময় হয়েছে সেই শায়মা আপুমনিকে। ব্লগেরব্লগের একজন পরিপূর্ণ শিল্পী সে। তার সাফল্য কামনা করি।
বি.দ্র : রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক একটি ফ্যান পেজ Man the Artist-Rabindranath
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




