somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নৈঃশব্দ্যের ভাঁজে ভাঁজে

২২ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
স্টাডি ট্যুর। বান্দরবানের বিভ্রম অরণ্যে। বিভ্রম আমার চোখে। আমাদের জোছনা বিহারের কোন প্রিপ্ল্যান ছিলনা। আকস্মিক হয়ে গেছে। আমাদের ফেরার পথে কোথাও রাস্তায় হাঙ্গামা হয়েছে। তাই রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। মোটা বড় বড় গাছ এনে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে বিক্ষোভকারীরা। আজকে ফেরার উপায় নেই। সিদ্ধান্ত হলো আজকের বোনাস ডে-তে রাতে পূর্ণিমায় জোছনা স্নান হবে। গহীন অরন্যে। সবাই হুররে...বলে একবাক্যে রাজি হল।

২.
তার নাম নীলিম। তার চোখে আমার স্বপ্নগুলো রঙিন গোলক ধাঁধাঁর মায়া জড়িয়ে আছে। গোধূলীর বিপন্ন আলোতে যার প্রতীক্ষায় কেটে যায় বহু প্রহর। আমি তাকে পাইনা। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় আমি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি। সেখানে কত দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে, রাত নামে । তার আগে থাকে গোধূলী। আমার সময়ের কোন পর্যায় নেই। শুধুই রাত। ভাবনা প্রহরে বাসনাগুলো চুপে চুপে কাঁদে। সে কখনো ফিরে দেখেনা। কোন বিস্মিত বিমোহিত মুর্হুতে ভুল করে হাতে হাত পড়েনা। দৃষ্টির কটাক্ষে শুধু অর্ন্তজ্বালা বাড়ায়। কোন বিমুগ্ধ রাতে জেগে জেগে কখনো খোলা জানালার ওপাশে ফুলের ঘ্রাণ হয়ে সে আসে। আমি ভাবনার অতলে হারাই। সে হারায়না।

৩.
তরুন-তরুনীদের মাঝে ভীষণ উল্লাস। আকস্মিক সুযোগ প্রাপ্তি। এমন করে আর কবে জোছনা উপভোগ করা যাবে! এটাই সুযোগ। শিক্ষা জীবনের শেষ লগ্ন। আমাদের অভিভাবক স্যার, কবি। জোছনা বিহারে তার উৎসাহ বেশি। যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণচন্দ্র প্রকাশ পায় । সমস্ত পাহাড়ি লোকালয়, জঙ্গল পেরিয়ে অপার্থিব জোছনা। যেন জোছনার বিছালি বিছিয়ে ঢেকে দিয়েছে অরণ্য। সবাই রওয়ান হয় গভীর জোছনার তলে।

৪.
আমি বুকে সাহস সঞ্চার করে তার কক্ষের সামনে দাঁড়াই। দরজায় ক-ড়া নাড়ি। নীলিম! নীলিম সাড়া দেয়না। আমি অনুপ্রবেশ করি। তার দৃষ্টি শূন্য,নির্লিপ্ত। জানালার ওপাশে।
আমার জীবনের একটা রাত কি তুমি স্বার্থক করে দিবে নীলিম ? এসো, জোছনার শপথ! কখনো কিছু চাইনি। প্রার্থনায় নতজানু হইনি। আজকে হই। এসো! আমরা দু’জন জোছনায় ডুবে থাকি আজ।
সে বিরুক্তি প্রকাশ করে। চুপ করে থাকে।
আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমি বলে যাই।
'আমার ভীষণ মাথা ধরে আছে। তুমি যাওতো প্লিজ! এসব কাব্যপণা, জোছনা আমার অসহ্য লাগে। আমি যাবোনা। দয়া করে বিদেয় হও। আমাকে ক্ষমা কর। সে বিশেষ কায়দায় দু'হাত জোড় করে ক্ষমা চায়।
আমি ইতস্ততঃ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভেঙ্গে চুরে যাই। প্রার্থনার মত করে আবারও উচ্চারণ করি আপ্ত বাক্য। সে টলে না।
তারপর আমি বের হয়ে আসি। আমার ব্যর্থ বাসনার একেকটি দেয়াল সশব্দে ভেঙে পড়ে। কোন প্রার্থনা আর অবশিষ্ট্য নেই। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি তার দরজায়।

৫.
জোছনা রাজ্যে সবাই চলে এসেছে। ভীষণ আনন্দ চলছে। জোছনার রোদ যেন চুঁইয়ে পড়ছে সমস্ত পাহাড়ে। এত হৈ চৈ আমার ভাল লাগেনা। জোছনা উপভোগ করতে হয় নিঃশব্দে। আমি নিভৃতে সরে আসি। নিঃসঙ্গতায়, নির্জনে। কিচ্ছু ভাল লাগেনা । কান্না পায় ভীষণ। পুরুষের কান্না অসুন্দর। ভিতরে তাই পুষে নিয়ে গুমরে কাঁদি। এত অবহেলা সহ্য হয়না। পাঁচ বছরের জমানো সকল কান্না দলা জমিয়ে আসে। চাওয়া-পাওয়াগুলো নষ্ট ফসল হয়ে আমাকে ধিক্কার দিয়ে যায় অবিরাম। তাই ঘরে তুলে নিতে দ্বিধা জন্মে। এক জনমের ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে জেঁকে বসে। সে কখনো আমায় বোঝেনি। একবারের জন্যও নয়। বড় করুন হয়ে বুকে বাজে।

৬.
হঠাৎ আকাশ মেঘলা হতে শুরু করে। মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। জোছনা হারিয়ে যায় ঘন মেঘের আড়ালে। আমি হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুর চলে এসেছি। জোছনাপ্রেমী সবাই ফেরার জন্য ছুটছে। আমি নির্জনে শেষ মুহুর্তের প্রতীক্ষা করছি। আমার ফিরতে ইচ্ছে করেনা।
এমন সময় দেখি সে আসছে। শাদা শাড়ী জড়ানো আমার মানসী ত্রস্ত পায়ে আসছে। আমি বিশ্বাস করতে পারিনা।
কেন এভাবে আমাকে কাঁদালে ? অভিমানে আমার বুকটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। আসবেই যখন কেন এভাবে অবহেলা করলে!
বিজলী জ্বলে জ্বলে ওঠে।সে সোজা এসে আমার হাত ধরে। প্রখর বিজলীর আলোয় চোখের গভীরের দিকে তাকায়। তারপর হাসে।
ক্ষমা চায়। 'ক্ষমা করো সুহৃদ!'
তার প্রসন্ন হাসির রেখা খেলে যায়। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারিনা। মুর্হুতে সব ভুলে যাই। বিলিয়ে দিই সমস্ত সত্তা। ভুলে যাই বিগত সকল যাতনা। সে আমার বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ে। দু’জন ডুবে যাই জোছনার নৈঃশব্দে। মেঘের বাতাসে দুর থেকে হাসনাহেনার ঘ্রাণ আসে। আমাদের চারপাশে হাসনাহেনায় ভরে ওঠে।


৭. মুখর বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। আমরা দু'জন ভিজে চুবচুব। জোছনা এক সময় ফরসা বৃষ্টিতেই হেসে ওঠে। বাকি সবাই ফিরে গেছে। সে ফেরার কথা বলেনা। আমিও। নৈঃশব্দের ভাঁজে আটকে পড়ি। দু'জন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটি। কী অপার্থিব সুন্দর জোছনা-বৃষ্টি। তার লাজুক চোখের ভেতরে অবাক হয়ে তাকাই।তার ঠোঁটের কোণায় বাসনার রঙধনু খেলে যায়। সে আমাকে বিলিয়ে দেয়। আমি বুভুক্ষুর মত হাত পেতে নিই সবটুকুন। নি:শব্দ প্রকৃতির সাজানো বাসরে ঢলে পড়ি দু'জন।

৮.
তারপর...। সে সামনে হাঁটে। পেছনে আঁচল মাটি ছুঁইয়ে যায়। চিরল কেশ ছুঁয়ে বৃষ্টিজল গড়িয়ে পড়ে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকে অনুসরণ করি। সে পেছনে তাকায় না। আনন্দে তার শরীরের গোপন নৃত্য ঝরে পড়ে। আমি বিমুগ্ধ হয়ে তার ছন্দময় চলা দেখি। অনেক হাঁটার পর পাহাড়ের কোল ঘেষে এসে সে দাঁড়ায়। নীচে বিস্তীর্ন নীল ধোঁয়ার উপত্যকা । বৃষ্টি শেষে অবাক জোছনায় সুউচ্চ পাহাড় থেকে নীচে শাদা মেঘ দেখা যায়। যেন পেঁজা তুলো উড়ছে দিশেহারা হয়ে। স্বপ্নের মত। থৈ থৈ জোছনায় যেন কুল কুল করছে নির্জন পাহাড়, নীল উপত্যকা। সে পেছনে ফিরে তাকায়। তাকিয়ে হাসে।
'আমার কি ইচ্ছে করে জানো ?'
কি ইচ্ছে করে মানসী ? আমি ভীষণ আকাঙ্খায় জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠি।
আমার ইচ্ছে করে ঐ শাদা ভেলায় উড়তে। মেঘের ভাঁজে ভাঁজে ভেসে বেড়াতে। সে বলে যায়।
চল আমরা উড়বো। দেখ, এইতো মেঘ ছোঁয়া যায়। দেখ না, দেখ!
আমি তার সাথে মেঘ ছুঁই। সে আমার সমস্ত চেতনা ডুবিয়ে আমাকে মুগ্ধ বানিয়ে দখল করে নেয়।
তারপর দু'জনে একসাথে মেঘের ভাঁজে পাখি হয়ে ভাসবো বলে হাতগুলো ডানার মত করে উড়াল দেই। শাদা মেঘের ভেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ি দু'জনে অবলীলায়।

.................................................................................

অতঃপর একটি অবিচুয়ারিঃ
আমরা গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের প্রিয় বন্ধু, মেধাবী ছাত্র নিবিড়, শিক্ষা সফরে বান্দরবানের গহীন অরণ্যে পথ হারিয়ে পাহাড় থেকে গভীর খাদে পড়ে গিয়ে নিহত হয়েছেন।
আমরা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং মৃতের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
'বন্ধুবর্গ'
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১১:৫৭
১৪৫টি মন্তব্য ১৪৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×