নতুন দিগন্ত সাময়িকীর জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৪ সংখ্যায় একটি আশাব্যঞ্জক প্রবন্ধ পড়লাম। প্রবন্ধটির লেখক ম ইনামুল হক, জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার আবেদন জানিয়েছিলেন যে দুজন তাদের একজন। এতে বাংলা ভাষাকে ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর জন্য প্রথমত বিদ্যাসাগর সোসাইটির গবেষক মুহাম্মদ আবদুল হাইয়ের একটি পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যাতে বাংলাকে ৭ম বলা হয়েছিল। ১৯৯১-এর আগে তেমনটিই ছিল হয়তো। এর জন্য হিন্দি ও উর্দু ভাষার উৎপত্তি, রুশ ভাষার বিভাজন এবং আরবি ভাষার পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস জানা আবশ্যক। মধ্যযুগে মোঘল রাজাদের সুবাদে ভারতবর্ষে ফারসি ভাষার প্রচলন হয় যা থেকে পরবর্তীতে বিবর্তিত হয় উর্দু ভাষা। মোগল শাসনের অবসানের পর উর্দুকে হিন্দুস্থানী ভাষা বলা হত। এই হিন্দুস্থানী থেকে ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে তার স্থানে সংস্কৃত শব্দ যোগ করে দেবনগরী লিপির মাধ্যমে প্রথম হিন্দি গদ্য রচিত হয়। এভাবেই জন্ম হিন্দি ভাষার। হিন্দি ও উর্দু একসাথে হিন্দুস্থানী নামে পৃথিবীর তৃতীয় ভাষা ছিল। কিন্তু ৪৭-এর পর হিন্দি পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। নিচে নেমে যায় দুটি ভাষাই। অর্থাৎ হিন্দি একটি নির্মিত ভাষা বা কনল্যাং আর উর্দুর জন্ম লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে। একমাত্র বাংলাই এ অঞ্চলের স্বাভাবিক ভাষা। যাই হোক ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে এবং তারও আগে ষাটের দশকে ফ্রান্স তার উপনিবেশগুলো হারিয়েছে। সোভিয়েত ভেঙে সৃষ্টি হওয়া আলাদা রাষ্ট্রগুলোতে যেমন পৃথক ভাষার স্বীকৃতি মিলেছে তেমনই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ভাষা হয়ে গেছে স্বাধীন। এভাবেই হিন্দি এবং রুশ ভাষা বাংলার নিচে নেমে গেছে। আর বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের কারণেই হয়তো আরবির পতন হয়েছে। এই তিনটি ভাষাই বাংলার আগে ছিল। এদের ছাড়িয়ে বাংলা তাই এখন ৪র্থ। এর আগে রয়েছে কেবল চীনা, মান্দারিন, ইংরেজি ও স্পেনীয়। এতক্ষণ সবই ইনামুল হকের প্রবন্ধের কথা হচ্ছিল। এর পিছনে তিনি যথেষ্ট তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন যার সংখ্যা মোট ৯টি। ঠিক কোন সূত্র ধরে আমরা এর অন্যথা ভাবতে পারি?
কিন্তু আধুনিক এথ্নোলগ আমাদেরকে সেই অন্যথাই ভাবতে বাধ্য করছে। এথ্নোলগ হচ্ছে বিশ্বের ভাষার পরিসংখ্যান সংক্রান্ত একটি আকর গ্রন্থ। বিশ্বের সেরা ২০টি ভাষা নিয়ে সেখানে ভাষাভাষী জনসংখ্যার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য ধরে নিলে কিন্তু সেখানে একেবারে অন্যরকম কথা বলা হয়েছে। প্রথম ১০টি ভাষার নাম আমি উল্লেখ করছি: চীনা, স্পেনীয়, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি, পর্তুগীজ, বাংলা, রুশ, জাপানি এবং প্রমিত জার্মান। পড়ে বেশ অবাক হতে হল। ইনামুল হকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমি যে তালিকাটি পেয়েছিলাম তা হল: চীনা, ইংরেজি, স্পেনীয়, বাংলা, আরবি, হিন্দি এবং রুশ। নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাদেরকে তথ্য উৎসের নির্ভরযোগ্যতা লক্ষ্য করতে হবে। ইনামুল হকের তথ্যসূত্র ছিল দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়, বিদ্যাসাগর সোসাইটির ক্রোড়পত্র, রাজশেখর বসুর প্রবন্ধাবলী এবং তারা চাঁদ ও পি হার্ডি রচিত গ্রন্থ। আর এখানে এথ্নোলগ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থ যা সকলের কাছ থেকে তথ্য নিয়েই আপডেট করা হয়। বিশ্বের প্রায় সবাই একে মেনে নেন।
তাহলে আমরা কোনটি ধরে নেব? বাংলা উইকিপিডিয়াতে এথ্নোলগের তালিকায় এটি দেখিয়ে দেয়া আছে। আবার উইকিপিডিয়ার উৎসাহী সম্পাদক সবাই বাংলাকে স্বাভাবিকের মত উইকিপিডিয়াতেও ৪র্থ স্থানে নিয়ে আসার কথা বলেছেন। এটি অনেকাংশে সম্ভব না হলেও প্রেরণা যোগায়। তাহলে প্রেরণা প্রাপ্তির জন্য আংশিক সূত্র আর বাস্তবতার জন্য সামগ্রিক সূত্র ধরে নেব? আমি জানি এর সঠিক উত্তর না জানলেও চলে। কারণ ভাষা কততম তা মূখ্য নয়, মূখ্য হচ্ছে ভাষার প্রসার ও নির্দিষ্ট ভাষায় জ্ঞানের সংকলন। তথাপি, আমাদেরকে একটি শিক্ষা অন্তত নিতে হবে। আমি এ ধরণের একটি সিদ্ধান্তে আসতে আগ্রহী: বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও মানবসম্পদের পাশাপাশি আমরা ভাষা সম্পদের সৌকর্য পেয়েছি। এই সম্পদ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসেই। সেই তুলনায় আমরা অনেক পিছনে। বিশ্বের অন্তত ৩০টি ভাষা জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রসার ও সম্পদ সংগ্রহের দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকার কারণে আমরা হয়ত প্রতিযোগিতায় আসতে পারছিনা। তাই ভাষাকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে এগিয়ে যেতেই হবে, কারণ তা-ই যুগের চাহিদা। আর স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা সরকারিভাবে দেশে একটি ঘোষণাপত্রের আশা করতে পারি। রাষ্ট্রীয় সরকার বা উভয় বাংলার সমন্বিত প্রচারপত্রে যদি বাংলার স্থান সম্বন্ধে নির্দিষ্ট করে বলা হয় তাহলে এর সমাধান হবেই। আর এর চেয়েও আবশ্যক হয়ে উঠেছে আমাদের অগ্রযাত্রা। ভবিষ্যতে হয়তো ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডারই হবে ভাষা রক্ষা ও প্রসারের চাবিকাঠি।