somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেগমগঞ্জ কালো পুলের বধ্যভূমি

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৩১ তম বার্ষিকী পালিত হয়ে গেল গত ১৬ ডিসেম্বর ২০০২। তারই প্রাক্কালে নোয়াখালী’র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার একটি অকথিত কাহিনী নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য ছুটলাম নোয়াখালী জেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায়। সেখানে কালের স্বাক্ষী চৌরাস্তা “কালো পুল” যা বর্তমানে পাকা ব্রিজ। তারই দক্ষিণে তথা চৌরাস্তা সংলগ্ন বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুল। এই উভয় স্থানই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর মানবতা বিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্র। সেখানে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি ফলক। স্বীকৃতি পায়নি বধ্যভূমির। এই স্থানের মাটির গভীরে আজও আছে অসংখ্য নারী পুরুষের গণ কবর। সেই গণকবরে গুমরে কাঁদে শহীদের আত্মা। আমরা কেউ কখনও তার খবর রাখিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার রোমহর্ষক বিবরণী তথা হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আনার চেষ্টা থেকে এ তথ্যানুসন্ধান।

একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর ২২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা ছিলো হানাদার মুক্ত। ২২ এপ্রিল বিকেল ৫টায় ৬০-৭০ টি যান্ত্রিক বহর নিয়ে পাকিন্তানী সামরিক কনভয় কুমিল্লা-লাকসাম-সোনাইমুড়ি হয়ে বেগমগঞ্জের মীরওয়ারিশপুর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে চৌরাস্তা অভিমুখে রওয়ানা হয়।ঐ দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে সময়ের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের তরুণ যুবক বর্তমানে আইনজীবী এবিএম ফারুক (৫০) বলেন, "ঐ দিন পাকবাহিনী বেচার দোকান সংলগ্ন আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে অবস্থানরত আমার বাবা জনাব ফরিদ মিয়া (টিটি) এবং আমার ভাই মোঃ ফয়েজকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমি তখন বাড়ির অদূরে লুকিয়ে ঐ হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। এর পর পাকবাহিনী কালো পুল অভিমুখে রওয়ানা হয়। পুলের সন্নিকটে এসে পাক সামরিক কনভয় থমকে দাঁড়ায়। পাক সামরিক কনভয় আসার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ কালো পুল ধ্বংস করে দেয়। এতে উত্তর দক্ষিণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাক সামরিক কনভয় চৌরাস্তায় আসার পথে কালো পুলের দক্ষিণ প্রান্তে একটি প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্মুখিন হয়। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয় শহীদ সালেহ আহম্মদ, জহিরুল ইসলাম, পিন্টু প্রমুখ। ঐ পাক সামরিক শক্তির নিকট পরাভূত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ স্তিমিত হলে পাক সামরিক বাহিনী ঝুলন্ত সেতু নির্মান করে সন্ধ্যা নাগাদ কালো পুল অতিক্রম করে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।"

একাত্তর এর ৯ মাসে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের কিশোর সারোয়ার আলম (৪৫) জানান, “বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পে পাকিন্তানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলো মেজর বোখারী। এই ক্যাম্পটি ছিলো পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নোয়াখালী জেলার মূল ঘাঁটি।“

একাত্তর এর টগবগে যুবক আবদুস সোবাহান বর্তমান বয়স ৬৫ বছর। বাড়ি চৌরাস্তা সংলগ্ন নাজিরপুর গ্রামে। একাত্তরের পুরো নয় মাস আবদুস সোবাহান চৌরাস্তার কালো পুলের পূর্ব পার্শ্বের বেহাল জালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। তখন কালো পুল, কাঠের পুল ছিলো অনেকটাই ভাঙ্গাচোরা। তার পাশেই নির্মিত হয়েছে বর্তমানের পাকা ব্রিজ। আবদুস সোবাহান বলেন, “পাক সামরিক বাহিনী টেকনিক্যাল হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করার পর পরেই মাইজদী থেকে ৫ জন নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে ধরে এনে কালো পুলের উপরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। একজন সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান। এভাবে পাক হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে নিরপরাধ মানুষ হত্যা শুরু করে।মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে প্রতিদিন কালো পুলে সর্বনিম্ন ৫/৬ জন ও সর্বোচ্চ ১৫/২০ জন করে মানুষ হত্যা করতো পাকিস্তানী সৈন্যরা। নানা নিষ্ঠুর পন্থায় ওরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতো। নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিরপরাধ মানুষগুলোকে ধরে এনে প্রথমে টেকনিক্যাল হাই স্কুল ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন করা হোত- তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কালো পুলের উপর দাঁড় করিয়ে বুলেট বেয়নেটে ঝাঁঝরা করা হতো। এভাবেই চলতো স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষদের উপর মানবতাবিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। বুলেট বেয়নেট এ ঝাঁঝরা হওয়ার পর লাশগুলো ওয়াপদা খালের পানি খুন রাঙা রঙে রাঙিয়ে ভাসতে ভাসতে পশ্চিমে চলে যেতো। এই টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চৌমুহনী কলেজের প্রাক্তন প্রধান করণিক মিরওয়ারিশপুর গ্রামের গুলজার হোসেনকে।“

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস এভাবেই হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে অবশেষে ডিসেম্বর ৫-৬ তারিখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্প গুটিয়ে লাকসাম হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে চলে যায়। কিন্তু তারা রেখে যায় সেখানে অনেক নৃশংসতার চিহ্ন। বহু নারীর সম্ভ্রম হারানোর অব্যক্ত কান্না। অসংখ্য মৃত-অর্ধমৃত নর নারীর কঙ্কালসার দেহ।




► লেখক: গোলাম আকবর, সদস্য সচিব, নোয়াখালী মানবাধিকার জোট
► নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:১৫
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×