somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার স্মৃতিতে নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব)

০৬ ই মার্চ, ২০০৮ রাত ৮:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার স্মৃতিতে নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধ (১ম পর্ব)

আমার স্মৃতিতে নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)

২৭ মার্চ ১৯৭১ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। একজন বাঙালী সামরিক অফিসারের কন্ঠ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা তখনকার সময় স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছিল।

নোয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। প্রথমে ফেনীতে পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ যুদ্ধ হলো। মাইজদী থেকে আমরা শত শত ছাত্র-জনতা ফেনীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিলাম।

২৬ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সংবাদপত্র বিহীন নোয়াখালীতে পৌরসভার সাইক্লোষ্টাইল মেসিন দিয়ে আমরা গোপনে “বুলেটিন” ছাপিয়ে খবর প্রচার করতাম। পশ্চিম মাইজদীর চক্রবর্ত্তী বাড়ীতে ছিল আমাদের “বু‍লেটিন” ছাপানোর গোপন স্থান। সেজন্য রাজাকার বাহিনী অভয় চক্রবর্ত্তীকে ধরে সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিলে তাঁকে নৃশংসভাবে চৌমুহনী টেকনিক্যাল স্কুলে এনে হত্যা করে।

২৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনী লাকসাম থেকে সড়ক পথে নোয়াখালীতে প্রবেশ করে। আমরা একদল যুবক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ত্রিপুরা চলে যাই। আগরতলায় ফ্রাষ্টম হোস্টেল নামক ক্যাম্পে ন্যাপ (মোঃ) ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিষ্ট পার্টির যৌথ উদ্যোগে যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ সংগঠিত করার কাজ চলে। আমরা কমান্ডে প্রথমেই ২৪ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে আমি আগরতলা থেকে আসামের তেজপুরে প্রশিক্ষণে চলে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে আমি ২৪ জনের ১০২ নং গেরিলা গ্রুপ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। এবং গেরিলা রিক্রুট করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দিতে থাকি। তৎকালীন নোয়াখালী সদর মহকুমা বর্তমান নোয়াখালী লক্ষীপুর জেলার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমি যৌথ গেরিলা বাহিনী পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বাহিনীর মোট ১০ জন গেরিলা শহীদ হয়েছেন। ১১ নভেম্বর বেতিয়ারায় শহীদ হন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা।

১ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমি চাটখিলের দৌলতপুর থেকে ৮০ জনের গেরিলা বাহিনী সোমপাড়ায় আবদুল্যার বাড়ীতে যাত্রা বিরতি করে ভোর রাতে মান্দারী শত্রুক্যাম্পে এককভাবে আক্রমণ চালাই এবং যুদ্ধ করে মান্দারী মুক্ত করি।

৩ ডিসেম্বর মান্দারী বাজারের চতুর্দিক ঘেরাও করে মান্দারী হাই স্কুল মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করি। ১ ডিসেম্বর মান্দারী মুক্ত করে আমরা যখন দত্তপাড়া হাই স্কুল মাঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন ঐ এলাকার ৬ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল সাহাবুদ্দিনের কমান্ডে মান্দারী অভিমুখে যাওয়ার সময় পাক মিলিশিয়া বাহিনীর গুলিতে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করলাম। ৩ জানুয়ারী ১৯৭২ নোয়াখালী কোর্ট বিল্ডিং এর সম্মুখে পেন্ডেল তৈরি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রশাসনের নিকট আমাদের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অস্ত্র জমা দিয়েছি। ঐদিন অস্ত্র জমা দেয়ার সময় ততকালীন জে‌লা প্রশাসক জে. এল. দাসের অনুরোধে কোর্ট বিল্ডিং এ উপস্থিত থাকা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাদের অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং ভারত থেকে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃহত্তর নোয়াখালীতে ৪৫০ জনে উন্নিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ভিয়েতনামের কলাকৌশলে আমাদের গেরিলা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল।

৯ মাস সশস্ত্র লড়াইয়ের পর ৭ ডিসেম্বর বীর বেশে যুদ্ধ করতে করতে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালী শহর মুক্ত করলেন। মাইজদী ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প স্থাপন করলেন কমান্ডার মোশারফ হোসেন। মাইজদী পি.টি.আইতে স্থাপিত হয়েছিল আমার কমান্ডের ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প। আমাদের আরেকটি ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল চৌমুহনী বিসিক বিল্ডিং এ। পি.টি.আই গেইটে “মুক্ত নোয়াখালী” নামে যে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে এটি ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। নোয়াখালী মুক্ত দিবস হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস।
(শেষ)


► লেখক: অ্যাডভোকেট সারওয়ার-ই-দীন
মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবি, নোয়াখালী।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:০৯
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×