somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভুটানঃ ভিতর থেকে বদলে যাচ্ছে

০৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভুটানের পঞ্চম রাজা জিগমে খেসর নামগিয়েল ওয়াংচুক এর আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয়ে গেল গতকাল থিম্পুতে, চতুর্থ রাজা জিগমে সিংঘে ওয়াংচুকের উত্তরাধিকার হিসাবে। পৃথিবীর বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যখন ওবামাকে বরন করে নিচ্ছে তাদের নতুন সরকার প্রধান হিসাবে- প্রায় একই সময় পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্রতম দেশ ভুটান অভিষিক্ত করলো তাদের নতুন রাজাকে।

রাজা হিসাবে বিশ্বের কনিষ্ঠতম, অক্সফোর্ডের গ্রাজুয়েট রাজা জিগমে খেসর তার পুর্বসুরীদের চেয়ে অন্তত একটা বিষয়ে স্বতন্ত্র। রাজতন্ত্রের প্রধান হিসাবে নয়, বরং তিনি এখন রাজা সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে। ভুটান এখন আর এ্যবসলিউট মনার্কি নয়, এখন তা কনিষ্টিউশনাল মনার্কি। অনেকটা থাইল্যন্ডের আদলে, রাজার পদ মর্যাদা স্রেফ আলঙ্কারিক, নির্বাহী ক্ষমতা সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে। রাজতন্ত্রের থেকে শাসনতান্ত্রিক এই উত্তরন কোন আভ্যন্তরীন দাবী অথবা পশ্চিমা দেশ গুলো যেমন আরও গনতন্ত্রের জন্য কোন কোন দেশ কে চাপ দেয় সে রকমও কিছু নয়।

রাজবংশের শতবার্ষিকীর প্রাক্কালে রাজতন্ত্রের আধুনিকিকরনের এই উদ্যোগ এসেছে খোদ রাজতন্ত্রের ভিতর থেকেই। গত দুই দশক ধরেই শোনা যাচ্ছিল এই পরিবর্তনের কথা।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জনশাসনে জনগনের আরও অংশ গ্রহন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই চতুর্থ রাজা জিগমে সিংঘের এই উদ্যোগ। ক্ষমতা ছেড়েছিলেন সেই ২০০৬এর শেষ দিকে- আর নতুন রাজার অভিষেক হলো এই ২০০৮এ এসে। তো এতদিন কি হলো? নতুন রাজা অভিজ্ঞতা অর্জন করছিলেন-- নতুন গনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা হলো- রাজার ভুমিকা সেখানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া- রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হলো। মোট রাজনৈতিক দল তিনটা, নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন পেল দুইটা দল। এ বছরেরই মার্চ মাসে হলো সাধারন নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিজয়ী হলো ভুটান পিস এন্ড প্রস্পারিটি পার্টি। বিরোধী দলের বেঞ্চে বসলো পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টি। আর এরপর হলো নতুন বাজার অভিষেক। যদিও বলা হচ্ছে রাজ জ্যোতিষীরা গত প্রায় দুই বছর কোন শুভদিন নির্নয় করতে পারছিলেন না বলে- রাজ-অভিষেক পিছিয়ে যাচ্ছিল, আসল কথা রাজা জিগমে সিংঘে ওয়াংচুক চাইছিলেন গনতান্ত্রিক ভুটানের অভিযাত্রার একটা পর্যায় অতিক্রম করার পর- নতুন সংবিধানে রাজার ভুমিকা স্পষ্ট করার পরই- নতুন রাজা অভিষিক্ত হোক।

এই হলো চতুর্থ রাজা জিগমে সিংঘে ওয়াংচুক- যার কাছে জিডিপির মোট জাতীয় উৎপাদনের পাশাপাশি গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জি এন এইচ) ও সমান গুরুত্বপুর্ন।গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস জিনিষটা কি? এটা কোন একটা দেশের গনশাসনের সাফল্যের পরিমাপ- যা দাড়িয়ে আছে চারটি স্তম্ভের ওপরঃ পরিবেশ সুরক্ষার নিরাপত্তা, সংস্কৃতির সংরক্ষন, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন আর সুশাসন।

হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দুই উঠতি পরাশক্তি ভারত এবং চীনের মাঝখানে ভুটান। সারা দুনিয়া থেকে নিজদের সযত্নে আড়াল করে রাখা-নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-জীবনযাপনের পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল দেশটির বৈশিষ্ট্য। কখনও চায়নি বাইরের কোন কিছু গ্রহন করতে- নিজস্ব স্বকীয়তা নষ্ট করে এমন কিছুর প্রবেশও বরদাস্ত করেনি। তাদের নিজস্ব জাতীয় পোষাক ঘো (Gho) যা অনেকটা বাথরোবের মত কোমরে ফিতা দিয়ে বাঁধা- পরিধান করা কোন কোন প্রদেশে এখনও বাধ্যতামুলক।

ভূটানকে সে অর্থে কখনই পরাধীনতার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয় নি, ঔপনিবেশিকতার যুগেও ভূটানের ছিল স্বায়ত্ত্ব শাসনের বিশেষ মর্যাদা। প্রতিরক্ষা আর বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয় গুলো ছিল বৃটিষরাজের অধীন, কিন্ত আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে বৃটিষরাজ কখনই মাথা ঘামায়নি। ‘৪৭ সালে বৃটিষরা এদেশ থেকে বিদায় নেবার পর ভারত বৃটিষদের ছেড়ে যাওয়া জুতায় পা ঢুকায়-১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে ভূটানের প্রায় একই ধরনের একটি মৈত্রী চুক্তি হয়।প্রতিরক্ষা আর বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয় গুলো ভারতের নিয়ন্ত্রনে আর আভ্যন্তরীন প্রশাসন তথা শিক্ষা, অর্থ, ব্যবসায় বানিজ্য সবই ভূটানের নিজস্ব নিয়ন্ত্রনে। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সেই ভারত-ভুটান চুক্তির কিছু পরিমার্জনার ফলে ভুটানের সার্বভৌমত্ব আগের চেয়ে বেশী করে নিশ্চিত হয়।

কখনই প্রত্যক্ষ বিদেশী শাসনের অধীনে না থাকার ফলে-বাইরের জগত থেকে নিজদের স্বাতন্ত্র আর বৈশিষ্ট্যকে বাঁচিয়ে রাখার কাজটা ভূটানের পক্ষে সহজ হয়েছিল।
তবে এই অবস্থার পরিবর্তনের শুরু আসলে ১৯৬০ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। আধুনিক ভুটান গড়ে তোলার লক্ষ্যে শুরু হয় বিশাল বিশাল সব নির্মান কাজ, মাইলের পর মাইল রাস্তা বানানো। প্রয়োজন হয়ে পড়ে দক্ষ শ্রমিকের। নেপালী আর ভারতীয় শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার শুরু হয়। কাজের আশায় দারিদ্রপীড়িত নেপালীরা দলে দলে ভিড় জমাতে থাকে ভুটানে।বহিরাগত এই শ্রমিকেরা পরিবার পরিজন নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে এক সময় পরিনত হয় স্থায়ী বাসিন্দায়।

কিন্ত বিপুল সংখ্যক এই বহিরাগত যাদের অধিকাংশই অবৈধ- তাদের সরব উপস্থিতি, ভুটানের নিজ সংস্কৃতির প্রতি রক্ষনশীল মনোভাবের সাথে খাপ খাচ্ছিল না- ভারত অথবা নেপাল থেকে আগতদের ভুটানের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে কোন ধারনাই ছিল না। ভূটানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘জংখা’, কিন্ত তাদের জন্য স্কুল গুলোতে মাধ্যম হিসাবে নেপালী ভাষা প্রচলন করতে হয়।

৯০ এর দশকে এই সব বহিরাগতদের বিরুদ্ধে সরকার কড়া মনোভাব নেয়, রাষ্ট্রীয় পোষাক এবং ভাষার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। স্কুল গুলোতে রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘জংখা’ ব্যতিত অন্য কোন ভাষা বাতিল করে দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালের নতুন অভিবাসন অনুযায়ী ১৯৫৮ সালের পরে আগত সবাইকে বিদেশী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় এবং দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। সৃষ্টি হয় ভুটানীজ রিফিউজি সমস্যা- বকলমে যারা আসলে নেপাল থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী।

যদিও আন্তজার্তিক সংস্থা গুলো একে মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং এর ফলে বর্হিবিশ্বে ভূটানের ভাবমুর্তি দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাম্প্রতিক বছর গুলোতে হিমালয়ের বুকে স্বেচ্ছায় নিজকে গুটিয়ে রাখা এক রাষ্ট্র হিসাবে ভূটানের ভাবমুর্তি বজায় রাখা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যখন স্যাটেলাইট টেলিভিষন আর ইন্টারনেট পুরা পৃথিবীটাকে একটাই ভুখন্ডে পরিনত করছে- দেশ জাতির পরিচয় ক্রমশঃ মুছে যাচ্ছে-তখন ভূটান নামের দেশটাও বদলে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে।ফেডেড জিনস্ আর হাতে গিটার নিয়ে নতুন এক প্রজন্ম আবির্ভুত হচ্ছে থিম্পুর রাস্তায় রাস্তায়- আমেরিকান আইডল এর সর্বশেষ শো, কিংবা এমটিভির যে কোন প্রোগ্রাম সম্পর্কে যার রয়েছে পরিস্কার মতামত। যাদের জন্য ড্রেস কোডের কড়াকড়িও আজ শিথিল-আপাত নিষিদ্ধ সিগারেট এর ব্যবহারও কর্তৃপক্ষ দেখে না দেখার ভান করছে।

ভুটানের জন্য সুখবর-পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির সাথে সুস্থ ভাবে খাপ খাইয়ে নিতে তারা তাদের পাশে পাচ্ছে তাদের রাজাকে। রাজতন্ত্রের কাটছাট আর গনতান্ত্রয়নের ফলে ভুটানের রক্ষনশীলতা আগামী দিন গুলোতে আরও কমবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারনা।

কোন সন্দেহ নাই নেপালের রাজপরিবারের তুলনায় ভুটানের রাজপরিবার বুদ্ধি বিবেচনায় কয়েক মাইল এগিয়ে।

১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×