somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোডঃ কলোয়ানিয়াল আত্মীয়তার চিহ্ন

১০ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন আমি পাঠশালায়, হাই স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি- ডক শব্দটা তখন থেকেই আমি জানি। ডক জিনিষটা আর কিছুই না, যখন তুমি স্কুলের হোম টাস্ক বাদ দিয়ে মহল্লায় মার্বেল খেলায় নৈপুন্য দেখাতে ব্যস্ত- তখন তোমার লেখাপড়া যেখানে তোলা থাকে- সেটাই হল ডক। কপাল খারাপ থাকলে আর মায়ের মেজাজ গরম থাকলে (কথায় বলে না, চোরের সাত দিন- তো গেরস্তের এক দিন) যেদিন বমাল ধরা পড়তাম- কান টানতে টানতে মা বলতো- লেখাপড়া সব ডকে তুলে রেখেছো??

পুর্ব লন্ডনের যে এলাকায় সবচেয়ে বেশী সময় আমি থেকেছি সেখানে ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড অন্যতম প্রধান একটা রাস্তা।শুরু হয়েছে ক্যানিং টাউন এর জাংশন থেকে, তারপর লী নদী (নাকি খাল?) পেরিয়ে পপলার হাই স্ট্রীট হয়ে লাইমহাউসে এ১৩ মটোর ওয়েতে এসে মিশেছে।

পাশেই থেমস নদী, আর ইস্ট ইন্ডিয়া ডকও ছিল থেমসের এই বেসিনেই। ১৯৬৭ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশালাকারের সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে শুরু করে যে কোন ধরনের জাহাজ এখানে মেরামত করার ব্যবস্থা ছিল। মাসের পর মাস সমুদ্র যাত্রার পর বন্দরে ফিরে এলেই জাহাজ তুলে রাখা হত ডকে, ওভার হলিং, মেরামতি আর ঘসা মাজা করে পরবর্তী যাত্রার উপযোগী করে তোলার জন্য।

প্রথম যেদিন আমি রাস্তাটির নাম খেয়াল করি- ফিরছিলাম কাজের জায়গা থেকে নিজের আস্তানায়- ডবল ডেকার বাসের দোতলায় জানালার পাশে বসে অপরিচিত শহরের খুটিনাটি খোঁজায় মগ্ন আমি। একটা ক্রস রোডে বাস থেমেছে- আমি আবিস্কার করি দোতলা বাসের জানালায় বসে থাকা আমার চোখের সমান উচ্চতায় বিবর্ন এক ইটের দেয়ালে লিখা ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড।

জমিদার বাড়ির বিশাল অট্টালিকার কোন এক কোনে রাখাল বালকের লিখে রাখা নিজের নাম যেন।

স্বীকার করি নামটা দেখে আমি লন্ডন শহরের প্রতি এক ধরনের নৈকট্য অনুভব করি। ইতিহাস বোধের মেদুরতায় আচ্ছন্ন হতে হতে আমি আমার পুর্বপুরুষদের অস্তিত্ত্ব টের পেতে থাকি চার পাশে। বৃটিশ রাজের সাথে আমার কলোয়ানিয়াল আত্মীয়তার এক ধরনের চিহ্ন। উপমহাদেশের ঐশ্বর্য্য ছিনিয়ে এনে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ার যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের একটা ছেঁড়া পৃষ্ঠা হলো এই ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড ।

আমার বন্ধুদের অনেকেই আছে (অবশ্যই তাদের সবার গায়ের রং সাদা নয়) যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে পিছিয়ে পড়া জাতি গুলোর উপরে আধিপত্য (পদানত না হয় নাই বললাম) এনে তাদের পাশ্চাত্য সভ্যতার আওতা ভুক্ত করার এই
কলোয়ানিজম এর ইতিহাসের ভারী সমর্থক।অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সমর্থন তৈরী হয় অবশ্য ইউরোপের অর্থনৈতিক ভাবে শিল্প বিপ্লব আর রাজনৈতিক ভাবে গনতন্ত্র সহ ইউরোপের যা কিছু অর্জন তার প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা থেকে। মধ্যযুগের যা কিছু অজ্ঞানতা, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা তাকে পরাজিত করে স্বাধীনতা মৈত্রী আর ভাতৃত্ত্বের শ্লোগান নিয়ে ইউরোপের রাজনৈতিক উত্থান- বিশ্ব ইতিহাসে তা এক প্রগতিশীলতার যুগ কোন সন্দেহ নাই। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষ প্রথম আবিস্কার করছে সে স্বাধীন, সে মুক্ত। তার নিজস্ব ইচ্ছা আছে আকাঙ্খা আছে, সে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করতে পারে। বিশ্বইতিহাসে প্রথম মানুষের অধিকারের দাবী বোধ হিসাবে দানা বাঁধছে। আধুনিকতার ভিত্তি এখান থেকেই শুরু। স্বাধীন ইচ্ছা সম্পন্ন, নিজ অধিকারের প্রতি সচেতন এক নতুন মানুষ আবির্ভুত হলো মানব সভ্যতায়। শুরু হলো গনতন্ত্রের যুগ।

সংঘাত অবশ্যই ছিল চার্চের সাথে- ধর্মযাজকদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরূদ্ধে। স্বাধীন মানুষের পক্ষের এই শ্রেনীর কাছে পরাভুত হলো চার্চের আধিপত্য। এসে গেল প্রোটেষ্ট্যান্টরা ক্যথলিকদের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক শক্তির কাছে পরাজিত হল ধর্ম।

আমার বন্ধুদের সাথে এ সব নিয়ে আমার কোন মতপার্থক্য নাই। ইউরোপে ব্যক্তির উত্থান নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল একটা ঘটনা। আমি শুধু তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই ইউরোপের এই ইতিহাসে আমার স্থান কোথায়? ব্যক্তির উত্থানের সেই ইতিহাস আমার পুর্বপুরুষেরও ইতিহাস কিনা। পাশ্চাত্যে যে সময় আধুনিক চিন্তা আর মননের আবির্ভাব ঘটছে- আমিও সেই গৌরবের অংশ ছিলাম কিনা? গনতান্ত্রিক অধিকারের যে প্রতিষ্ঠা ইউরোপ দেখছে- কলোয়ানিয়াল আত্মীয়তার সুবাদে আমরা সেই অধিকার ভোগ করেছি কিনা?

ইউরোপের ইতিহাসে যে শ্রেনী স্বাধীনতা মৈত্রীর শ্লোগান লড়াই করে অর্জন করলো, ধর্মের শোষনের বিরুদ্ধে লড়াই করলো-সেই একই শ্রেনী যখন আমাকে উপনিবেশের সম্পর্কে জড়ালো আমার ভুখন্ডে সে তার সেই গনতান্ত্রিক লড়াই কেন বন্ধ করলো? পাশ্চাত্যে থাকার সময় যে লোক গনতন্ত্রের পক্ষে- সেই একই লোক আমার ভুখন্ডে যা কিছু অজ্ঞানতা, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা তার বিরুদ্ধে তার লড়াই কেন জারী রাখল না? এই বেঈমানী, এই বিশ্বাসঘাতকতা আমরা কখনো খেয়াল করি না।

ইউরোপের মানুষ ইতিহাসের যে কাল পর্বে ব্যক্তি স্বাধীনতা তথা গনতান্ত্রিক অধিকারের আলোকোজ্জ্বল ছটায় উদ্ভাসিত- আমার স্বভুমের ইতিহাস সেই একই কাল পর্বে শোষন বঞ্চনা আর নির্যাতনের। নীল চাষী আর আঙ্গুল কাটা সেই মসলিনের তাঁতীদের তো কেউ গনতান্ত্রিক অধিকারের বানী শোনায় নি। আমার সেই পুর্ব পুরুষরা কখনো জানে নি কি তার গনতান্ত্রিক অধিকার।

ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড দিয়ে আমি যাওয়া আশা করি- এশিয়া আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত সেই সব মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে আমার পুর্ব পুরুষেরা তাদের কথা আমার খুব মনে হয়। ইউরোপীয় যে আধুনিকতার, যে এনলাইটমেন্টের আমরা মুগ্ধ ভাবে অনুকরন করি- এনলাইটমেন্টের সেই ইতিহাসে আমার স্থান কোথায়? আমার নিজস্ব ভৌগলিক ইতিহাসের সাথে কিভাবে তাকে আমরা যুক্ত করতে পারি?


১৫টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×