somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হলোঃ “আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস্‌”...

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“যুদ্ধের প্রথম শেলটা পড়ে হৃদয়ের মাঝখানে…” পল বোমার এর এই আক্ষেপ আর হাহাকার যেন প্রতিধ্বনি তোলে আমাদের লিটল ফাইটারের কথায়..., আমার ছেলেখেলা করা শৈশব এক হ্যাঁচকা টানে সরে গিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল যুদ্ধের দগদগে ঘা মাখা এক কদাকার বিভৎস স্মৃতি, যা আনন্দ বেদনা আর গৌরবের এক রক্ত তিলক।

“আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস্‌”, পরিনত বয়সে এসে পিছন ফিরে চাওয়া এক কিশোরের, কালের দৃষ্টিতে দেখা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার নিঁখুত বর্ণনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে তার প্রথম কৈশোর কাটানো মনজুরুল হক, লিটল ফাইটার হয়ে, আমাদের মনে করিয়ে দেন এরিক মারিয়া রেমার্ক — আমাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে তার ধ্রুপদি সৃষ্টি “অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট”... যদিও বয়সের বিস্তর ফারাক বিদেশী সাংবাদিকের ক্যামেরায় তোলা গোলাবারুদের আশ্রয়ের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা লিটল ফাইটার আর রেমার্কের পল বোমারের মধ্যে।

এরিক মারিয়া রেমার্কের সৃষ্ট অমর চরিত্র পল বোমার যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে, আর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের হাত থেকে নিজ পরিবার আর মাতৃভুমিকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায় আমাদের লিটল ফাইটার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন মাত্র ১১বছর বয়সে। যুদ্ধের বিভীষিকার মাঝে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে বেড়ানো একটা পরিবার বিদেশ বিভুঁইয়ের অচেনা পরিবেশে এসে হাবুডুবু খায় — এই অবস্থায় পুরো পরিবারকে এক রকম মাঝপথে ফেলে রেখে পরিবারের প্রধানকে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে তার দ্বায়ীত্ব পালনের জন্য ফ্রন্টে ফিরে যেতে হয়। ছোট তিন বোন সহ আম্মার দ্বায়ীত্ব এসে পড়ে, লিটল ফাইটারের ১১বছরের কাঁধে — ভয় পেয়োনা, তোমার উপর দায়িত্ব থাকল, নিজে বাঁচবে, মা-বোনদের বাঁচাবে... পিতার আদেশ শিরোধার্য্য করে বিজন-বিভুঁই অনাত্মীয় বিদেশের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে এক নাবালক কিশোর। শুরু হয় যাবতীয় প্রতিকুলতার মাঝে নিজ পরিবারকে নিয়ে স্রেফ টিকে থাকার জন্য, হাফপ্যান্ট হাওয়াই সার্ট স্যান্ডেল পায়ে ঘাড়ে ব্যাগ, ১১ বছরের এক কিশোরের দাঁতে দাঁত চেপে এক মরিয়া লড়াই... আমাদের লিটল ফাইটারের নিজস্ব লড়াই।

গত বছরের সারাটা ডিসেম্বর মাস জুড়ে মনজুরুল হকের ব্লগ সাইট সামহোয়্যারইন ব্লগ সাইটের সদস্য এবং ভিজিটরদের জন্য যেন একটা পবিত্র তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সেদিনের সেই কিশোর, আজ পরিনত বয়সে এসে তার নিজস্ব ব্লগ সাইটে লিখছেন তার সেদিনের সেই লড়াইয়ের কথা। হাফপ্যান্ট হাওয়াই সার্ট স্যান্ডেল পায়ে ঘাড়ে ব্যাগ, ১১ বছরের এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা দেখা,তার নিখুত বর্ণনা নিয়ে লেখা সম্ভবত এই প্রথম।কোন স্ক্রিপ্টের দৃশ্যকল্প তৈরির সময় ঘটনাকালকে মুর্ত করে তোলার কথা খেয়াল রেখে তার ভিতর মালমশলা রেখে তা রচনা করতে হয়, কিন্তু এখানে তৈরি দৃশ্যকল্প পুরোপুরি স্বতঃস্ফুর্ত ও জীবন্ত - নিজগুণে একালে লেখার সময়ও তা আপনাতেই জীবন্ত। বিপুল সংখ্যক ব্লগার প্রতিদিন ব্রত উদযাপনের মতো নিয়ম করে এই ব্লগে প্রবেশ করেছেন। ব্লগে মন্তব্য করার সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব, শ্রদ্ধা আর ভালবাসা, একই সাথে স্বজন হারানোর কষ্ট ও ব্যক্তিগত অনুভুতিগুলোকে একে অন্যের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। বিজয়ের এই মাস মনজুরুল হকের ব্লগসাইট হয়ে উঠেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মৃতি তর্পনের পবিত্র মাটি।

লড়াকু কিশোরের লড়াই এগিয়ে চলে, মাতৃভুমির ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি শত্রুর কবল থেকে মুক্ত হতে থাকে, স্বাধীন গনতান্ত্রিক বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রুপান্তরের সূচনা হতে থাকে। কিশোরের হাতে প্রথমবারের মতো উঠে আসে হাতিয়ার — এসএলআর, রাইফেল, গ্রেনেড আর সেই সাথে ৭০ দশকের তারুন্য স্পর্ধিত নকশাল আন্দোলনের স্পর্শ পাওয়া মাওসেতুং এর লাল বই। কিশোর যোদ্ধার সমাজ ভাবনায় বৈপ্লবিক চেতনার স্ফুরন ঘটে... ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, দুর্ধষ সব ঘটনার চাপে, এক বিপুল পরিমান ভাঙচুর আর অদল বদলের ঘটনা সকলের অজান্তে ভেতরে ভেতরে আমূল বদলে দিতে থাকে সাহসী কিশোরটিকে। প্রথাগত বিদ্যালয় তখন বন্ধ, বইখাতার সাথে নাই কোন সম্পর্ক — পৃথিবীর পাঠশালায় জীবনের শিক্ষায় ঋদ্ধ হতে থাকে নবীন কিশোর।

কিন্তু মুল্যটা দিতে হয় অনেক চড়া — দুনিয়ার সব অর্জনের পিছনে থাকে যেমন চড়া মুল্য। একসময় যুদ্ধ শেষ হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। রাতারাতি বড় হয়ে যাওয়া কিশোরের শরীরে পুরানো কোন পোষাকই আর আটতে চায় না। যুদ্ধের আগের ফেলে আসা শহর, সেই শহরের পুরানো বন্ধুরা, তার পুরানো জীবন... কোন কিছুর সাথেই আগের মতো সাবলীল হওয়া যায় না। অন্তর্গত বদলে যাওয়া জীবনবোধ আর নিজকে মেলাতে পারে না পারিপার্শ্বিকতার সাথে। সব কিছুর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা এক ক্রোধের বারুদ চুরমার করে দিতে চায় চারপাশের দুনিয়াকে। আমাদের লিটল ফাইটার ভেবে কুল কিনারা করতে পারে না — এই কিম্ভুতকিমাকার পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইটা কি ভাবে জারী রাখা যায়?

বুকফাটা করুণ এক আর্তনাদের সুর ভেতর থেকে অবিরাম প্রবাহিত হতে থাকে... কে চেয়েছে জীবনের এত জ্ঞান, এত অভিজ্ঞতা? যতটুকু আঁটে না, তার চেয়েও বেশি ঠেসেঠুসে দিয়ে কেন তোমরা কিশোর কে প্রৌঢ় বানাও? হে জ্ঞান, কোথা থেকে আসো তুমি, কোথায় নিবাস? ফিরে যাও জ্ঞান, আমাকে থাকতে দাও আমার আলাভোলা ন্যাকা ন্যাকা শৈশব নিয়ে, আমার মাশুমিয়াৎ, আমার নাদানি নিয়ে!!

একটা যুদ্ধ সব কিছু এমন ভাবে বদলে দেয়, এক শহর থেকে অন্য শহর, এখান থেকে সেখানে। স্বাচ্ছন্দ্য মেলেনা কোথাও! পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় লিটল ফাইটার... মানুষ দেখলে এখন তার আতঙ্ক হয়!! মানুষের সঙ্গ দেয় না কোন স্বস্তি... শুধু যতটুকু সময় বইয়ের পাতায়, সারিবদ্ধ কালো কালো অক্ষর, ততটুকুই শান্তি। শেষ অবলম্বন হিসাবে প্রানপনে সে আঁকড়ে ধরে বইয়ের জগত। যুদ্ধক্ষেত্র ফেরত কিশোর যোদ্ধা, গড়ে তোলে পরাবাস্তবতার নতুন পৃথিবী।

এখনও স্বপ্ন দেখে চলে কিশোর যোদ্ধা, গোলাবারুদের আশ্রয়ের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা সেই লিটল ফাইটার স্বপ্ন দেখে এক গনতান্ত্রিক সমাজের। যাবতীয় শোষন বঞ্চনার চির অবসানে, প্রতিটা মানুষের প্রাপ্য সেই মানবিক জীবন নিশ্চিত হওয়ার। লড়াই জারি রাখেন ফ্রন্টের অকুতোভয় যোদ্ধা হিসাবে, কাজে লাগাতে চান জীবনের এই উপচে পড়া অভিজ্ঞতাগুলোকে।

সহব্লগার পি মুন্সী যেভাবে মন্তব্য করেনঃ ... মনজু সফল হবে তার মানবিক ক্ষমতাগুণে; বড় ভুল করা থেকে বেঁচে যাবে - অভিজ্ঞতার প্রতি সৎ আর প্রাকটিক্যাল হবার কারণে। মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতা বহু ঘটনায় ঠাসা থাকে, এর সবগুলোই তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষ হয় না। এর কিছু অভিজ্ঞতা থাকে যা কয়েক প্রজন্মকে শিক্ষার উপাদান হিসাবে সঞ্চয়ে থেকে যায়, জীবনের বড় ভুলগুলো করা থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। আপনি সেই উপাদান সংগ্রাহকদের একজন।"

আশা করি আগামী প্রজন্ম মনজুরুল হকের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে তাদের পথ চলার পাথেয় সংগ্রহ করবেন।


গত ডিসেম্বর মাস জূড়েই মনজুরুল হক আমাদের শোনাচ্ছিলেন "এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি" সর্ব মোট ২২পর্বে সমাপ্ত এই স্মৃতিকথা ব্লগে প্রকাশের সময় থেকেই দাবী উঠেছিল বই হিসাবে প্রকাশ করার।

আনন্দের সংবাদ অবশেষে এই স্মৃতিকথা “আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস্‌” নামে বই হিসাবে প্রকাশ করেছে 'ঐতিহ্য'। পাওয়া যাবে- আগামী কাল থেকে একুশে বইমেলার ঐতিহ্যের স্টলে। এবারের বইমেলায় ঐতিহ্যের স্টল নম্বর ১২৯, ১৩০, ১৩১।

সবাইকে বইটা সংগ্রহ করার জন্য আহবান জানাচ্ছি।


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ২:০৮
২৬টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×