somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে উচ্চতায় পতাকা – যেখানে পাখি ওড়ে না

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ৮:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এক ভীতি আমার মধ্যে সব সময় কাজ করে। কথাটার মানে অনেকে অনেক ভাবে করতে পারেন। তবে স্বাধীন দেশের এক আম জনতা হিসেবে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা চালিয়ে গেছি অনেক সময়। মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করেছি। সেই প্রশ্নের শিকার যেমন আমার বাবা হয়েছেন তেমনি আমার শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, মসজিদে নামাজ পড়ার এমন কেউ। আবার বানিয়াচং এ সাগর সমান দীঘিটার সমনে যে স্কুল তার দারোয়ান, সেও বাদ যায়নি। তবে বুদ্ধিবৃত্তিজীবী করতে পারিনি বলে কে কি করল সে দিকে না তাকিয়ে নিজেই কিছু একটা করার জন্য শেষমেষ আমার পথই বেছে নিলাম। কত উচ্চতায় আমি বাংলাদেশকে নিতে পারি?
বড়দের (!) মত না হোক আমাদের মত করে অনেক ছোট ভাবে। তবে স্বার্থহীন ভাবে। নামের খোঁজে না, কাউকে রাজাকার বানাবার জন্য না, নিজেকে মুক্তি যোদ্ধার সন্তান দাবী করার মধ্যে না। জয় বাংলা, জিন্দাবাদে না। ভর্তি পরীক্ষায়-চাকরিতে বিশেষ সুবিধা পাবার আশায় না। ২০ বছর জীবনের তিন আঙ্গুল এর এক চিমটি পরিমান জ্ঞান নিয়ে একটি পথই বেছে নিলাম কত উচ্চতায় দেশের পতাকাটাকে নেয়া যায়। এটা ঠিক অলিম্পিকে গোল্ড পাবার মত না বা ক্রিকেটের মত বীরত্বের কিছু না। এটা নিছক এক পাগলামী – পর্বতারোহন এমনই কিছু।
এভারেস্ট!
সেই ২০০৩ এ স্বর্ন জয়ন্তীতে যখন মহাপর্বত এভারেস্ট বেসক্যাম্প এ গেলাম তখন ঢাকায় পাহার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়নি। চারমাস না খেয়ে ৩৭০ মার্কিন ডলারের ২১ দিনের ট্রিপে প্রথম পতাকা টানার স্বাধ বা ভার দুই পেলাম। সে যাত্রায় ১৮৩০০ ফুটে যখন উঠি এভারেস্ট দেখার জন্য তখন আমার সাথে এক ইসরাইলি আরোহী! কি অবাক করা কাজ! সারা জীবন শুনে এলাম ইসরাইলীরা আমাদের শত্রু। আমিও তাই জানি। কিন্তু যখন হাড় কামড়ানো ঠান্ডায় যে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে আসবে সে আমার ধর্মের না! জীবনে অনেক বড় একটা শিক্ষা পেলাম, এখনও মনে করতে পারি প্রি-মনসুনের মে মাসে রাত ৮টায় এভারেস্ট এর সামনে তাকিয়ে জোরে জোরে আমার বাংলাদেশ বাংলাদেশ চিৎকার যেমন সৃষ্টিকর্তা শুনেছিলেন তেমনি গলা মিলিয়ে ছিল আমর – আমার ইসরাইলি বন্ধু। ততদিন অবধি কেউ কখনও সে উচ্চতায় গেছে কিনা আমি জানি না, যেতেও পারেন। তবে আমার বাল্য মনে সেই বাংলাদেশ চিৎকার আটকে গেছে সারা জীবনের জন্য। তাই এখনও নেপালে গেলে দেখতে পাবেন পর্বতারোহীদের খুবই প্রিয় বার – রাম ডুডল এর সেন্টার বার টেবিলের ঠিক উপরে একটা কার্ড বোর্ডের পা আছে। যাতে পাচ দেশের পাচ পতাকা আর স্পস্ট বাংলায় দেখা আছে “পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।“ রাম ডুডলের হাজার পঞ্চাশেক কার্ড বোর্ডের পা’র মধ্যে বাংলাদেশের নাম তখন অবদি কেউ দেখেনি।
উত্তর ভারত।
২০০৪ এর শেষ দিকের প্রথম দিকের ঘটনা। পর্বতারোহন শেখার জন্য ভারতের স্কুলে। এবং শেষ দিকে মহীরুহ পর্বত কেদার ডোম (৬৮৫০ মিটার) আরোহনের চেষ্টা। নানা বয়সী নানা দেশের মানুষের মাঝে আমি একটুকরো বাংলাদেশ। আমার বাম পাজরের ওপরে জ্যাকেটের পকেটে খুবই ছোট একটা লাল-সবুজ। সেই লাল সবুজের ভার অনেক অংশে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারং এর তখনকার পৃন্সিপাল কর্নেল অশোক এ্যবি। বিখ্যাত এই পর্বতারোহী হল ভর্তি মানুষের সামনে তার জীবনেও প্রথম কাউকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশী। তার উচ্চারিত বাংলাদেশ শব্দের মাদকতা আমাকে লাইনের সবার শেষে দাড়াতে দেয়নি আর কোন দিন। তার সবার সামনে বাংলাদেশ পরিচিতিই বলে দেয় ‘৭১ এ তারও বোধ করি অবদান ছিল। এটা আমর ধরনা মাত্র।
কাশ্মির।
২০০৪ সেপটেম্বর মাসের ঘটনা। আমার বন্ধুরা সবাই চাকরি করে তখন। আমিই খালি পাহাড়ে চড়ি। তাই কাশ্মিরের স্তোক কাংড়ি আরোহনের সময় টাকা পয়সার জন্য প্রতিবারের মত সবার কাছে হাত পেতে ছিলাম। হায়! সময় পাল্টে গেছে ততদিনে। কেউ দিলনা টাকা। অগত্যা পকেটের মাত্র ২১০ ডলার নিয়ে প্রান বন্ধু রিফাত কে নিয়ে বের হলাম ১৯৭০০ ফুটি পর্বত আরোহনের নেশায়। নিজের বিশ্বাসের গুরে বালি ঢেলে দিয়েছিলাম নিজেরাই। মনে পরে কোলকাতা থেকে চন্দিগর যাবার সময় ৫ রুপির ভাতে ভাগ বসিয়েছিলাম দুই জন। স্তোক গ্রাম থেকে নেয়া হয়েছিল ৩টি ঘোড়া, ঘোড়ার মালিক আর গাইড কাম কুক – গোলাম কে।পয়সা বাচানর জন্য হোটেলে মাত্র একদিন থেকে রওনা হয়েছিলাম জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর আরোহনে। মাত্র ৪ দিনে আমরা আরোহন করেছিলাম প্রায় ১৪০০০ফূট।
সন্ধ্যায় কিচেন তাবুতে আমরা ৪ জন আড্ডা বসাতাম। কথায় কথায় ঘোড়া ওয়ালা বলেলন বাংলাদেশের নাম। তার বাবা সে সময় চট্টগ্রামে ছিলেন, ঘটনা কাল ‘৭১। ওনারো মনে নাই সব কিছু। তবে এটা বললেন তার তাবা আর্মির সৈনিক ছিলেন এবং চিটাগং এর কথা উনি তার কাছ থেকেই শুনেছেন। (প্রিয় হাসান মাহমুদ সাহেবের লেখায় এরকম একটা বিষয় দেখে আমি বেশ শিহরিত, আমি ভুল শুনি নাই আমার ঘোড়া ওয়ালার কাছ থেকে, হতেই পারে এমন)


২০০৫ এ এশিয়ার দেশ গুলোর তরুনদের নিয়ে যৌথ দলে বাংলাদেশ নামটাকে ঢুকাতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। পাহাড়ে যাওয়ার কোন ইতিহাস আমাদের তখনও হয়নি। তাই প্রথম এভারেস্ট লেডি জুনকো তাবেই এর সাথে মাউন্ট ফুজি আরোহন আমার কাছে বিশেষ একটা কিছু। যদিও আরোহন হিসেবে এটাতে বাড়তি কোন কৃতিত্ব নাই তবে অনেক গুলো দেশের পতাকার সাথে আমার দেশের পতাকাটাকে একটু ভিন্ন মাত্রায় দেখতে কেমন লাগে তার স্বাধ আমার অর্বাচিন মনে এখনও তাড়না জাগায়। ফুজিইয়োশিদা শহরের মেয়রের সাথে পরিচয় পর্বে অল্প করে সবদেশের জাতীয় সংগীতের সাথে বেজেছিল – আমার সোনার বাংলা। সেই সুখ আসিফ সাহেবের সোনা জয়ের কিংবা ইউনুস সাহেবের নোবেল জয়ের মত না। তবে ছোট্ট পরিসরে শ’খানেক মানুষ সে সময় আমার মুখের দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল তার আকাশ পরিমান গৌরবে আমার বুক ফুলে উঠেছিল, বাংলাদেশ পাহাড়ে যায়। আমরাও পাহাড়ে যাই। আমাদের পতাকাও পাহাড়ে যায়।


শান্তির জন্য পর্বতে।

গেল বছর ২০০৭ এ, ভারতীয়দের সাথে যে উচ্চতায় দলীয় ভাবে পতাকাটাকে নেয়া হল তার স্মৃতি আটকে আছে আমাদের মনে এখনও। সত্যিই ৬১৮৭ মিটার এর পর্বত রুবল কাং এ উঠার আগে কলকাতাস্থ আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনারের হাত থেকে আইস এক্স এ বাধা বাংলাদেশের সেই পতাকাই আমরা নিয়ে গেলাম পার্বতী ভ্যালির ওপার।৩২ দিন ধরে একটা দিনের অপেক্ষা! কেন? মনে হয় সেই পতাকার জের। দেশ বলে কথা। তাই মনে হয় ৪২ বছরে ডজন দুয়েক শিখর আরোহী বসন্তদাও কাদলেন। আমরাও কাদলাম বাংলাদেশের পতাকা ধরে, ভারতের পতাকা ধরে।

মেক্সিকো।

ভাগ্য পরিক্রমায় মাক্সিকোর ইগল্স পিকে আরোহনের সুজোক হয়েছিল এবছরেই। সাথে আমার স্থানীয় বন্ধুরা। ৪৮০০ মিটারের পিকটাতে বাহাদুরির কিছু নাই। তবে পতাকা আকা টি শার্টে সেই নির্মল থিন এয়ারের যাপটা লাগাতে দারুন লাগে আমার। বাংলাদেশ আমার দেশ অন্তত্য কিছু মানুষের দুনিয়ায় প্রকাশ করতে পারাটা আমার মত কারও জন্যই বেশি কিছু।
আর তাই আজও যারা পর্বতারোহন করেন, যখন বাড়তি বোঝা কমানর জন্য সবকিছু ফেলেদেন, কেউ পতাকাটা ফেলে যান না। কেন? আমি জানি না।
এটাও ধর্মান্ধতা, এটাও মৌলবাদিতা, দেশের নামে এবং সেই কথাটার মতই সত্য – at that altitude no one wants to be a nameless orphan.

আর অন্য দেশের ছবি দিতে পারলাম না এ কারনে যে আমি বেশ কিছু দিন যাবত পৃথিবীর পথে আছি এইডস বিষয়ক সচেতেনতা বৃদ্ধির জন্য সামান্য প্রচেষ্টায়।

১৫ ডিসেম্বর, নিউ ক্যসল, অস্ট্রেলিয়া
১২টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×