সারারাত প্রচন্ড বৃষ্টির পর ঢাকার আকাশে ঝকঝকে রোদ।জানালা দিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি ছোট হয়ে আসে।ঢাকার আকাশে এমন ঝকঝকে রোদ আগেও দেখেছে।তবে কেন হুমায়ন নিউয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ বলল? তার মনে হয়, দেশপ্রেমের কিছুটা ঘাটতি ছিল,মনে মনে মুসাফির এমনটি ভাবে।তার নিজেরও দেশপ্রেমের একটু ঘাটতি আছে,তাই এনিয়ে আর হুমায়নকে দোষারুপ করছেনা।কারন তার কাছে মানুষ আগে।
এমননিতে সে এসময়ই ঘুম থেকে উঠে কিন্তু আজকের এই ঝকঝকে রোদের শীতল হাওয়ায় এটাকে দুপুরে টেনে নিয়ে যেত,যদি না আজকের তার নিউমার্কেটে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা না থাকত।হুমায়ুন মারা যাওয়ার পর তার সাথে মনে হয়, আরো অনেকের মৃত্যু ঘটেছে।কিছুদিন আগে জানা গেছে তার অমর সৃষ্টি,সে খালি পায়ে চলা ছাগলটা নাকি আত্মপ্রকাশ করেছে।
অবশ্যই ছাগলটার সাথে তার কিছু মিল থাকায়, তাকে সে পছন্দই করত।তবে খালি পায়ে চলার বিষয়টা তার কাছে পুরাই গাঁজাখুরি মনে হয়।আরে বাবু ইট কংক্রিটের ঢাকা শহরে খালি পায়েতো পাগলও হাটেনা।আত্মপ্রকাশ করা ছাগলটা নাকি, এর মধ্যে একটা বইও লিখে ফেলেছে, নামও দিয়েছে সেরকম ’হিমুরা মরে না’।সে বইটা কিনতেই আজ মুসাফিরের নিউমার্কেট গমন।
বেশ কিছুক্ষণ শ্যামলি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে।বাসের দিকে তাকিয়ে মুসাফির হিসেব করে ফেলল, দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।তাই তার মত বেকারের জন্য স্থান সংকুলান হচ্ছে না।ঝকঝকে রোদ কিছুক্ষণের মধ্যে তকতকে হয়ে উঠছে।সকালের নাস্তাটা এখনও করা হয়নি।ভাবছে নিউমার্কেট গিয়ে বই কেনার পর যা থাকবে তা দিয়ে সকাল দুপুর দুইটাই একসাথে সারবে। কিন্তু সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে ততই পেটে ভূমিকম্প দিয়ে উঠছে।পকেটে মোটের উপর একশ বিশ ত্রিশ টাকা হবে।বইটার দাম কত তা অবশ্য মুসাফিরের জানা নাই।কিন্তু নিউমার্কেটের ফুটফাতই ভরসা।বইয়ের মলাট,লেখা সবই এক;শুধু লেখক কোন স্বত্ত্ব পাবে না।এনিয়ে আগে মুসাফির কিছুটা দ্বিধাদ্বন্ধে ছিল,যে এটা অনৈতিক।পরে যুক্তি দিয়ে নিজেকে পরাস্থ করল যে,আমার মতো গরীবের জন্য লেখক সাহেবদের এটা দান ধরে নেব।যুক্তি দিয়ে হারাতে পারলে মুসাফির ঘরে সিঁদ কাটতেও রাজি।
খোলা ঘরের খাবারে মুসাফিরের বরাবরই একটা প্রীতি আছে।এটা কি অভ্যেস নাকি জাতগত, মুসাফির বুঝেনা।একবার এক অনুষ্ঠানে ফোলাও কোপ্তা খেয়ে তার বমি হয় ব্যাপক।সে থেকেই তার ধারণা, কুকুরের পেটে ঘি হজম হয়না।আবার চিন্তা করে এমনও হতে পারে,বাইরের খাবার খেতে খেতে এসবে সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।খাবার শেষ করতেই একটি গাড়ি এসে থামল।যেখানে ঢুকার জন্য কিছু জায়গা খালি আছে।উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে তার সন্তুষ্টি জানিয়ে দিল। আর ধৈর্যের ফলাফল বরাবরই সে পেয়ে এসেছে। তাই তার সেরা গুণ ধৈর্য।
বাসে উঠতেই কন্ডাক্টর কেবল পেছনে যাওয়ার জন্য বলছে।তার ধারণা,সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু তাকেই বলছে। অবশ্য তার স্বল্প বুদ্ধিতে একটা যুক্তি দাঁড় করালো,তার পোশাকের কারণেই কন্ডাক্টর তাকে পদমর্যাদাগতভাবে তাকে তার চেয়ে নিচে ধরেছে। তাই সে ঝিকে মেরে বৌকে শিখাচ্ছে।কন্ডাক্টরের দোষ কি? অফিসে বস লুঙ্গি পরে আসলেও বস,কারণ সবাই তাকে চিনে। রাস্তা ঘাটে সব অপরিচিত,তাই এখানে পোশাকই পদমর্যাদা ঠিক করে।গোবেচারা মুসাফির,সবাইকে পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবার পেছনে চলে গেল।আর একজনও নড়ল না।
ঝকঝকে রোদ কত আগে তকতকে হয়ে সবাই ঘর্মাক্ত হয়ে গেছে।বাস যায়তো যায় না।মুসাফির বাসের রেলিঙ ধরে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষের আচানক কান্ডকীর্তি দেখছে।এসব তার দেখতে ভালই লাগে।কবির মত,তার কাছেও পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ।হঠাৎ রেলিংয়ের নিচে বসা এক মহিলার দিকে দৃষ্টি পড়ল।বেজায় ক্ষিপ্ত মহিলা।মনে হয়, বাসের ধীরগতিই তার ক্ষীপ্ততার কারণ।ব্যাপক ধৈর্যশীল মুসাফিরের এসবে তেমন কোন রাগ হয় না।
হঠাৎ মহিলাটি বলে উঠল,"আই লাভ ইউ।" মুসাফির কিছুটা থতমত খেল,মনে হল,ড্রাইভার খুব জোরে ব্রেক কষে ধরছেন।তারপরও মুরব্বি মানুষ বলেছে,একটু সৌজন্যতা দেখানো উচিৎ।মুসাফির জিজ্ঞেস করল,”ম্যাডাম কি আমাকে কিছু বললেন?” ”কমবখত ছেলে বলে কি? তোর পেছনের মরুব্বীটাকে দেখছস? আমার স্বামী-তারে বলেছি।” মুসাফির পিছনে ফিরে বুঝল, ভুল একটা করে ফেলেছে,এখানে থাকা ঠিক হবে না।তারপরের সিটেও একই অবস্থা।একপাশে একজন তরুণ- সালমানখান ফিগারের,অন্যপাশে একজন সুন্দরী তরুণী।এটা আরও বিপদজনক জায়গা।মুসাফির একেবারে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
একদম পিছনে বসা লোকটি বলল, ”আপনি কি কানা?বসতে পারেন না?” ”সিটতো ফাঁকা নাই।” ”তাই বলে পশ্চাৎদেশ আমার দিকে দিয়ে দাঁড়াবেন।যান আরেকটু সামনে যান,গরমে জান যায়,তার উপর পশ্চাৎদেশের দেওয়াল।”
ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক মুসাফির একসিট সামনে গিয়ে বাসের রেলিঙ ধরে দাঁড়াল।পেছন থেকে একলোক পেছনে টোকা দিয়ে বলল,”ভাইছাবের,নাম ?” এত সুন্দর করে বলল। মুসাফির খুব বিনয়ের সহিত বলল, ”মুসাফির”। ”বেটা ফহিন্নিরপুত,তুই যে একটা ফহিন্নি তা তোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়,তাও নামটা জিগাইলুম,নামটাও ফহিন্নি,আজিব ব্যাপার! তোর পশ্চাৎদেশ ঘুরা”।এবার মুসাফির কিঞ্চিত রেগে বলল,”দেখেন, আমি ফইন্নি হতে পারি,কিন্তু আমার বাপ ফইন্নি না,আর আল্লাহ আমারে এমন বানিয়েছে,এর জন্যতো আমি দায়ী নয়।” লোকটা একগাল হাসি দিয়ে বলল,”সরবি কিনা বল?” ঠিক তখনই মিহি কন্ঠের মোহনীয় সুরে কে একজন বলে উঠল,”ভাইয়া,আপনি এখানে এসে দাঁড়ান,আমি সামনেই নেমে যাব,আপনি তখন বসতে পারবেন।” মুসাফির তাকিয়ে দেখে সে সুন্দরীজন।মুসাফিরের ধারণা ছিল সব সুন্দরীরা অহংকারী হয়।মনে মনে মুসাফির ভাবল , তার পৃথিবীতে এখনও অনেক কিছু বুঝার বাকী আছে।
শেষ পর্যন্ত বাসটি নিউমার্কেট পৌঁছল।বাস থেকে নামতে গিয়ে ধাক্কা খেল এক মধ্যবয়সী শ্যামবর্ণের দীর্ঘাদেহী নারীর সাথে।হয়তো মহিলাটি ধাক্কা দিতে চাইলেও অনেকে দৌঁড়ে পালাবে।আর উনি মুসাফিরের কলার ধরে বলল,শালা- মাইয়া মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না,ধাক্কা দিতে মন চায়।আজকা তোকে দেখিয়ে দিব ধাক্কা কাকে বলে। মুসাফিরের সকল ধৈর্যতো আতঙ্কে রুপান্তরিত হল।বলল,”আপু, আপু- আমি ধাক্কা দিই নাই।” ”তো আমি ধাক্কা দিয়েছি শালা, এখনই চিৎকার দিয়ে লোক এক করব,তারপর বুঝবি ঠ্যালা।” ”আপু,আমারে মাপ করে দেন,আর এমন হবে না,লোক ডাকলে গণধোলাইয়ে আমি শেষ হয়ে যাব।” ”তাহলে বল,তোর পকেটে কত টাকা আছে?” ”আপু,একশ টাকার মত হবে।” ”শালা ফহিন্নি,ঠিক আছে, ওটাই বের কর।”
ছবিসূত্রঃ-নেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৩৭