somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার দেখা চলচ্চিত্র : মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর টেলিভিশন

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশে ও বিদেশে আলোচিত এবং অনেকগুলি আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর "টেলিভিশন"। আমাদের দেশে আগেই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে, যাব যাচ্ছি করে এতদিন দেরী করে ফেলেছি। গতশুক্রবার বিকেলের শোতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়ে না করতে পারলাম না। কাছের কয়েকজন মানুষকে নিয়ে নির্ধারিত সময়েই বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে উপস্থিত হলাম।

সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় নদীউপকুলবর্তী প্রত্যন্ত একটি গ্রামের চেয়ারম্যান ইসলামী শরিয়তের বিধিনিষেধ এর দোহাই দিয়ে গ্রামে টেলিভিশন দেখাকে নাজায়েজ ঘোষনা দেন। কিন্তু সে নিষেধকে অমান্য করে ঠিকই গ্রামের ছেলেরা পার্শবর্তী গন্জে গিয়ে সিনেমা বা টিভি দেখে আসে, যা প্রতিবাদের আকার ধারন করে যখন গ্রামের হিন্দু স্কুলটিচার নিজের বাসায় টেলিভিশন নিয়ে আসেন। চেয়ারম্যান তাকে টেলিভিশন দেখতে নিষেধ করতে পারেন না যেহেতু টিচার অন্য ধর্মের মানুষ। এখানে খুবই সুক্ষ্মভাবে আমাদের আবহমান গ্রাম-বাংলার আন্তঃধর্মীয়সহনশীলতাকে হাইলাইট করা হয়েছে যেটা প্রশংসা পাবার দাবী রাখে।

গল্প দেখা যায় চেয়ারম্যানের ছেলে চঞ্চল মালয়েশিয়া প্রবাশীর কন্যা তিশাকে ভালবাসে, তাদের পারষ্পরিক যোগাযোগের জন্য তারা মোবাইল এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদিকে দেখা যায় চঞ্চলের সহকারী মোশাররফও পছ্ন্দ করে তিশাকে, কিন্তু তার আর্থিক ও সামাজিক অক্ষমতার কারনে সে তিশাকে তা বলতে পারে না, নিজের সাথে যুদ্ধ করে সে একপর্যায়ে তিশাকে তা বলেও কিন্তু তার সামাজিক ব্যবধানের কারনে তিশার মনের নাগাল কখনও পায় না। কিন্তু তাই বলে সে পুরো হেরেও যায় না, নিজের না পাওয়াটাকে সে কল্পনার সাহায্য নিয়ে চুড়ান্ত জায়গায় নিয়েও যায়, যা কিছুটা আত্মপ্রবঞ্চনাও বটে।

টেলিভিশন দেখা না দেখাকে কেন্দ্র করে তিশার সাথে চঞ্চলের ভুলবোঝাবুঝি এবং তারই ফলশ্রুতিতে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে চঞ্চল। আবার পরে বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তিশার সাথে তার বিয়েও একপর্যায়ে ঠিক হয়ে যায়। আর চেয়ারম্যান বাবা হজ্বের উদ্দেশ্যে ঢাকায় গিয়ে প্রতারকদের হাতে পড়ে। শেষ পর্যন্ত্য হজ্বে না যেতে পেরে কিছুদিনের জন্য যার নিবাস হয় এক আবাসিক হোটেল, সেখানেই তার উপলব্দি ঘটে টেলিভিশন দেখা সবসময় খারাপ নয়। আর এই উপলব্দির মাঝেই গল্পের সমাপ্তি।

এখানে একটু বলে নেই, এ সিনেমাটির লোকেশন ছিলো আমার অরিজিন লক্ষ্মীপুরেরই একটি থানা প্রমত্তা মেঘনার উপকুলবর্তি একটা গ্রাম। আর ভাষাও ছিলো স্ট্যান্ডার্ড বাংলারই একটি আঞ্চলিক রূপ, নোয়াখালীর বাংলা।

সিনেমাটির দারুন কয়েকটি মেসেজ:

গ্রামের চেয়ারম্যান যেকোন কল্পনা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন, যা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। একমাত্র কল্পনাই মানব সভ্যতাকে এতদুর নিয়ে এসেছে, যদি অল্পকিছু মানুষ কল্পনা করার সাহস না দেখাত, আজও আমরা বনবাদাড়ে গাছের ফলমুল ও শিকার করেই চলতাম।

প্রযুক্তির আগমনকে কোনভাবেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না, যা প্রবল শ্রোতের মত সববাধাবিপত্তিকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ যে নিষিদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয় তা দারুনভাবে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে সিনেমার শুরুতে চেয়ারম্যানের সাগরেদ কর্তৃক লুকিয়ে সিনেমার নায়িকাদের ছবি দেখার দৃশ্যে।

সিনেমাটির পজিটিভ দিক:

গল্প, ক্যামেরার কাজ, প্রিন্ট, লোকেশন ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার দারুন ব্যাবহার করা হয়েছে সিনেমাটি জুড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের কোন সিনেমা নিয়ে যদি দেশের বাইরে যদি একটুও আলোচনা হয়ে থাকে তাহলে টেলিভিশন এক নম্বরে থাকবে। সিনেমাটির অভিনেতা-অভিনেত্রিরাও যথেষ্ট ভাল অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে মুল চারটি চরিত্রের একটিতে মোশাররফ এর অসাধারন অভিনয় দক্ষতাই সিনেমাটিকে অনেকটা উতরে দিয়েছে। তিশাও মোটামুটি । তবে চঞ্চল গতানুগতিক, আর চেয়ারম্যান চরিত্রে রুমির অভিনয় সিনেমাটিকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে।

সিনেমাটির সমালোচনা :

তুর্কি ভিজনটেল নামক সিনেমার গল্পচুরির অভিযোগ, যদিও আমি ভিজনটেল সিনেমাটি দেখিনি, তাই পরিষ্কার করে কিছু বলতে অপারগ।

কমপক্ষে বছর ২০ আগের গল্পকে বর্তমানের বাংলাদেশের প্রত্যন্তঅঞ্চলের গল্প বলে চালানো। অনেকে বলবেন ২০ বছর আগের গল্প নিয়েকি সিনেমা হতে পারে না ? উত্তরে বলব, হ্যাঁ পারে। তবে তখন ইন্টারনেট, ভিডিওচ্যাট না আনলে বাস্তব হতো, যেহেতু ইন্টারনেট ভিডিওচ্যাটের গল্প মাত্র কয়েকবছরের পুরোনো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস্তবতায় টেলিভিশন এর এই গল্প কমপক্ষে ১৫-২০ বছরের পুরোনো, যখন ইন্টারনেট বাংলাদেশে আসেইনি।

চলচ্চিত্রটির শেষ দিকে কাহিনী ঝুলে যাওয়া। শেষ ১৫-২০ মিনিট আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আর শেষ হচ্ছেনা, যেটা পরিচালকের পরিষ্কার ব্যর্থতা।

চেয়ারম্যানের মত প্রতাপশালী মানুষ প্রতারকদের হাতে প্রতারিত হবার আজগুবি চিত্র। বরং এখানে ফ্লাইট সিডিউল জটিলতা, বা এধরনের কোন সমস্যা দেখানো বেশী বাস্তব হতো।

এলসিডি টিভি গ্রামে ঢুকছে দেখানো হলো, পুরো গ্রাম যেটা দেখার জন্য ভেঙ্গে পড়ে, অথচ সেই গ্রামে তখনই মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ইউজ করা হচ্ছে। ব্যপারটা আজগুবি নয় ? বরং পিকচারটিউব টিভি দেখিয়ে যদি বলা হতো এটা ২০ বছর আগের বাংলাদেশের চিত্র সেটা বাস্তব হতো। কারন আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীন জনপদে আজথেকে কমপক্ষে ২০-২৫ বছর আগেই সাদাকালো পিকচারটিউব টিভি চলে গিয়েছিলো, আর রঙ্গিন টিভিও গেছে অনেক বছর হয়ে গেছে।

টেলিভিশন এর বাক্সজাতীয় মঞ্চ তৈরী করে হাস্যকর টিভি বানানোর চিত্রটি হাসির খোরাক যুগিয়েছে।

সর্বোপরি কাহিনীর পারস্পারিকতা রক্ষা করা হয়নি, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ভিডিওচ্যাট সবকিছুকে দেখাতে গিয়ে সময় নিয়ে ভাবা হয়নি। যা প্রকটভাবেই চোখে পড়ে।

ব্যান্ডদল চিরকুট এর কানামাছি

চিরকুট এর এই গানটি দারুন মুন্সিয়ানায় চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহার করা হয়েছে। যেটা মুভিটির বোনাসই বলা যায়।

সত্য কি তেতো, সেকি জীবনের মতো?
বেঁচেও মরা নাকি বিভেদের ক্ষত ।
মিথ্যা কি ভুল নাকি নীল নোনা জল?
দেখতে কেমন সে বলো কতো টা অতল।
কানামাছি মিথ্যা , কানামাছি সত্য
কানামাছি তুমি আমি যে যার মতো ।।

তোমার প্রেমে তে আমি বুঁদ হয়ে রই,
তুমি মুখ ফিরিয়ে ডাক কাকে ঐ।
কানামাছি মিথ্যা , কানামাছি সত্য
কানামাছি তুমি আমি যে যার মতো ।।

সুখ যদি এতে তুমি পাওবা অগাধ,
আমি কেনো সাধি তাতে মিছে-মিছি বাধ ।
যার যার মতো করে ভালো থাকা যদি,
সত্যের মতো করে আকি দুই নদী।
কানামাছি মিথ্যা , কানামাছি সত্য
কানামাছি তুমি আমি যে যার মতো ।।


তবে কিছু অসঙ্গতি বাদ দিলে সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটিমানের একটি চলচ্চিত্র, যা এই কিছুটা হলেও এই বাংলার সমাজকেই রিপ্রেজেন্ট করে। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী উত্তরোত্তর নিজেকে যোগ্য পরিচালক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় আছেন সেটা এ সিনেমাটি দেখলে বোঝা যায়। তবে তাকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সেটা না বললেই নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:১৬
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×