যীশু বা ঈসা মসীহ - র উর্ধ্বো আরোহনের পর খ্রীস্টীয় বিশ্বে অনেক ফেরকার আবির্ভাবে ঘটে। তারা যীশুর অবস্থান, তার অমরতা, তার ঈশ্বরতত্ত্ব ও বাইবেলের নতুন নিয়মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহু দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অতপর ৩২৫ খ্রীস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের উদ্যোগে নিকায়ার প্রথম কাউন্সিলে এবং পরবর্তী সময়ে ৩৫৯ খ্রীস্টাব্দে কন্সট্যান্টিনোপোলের কাউন্সিলে ত্রিত্ববাদকেই আনুষ্ঠানিকভানে ঈশ্বর সম্পর্কে খ্রীস্টীয় মতবাদ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। আর খ্রীস্টানদের মধ্যে যারা একেশ্বরবাদী ধারণা পোষণ করতেন তাদের মতবাদ বর্জন করা হয়। নেমে আসে তাদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের নির্মমভাবে নির্মূল করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, খ্রীস্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা বাইবেলের পুরাতন নিয়মে উল্লেখিত সকল নবীকেই সত্য নবী হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্ত্ত মজার বিষয় হলো, আদি পিতা আদম (আঃ) বা তার তৃতীয় পুত্র শীষ (আঃ) বা মহাপ্লাবনের সাক্ষী নুহ (আঃ) বা ইয়াহুদী, খ্রীস্টান ও মুসলিমদের জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ) অথবা ইয়াহুদীদের ফেরাউনের হাত থেকে উদ্ধারকারী মহান নবী মুসা (আঃ) সহ কোন নবীই ত্রিত্ববাদ প্রচার করেন নি। কখনোই করেননি। স্রষ্টা সম্পর্কে তারা একটি মতবাদই প্রচার করেছিলেন, আর তা হলো একত্ববাদ।
যা হোক ত্রিত্ববাদীরা যখন মোটামোটিভাবে একেশ্বরবাদীদের নির্মূল করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিল ঠিক তখনই অনুর্বর মরুর বুকে এক ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করলেন আর প্রচার করা শুরু করলেন একত্ববাদ। তার প্রচারিত মতবাদ খুব দ্রুতই বিস্তার লাভ করলো, রোমান ও পারস্যের ভিত কাপিয়ে দিল, খুব শীঘ্রই রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য স্রষ্টার এই মহা পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করলো। তাইতো পবিত্র কুরআন বলে, "এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী।" [সূরা নং ৩ আল ইমরান: আয়াত নং ৫৪ পবিত্র কুরআন]
আরবের সে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পৃথিবীর বুকে পুন প্রতিষ্ঠিত করলেন একত্ববাদ। পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাকে দিলেন শেষ ঐশী বিধান পবিত্র কুরআন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমেই নবুয়তের সমাপ্তি টানলেন। একত্ববাদ কে এত শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করলেন যে, সময়ের সাথে সাথে অন্য সব মতবাদ বিলুপ্তির পথে ছুটে চলছে। তো পবিত্র কুরআন কি বলে এই ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে? কুরআন বলে, "নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং তারপর তাকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন। যা তোমার পালকর্তা বলেন তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়ো না। অতঃপর তোমার নিকট সত্য সংবাদ এসে যাওয়ার পর যদি এই কাহিনী সম্পর্কে তোমার সাথে কেউ বিবাদ করে, তাহলে বল-এসো, আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী। নিঃসন্দেহে এটাই হলো সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহ; তিনিই হলেন পরাক্রমশালী মহাপ্রাজ্ঞ। তারপর যদি তারা গ্রহণ না করে, তাহলে প্রমাদ সৃষ্টিকারীদেরকে আল্লাহ জানেন। বলুনঃ হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাক আমরা তো অনুগত। " [সূরা নং ৩ আল ইমরান: আয়াত নং ৫৯-৬৪ পবিত্র কুরআন]
পবিত্র কুরআনের আরেক জায়গা্য় আল্লাহ্ কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন তাকে তিনের এক হিসেবে উল্লেখ না করতে, আল্লাহ্ বলেন, "হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল এবং তাঁর বাণী যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং রূহ-তাঁরই কাছ থেকে আগত। অতএব, তোমরা আল্লাহকে এবং তার রসূলগণকে মান্য কর। আর একথা বলো না যে, আল্লাহ তিনের এক, একথা পরিহার কর; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমান সমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তার। আর কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।" [সূরা নং ৪ আন নিসা: আয়াত নং ১৭১ পবিত্র কুরআন]
যারা যীশু বা ঈসা মসীহ্ কে আল্লাহ্ বলে সাব্যস্ত করতে চায় তাদের আল্লাহ্ সরাসরি কাফের (অবিশ্বাসী) বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের আল্লাহ্ তওবা করতে আদেশ করেছেন এভাবে, "তারা কাফের, যারা বলে যে, মরিময়-তনয় মসীহ-ই আল্লাহ; অথচ মসীহ বলেন, হে বণী-ইসরাঈল, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর, যিনি আমার পালন কর্তা এবং তোমাদেরও পালনকর্তা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন। এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই। নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলেঃ আল্লাহ তিনের এক; অথচ এক উপাস্য ছাড়া কোন উপাস্য নেই। যদি তারা স্বীয় উক্তি থেকে নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কুফরে অটল থাকবে, তাদের উপর যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পতিত হবে। তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না কেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে না কেন? আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, দয়ালু।" [সূরা নং ৫ আল মায়েদা: আয়াত নং ৭২-৭৪ পবিত্র কুরআন]
পবিত্র কুরআন বলে যে যীশু কখনোই তার অনুসারীদের তাকে পূজো করার নির্দেশ দেননি। কুরআন বলে, "যখন আল্লাহ বললেনঃ হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি লোকদেরকে বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন; আপনি পবিত্র! আমার জন্যে শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই পরিজ্ঞাত; আপনি তো আমার মনের কথা ও জানেন এবং আমি জানি না যা আপনার মনে আছে। নিশ্চয় আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত। আমি তো তাদেরকে কিছুই বলিনি, শুধু সে কথাই বলেছি যা আপনি বলতে আদেশ করেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন কর যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সর্ববিষয়ে পূর্ণ পরিজ্ঞাত। যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ। আল্লাহ বললেনঃ আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে। তাদের জন্যে উদ্যান রয়েছে, যার তলদেশে নির্ঝরিনী প্রবাহিত হবে; তারা তাতেই চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। এটিই মহান সফলতা। নভোমন্ডল, ভূমন্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।" [সূরা নং ৫ আল মায়েদা: আয়াত নং ১১৬-১২০ পবিত্র কুরআন]
এবার তাহলে আপনাদের মনে প্রশ্ন আসবে তাহলে ঈশ্বর সম্পর্কে ইসলাম কি বলে? এর উত্তরে কুরআন বলে, "বলুন, তিনি আল্লাহ, এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।" [সূরা নং ১১২ আল ইখলাস : আয়াত নং ১-৪ পবিত্র কুরআন]
আরবের বুকে শেষ নবীর আবির্ভাব ঘটানোর জন্য ধন্যবাদ জানাই পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ কে। যিনি আমাদের দেখিয়েছেন সত্য ও সঠিক পথ, মুক্তির পথ।
তথ্যসূত্রঃ
www.quran.com
en.wikipedia.org/wiki/First_Council_of_Nicaea
en.wikipedia.org/wiki/Council_of_Constantinople_(360)
en.wikipedia.org/wiki/Trinity
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



