সবুজ-শ্যামল মানুষের বসবাস উপযোগী আমাদের এই গ্রহ পৃথিবী। পৃথিবীতে যে কত ধরনের বিস্ময়কর বিষয় আছে তা জানলে পৃথিবীকেই মনে হবে একটি বিস্ময়। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, সাগর-মরুভূমি সহ পৃথিবীর আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে হাজারো বিস্ময়। এই সকল বিস্ময়কর বিষয়ের মাঝে ডেড সি বা মৃত সাগর একটি অন্যতম বিস্ময়। ডেড সি বা মৃত সাগরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সাগরের পানিতে কেউ ডুবে না। এমন কি কেউ ডুবতে গেলেও ডুবতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীর সকল খাল, বিল, পুকুর, নদী, সাগরের পানিতে মানুষ সহ যেকোনো জিনিস সহজেই ডুবে যায় কিন্তু ডেড সির পানিতে ডুবে না কেন? কি রহস্য আছে এই পানিতে? ডেড সিতে কি কোনও প্রাকৃতিক শক্তি আছে? আসুন আমরা এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করি।
ডেড সি একটি অতি লবণাক্ত পানি সমৃদ্ধ সাগর। এটি জর্ডানে অবস্থিত। ডেড সি’র পশ্চিমে পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েল, পূর্বে জর্ডান অবস্থিত। জিবুতির আসাল হ্রদের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লবণাক্ত পানির প্রাকৃতিক আধার। মৃত সাগর সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার বা ১,৩৭৮ ফুট নিচে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর ৩১.২০ অক্ষাংশ ও ৩৫.২০ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এন্ডোরেয়িক হাইপার-স্যালাইন ধরনের এই সাগরের পানির প্রধান উৎস জর্ডান নদী। এই সাগরের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার। সমুদ্রের পৃষ্ঠতলীয় ক্ষেত্রফল ৮১০ বর্গ কিলোমিটার। সাগরের গড় গভীরতা ১২০ মিটার বা ৩৯৪ ফুট যার মধ্যে সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৩০ মিটার বা ১০৮৩ ফুট। এই স্থানটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম স্থান বা স্থলভূমি । এই সাগরের পানির লবণাক্ততা শতকরা ৩০ ভাগ যা অন্যান্য সমুদ্রের পানির চাইতে ৮.৬ গুণ বেশি লবণাক্ত ।
ডেড সি’র ইতিহাস:
প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে । ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়। ৭০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সি'র পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল । ২৬,০০০ বছর পূর্বে এটির পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে যায়। প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা নাটকীয় ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে , যা সম্ভবত বর্তমান পৃষ্ঠ উচ্চতার চাইতেও কম ছিল । গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশেপাশে অবস্থান করছে।
মৃত সাগরে কিছু ডুবে না কেন:
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাসাগরের পানির সাথে ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর যথেষ্ট পার্থক্য আছে। মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। এর লবণাক্ততা শতকরা ৩০%। ফলে পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার। এই সকল উপাদানের কারণে ডেড সি’র পানির প্লবতা শক্তি পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের পানির চেয়ে অনেক বেশী। আর এই উচ্চ প্লবতা শক্তির কারণে এই সাগরে কোনও কিছু ডুবে না। যে কেউ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ তে অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেকেও অনুরূপ ভাবে ভেসে থাকা যায়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডেড সি:
বর্তমানে মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে। এর মূল কারণ হিসেবে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি। আবার এখানের বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য, পরাগ রেণুর স্বল্পতা, উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি রয়েছে। উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ থাকার কারণে এই স্থানটি শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। চর্মরোগ সোরিয়াসিস এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী। এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা থাকায় সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে এখানে।
মৃত সাগরের জীব বৈচিত্র্য:
ডেড সি’তে কোনও মাছ নেই, কারণ এই সাগরের পানিতে কোনও মাছ বাস করতে পারে না। তেমনিভাবে এর পাশে জর্ডান নদীতেও কোনও মাছ নেই। এই সাগরের পানিতে কোন উদ্ভিদ বা মাছ বাচতে পারে না বলেই মূলত এই সাগরকে ডেড সি বা মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে। এই সাগরের পানিতে শুধুমাত্র সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায়। ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোশ, খেঁকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে জর্ডান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমি ছিল । রোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু, সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। জেরিকোতে বালসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি । ১৯ শতকের মধ্যে জেরিকোর উর্বরতা হ্রাস পেয়ে শূন্য হয়ে পড়ে।
এই সাগরে কেউ ডুবে না এবং এই জায়গাটি দেখলে মনে হয় এটি একটি অভিশপ্ত স্থান। প্রাকৃতিক উপাদান বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে আমরা জানলাম কেন এই সাগরকে মৃত সাগর বা ডেড সি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই স্থানটি কী অভিশপ্ত? যার কারণে এটি মৃত স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছে! আসুন আমরা এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করি।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মৃত সাগর:
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ডেড সি’র রয়েছে বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে এই স্থানটির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ডেড সি বা মৃত সাগর যে স্বাভাবিক কারণে সৃষ্টি হয় নি সেটা এই ইতিহাসগুলো দ্বারা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এই সকল ইতিহাস গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
ইসলাম ধর্মে:
ডেড সি বা মৃত সাগরের কথা ইসলাম ধর্মে বেশী বলা হয়েছে। এই স্থানটি এরূপ হওয়ার কারণ হিসেবে আল কুরআনের তথ্য গুলো সবচেয়ে বেশী সত্য, সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য। ইসলাম ধর্মে এ অঞ্চলকে হযরত লূত (আঃ) এর অনুসারীদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । লূত (আঃ) এর উম্মতগণ এই এলাকায় বসবাস করতো। তখন এই স্থানটি ছিল স্বাভাবিক এবং মানুষ বসবাসের জন্য খুবই উপযোগী। তৎকালীন সময়ে লূত (আঃ) এর অনুসারীরা চরম পাপে লিপ্ত হয়েছিল। তারা সমকামিতার মতো নির্লজ্জ পাপে মশগুল হয়ে পড়েছিল। সমকামের এই কঠিন পাপাচারের কারণে এই জাতিকে মহান আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। লূত (আঃ) তার অনুসারীদের বারবার পাপ কাজ হতে বিরত থাকার আদেশ প্রদান করে ব্যর্থ হলে এই জাতির পাপের প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ তার ফেরেশতাদের প্রেরণ করেন তাদের কঠিন শাস্তি প্রদান করার জন্য। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা এসে এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এই স্থানের ভূমিকে উল্টে দেন, ফলে পাপিষ্ঠ জাতিটি মাটি চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মাটি উল্টে দেওয়ার কারণে এখানের ভূমি নিচে নিমে যায়। বর্তমান বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে প্রমাণ পেয়েছেন যে, বর্তমানে এই স্থানটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থান। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা রুম এ লূত (আঃ) এর জাতির এই পাপিষ্ঠ ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
খ্রিস্ট ধর্মে:
ডেড সি বা মৃত সাগরের দুর্গম এ অঞ্চল বাইজেন্টাইন শাসকদের আমল থেকে গ্রিক অর্থোডক্স সন্ন্যাসীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করেছিল। ওয়াদি কেল্টে অবস্থিত সেইন্ট জর্জ গির্জা এবং জুদাই মরুভূমিতে মারসাবা মন্দির খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান। এই সকল স্থানে খ্রিস্টানদের যাতায়াত ছিল বহু বছর ধরে।
ইহুদী ধর্মে:
মৃত সাগরের উত্তর তীরবর্তী "জেরিকো" শহরের নামটি ইহুদী ধর্মগ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। বুক অব জেনেসিস এ উল্লেখিত নবী আব্রাহামের সময়কালে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোডম এবং গোমোরা শহর এবং তিনটি "সমতল ভূমির শহর" আদমাহ, জেবোইম এবং জোয়ার শহরের অবস্থান সম্ভবত মৃত সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে বলে ধারনা করা হয়।
মৃত সাগর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী:
পবিত্র বাইবেলে মৃত সাগরের লবণাক্ততা বিলুপ্ত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এজেকেইল এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে "মৃত সাগরের পানি স্বাদু হয়ে যাবে, এমনকি মাছের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে"। জেকরিয়াহ’তে উল্লেখ আছে "জেরুজালেমের পানি দু'ভাগে ভাগ হয়ে যাবে, একভাগ জমা হবে পূর্ব সাগর বা মৃত সাগরে এবং অন্য ভাগ জমা হবে পশ্চিম সাগর বা ভূমধ্যসাগরে।
বর্তমান সময়ে ডেড সি:
মৃত সাগর বা ডেড সি’র পাশ দিয়ে চলে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে নিচু হাইওয়ে "হাইওয়ে ৯০"। সমুদ্র সমতল থেকে ৩৯৩ মিটার নিচে অবস্থিত এ হাইওয়েটি ইসরাইল এবং পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। ব্রিটিশরা উত্তর উপকূলে গড়ে তুলেছিল "সোডম এবং গোমোরাহ" নামের একটি গলফ কোর্স। ইসরায়েলের আরাদ এর নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রধান হোটেলগুলোর নির্মাণ শুরু হয় বিশ শতকের ৬০ এর দশক থেকে। সমসাময়িক কাল থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ফলে জর্ডান উপকূল ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে । ডেড সি বর্তমানে প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সাগর থেকে মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করে থাকে। ২০০১ সালে মৃত সাগর থেকে প্রাপ্ত ব্রাইন থেকে ইসরায়েল ১.৭৭ মিলিয়ন টন পটাশ, ৪৪,৯০০ টন কস্টিক সোডা, ২০৬,০০০ টন ব্রোমিন এবং ২৫,০০০ টন ম্যাগনেসিয়াম ধাতু এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদন করেছিল। জর্ডান প্রান্তে ১৯৫৬ সালে স্থাপিত হয় আরব পটাশ বা এপিসি । যেটি বাৎসরিক ২ মিলিয়ন টন পটাশ উৎপাদন করে ।
পর্যটকদের জন্য ডেড সি:
ডেড সি বর্তমানে একটি পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক ডেড সি দর্শন করতে আসে। তারা ডেড সি’র পানিতে নেমে সাতার কাটে, ডুবে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। অনেকে আবার এই সাগরের পানিতে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। অনেকের মাঝে বিশ্বাস আছে যে, এই সাগরের মাটিতে রোগ নিরাময়ের উপাদান আছে, সেজন্য অনেকে এখানে এসে সাগরের মাটি সমগ্র শরীরে লাগায়।
সবশেষে বলা যায়, ডেড সি’র পানিতে কিছু ডুবে যায় না এটা মানুষের কাছে একটি অতি বিস্ময়কর বিষয়। মানুষ এটা দেখে অবাক হয় আবার হয় আশ্চর্যান্বিত। তবে এই ডেড সি থেকে মানুষের শিক্ষা নেওয়ারও দরকার রয়েছে। কারণ, এখানকার অধিবাসীদের পাপাচারের কারণে ডেড সি’র সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যদি এরকম পাপাচার অব্যাহত রাখে তবে সেই পাপাচারের কারণে আবার কোনও মৃত সাগরের যে সৃষ্টি হবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৯