মোটামুটি ছোটখাটো একটা যুদ্ধ করার পর ব্লগে লেখালেখি করা শুরু করলাম। এতদিন ব্লগের আনাচে-কানাচে হাঁটাহাঁটি করে যা বুঝেছি তা থেকে আর ব্লগে লেখার সাহস হয় না। তবুও চেষ্টা করা যাক।
কিন্তু একী ? সময় যে পাচ্ছিনা মোটেই ! হবে কী আমার তাহলে ? বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম, দেরী হলেও লিখবো। যেহেতু আমি ভাইয়াদের প্রিয়(স্বরচিত ধারনা) নিশ্চয়ই আমার কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবে করা ভুলটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে উনারা দেখবেন। অতএব লিখতে বসে গেলাম।
"অনার্স" শব্দটার সাথে আমার পরিচয় আরো অনেক আগে থেকেই। তবে "সন্মান" হিসেবেই বেশী উচ্চারণ করেছি। "ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর সবাই কোন না কোন ভার্সিটিতে ভাল বিষয়ে "সম্মান" এ ভর্তি হতে চায়, এটাই আমার "অনার্স" বা "সম্মান" বিষয়ক জ্ঞানভান্ডার এর স্বরূপ। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর অন্য আরেকটি "অনার্স" এর সাথে পরিচিত হলাম। কোন পরীক্ষায় ৭৫% নম্বর পাওয়াকে (আমার দৃঢ় বিশ্বাস, "ছাত্রের অর্জন" এবং "শিক্ষকের প্রদান" এর সোনায় সোহাগা কম্বিনেশান না হলে এটি অসম্ভব) "অনার্স পাওয়া" বলে। "ও....ও...ও, ষ্টার মার্কস!!" তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করেছি মনে মনে। যেন আমার কাছে এটা নিতান্তই ডাল ভাত! "সব কিছুতেই পাবো" টার্গেট ও করে ফেলেছিলাম প্রায়।
পরবর্তীতে বোধোদয় হয়েছে। জীবনের ১ম "আইটেম" পরীক্ষা "(ফিমোরাল ট্রায়াঙ্গল)" দেয়ার পরই বাস্তবে আসলাম। মোটামুটি ভাল ছাত্র(!) হওয়া সত্বেও প্লাস (আমার মতে) ভাল প্রিপারেশন ও পারফর্ম করা সত্ত্বেও যখন "নিহাসিনী" (তাঁর মুখে কখনো হাসি দেখিনি বলে এ নামকরণ করলাম) ম্যাডাম আমাকে "সাড়ে ছয়" দিয়ে বিদায় দিলেন (যদিও হাইয়েষ্ট ছিল) ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল।
মেডিকেল কলেজ জীবনের প্রথম পর্বেই বন্ধুদের সগর্বে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলাম (কোন পরীক্ষায়) সে যা লেভেলেই হোক না কেন, "অনার্স" পেলে "আওয়াজ" হবে। অর্থাৎ "আমার বাবার পয়সায় ভুটিভোজ হবে।"
কিন্তু হা হতোস্মি!!!
বিধাতার লীলা বুঝা ভার। আমার ভাগ্যের শিঁকে কখনো ছিড়েনি; তাই কখনও আওয়াজও হয়নি। প্রায় হাল ছেড়ে দিলাম। "হবে না স্যারদের জন্যই" - আমার দৃড় বিশ্বাস। সবই তো বলতে পারলাম ভালভাবে, কোথাও তো আটকালাম না, তাহলে কেন পাবোনা "অনার্স মার্কস"? রাগ,ক্ষোভ,দুঃখ,হতাশা মনে পুষে রাখি একান্তে।
কঠিন বিষয় এ্যানাটমির "চলন্ত ডিক্শনারী" হয়েও যখন "অনার্স" এর শিঁকে ছিড়লো না, তখন ধীরে ধীরে "ফিজিওলজীর" দিকে হাত বাড়ালাম। এটাতেও আমার আগ্রহ ছিল, কিন্তু অন্যদের সাথে পেড়ে উঠতাম না তেমন। ক্যাডেট কলেজ প্রত্যাগত একজন হিসেবে "চৌকস"(!) হলেও "মানবীয় গুনাবলী সমৃদ্ধ" হয়ে উঠতে পারিনি তখনও। ফলে আমার প্রতি অন্যের (শিক্ষক+শিক্ষিকা+ছাত্র+ছাত্রী) আগ্রহ তৈরী করতে সক্ষম হইনি। আর তাছাড়াও বিস্তর ভাবালুতার বিষয় ফিজিওলজী । সরাসরি প্রশ্নের উত্তরের চেয়েও "বেশী" কী যেন চান শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ, কখনই বুঝে উঠতে পারিনি। তাই মগ ডালে থাকলেও "ফলটা" খেতো অন্যেই । ব্যর্থ আমি শুধু হতাশ নয়নে দেখেই যেতাম। তবে একটা কাঁটা আমার মনে বিঁধত সর্বদাই, "সব সময় শুধু মেয়েরাই কেন ভাল ফল পায় ফিজিওলজীতে?"
অতঃপর এলো সেই মহেন্দ্রণ। বিড়ালের ভাগ্যে শিঁকে ছিড়লো। "হার্ট আইটেম" পরীক্ষার আগাম ঘোষণা দিলেন ম্যাডাম । হাতে সাত দিন সময় রেখে ডিসিশান নিলাম, পুরো গ্রে'তে হার্ট সংক্রান্ত যে কয় পাতা আছে তা মুখস্ত করে ফেলবো। "অনার্স" আমাকে পেতেই হবে। সর্বমোট বাইশ পৃষ্ঠা ছিল আমার টার্গেট। নেহায়েতই অপ্রয়োজনীয় বিধায় গোটা কয়েক পৃষ্ঠার মতো বাদ দিলাম। তারপর শুরু হলো সাধনা। "পাগল হলি নাকি নাহিদ?"-বন্ধুদের আশংকা! আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করলাম এবং আমার জন্য দোয়া করতে বললাম। সেই সাথে "আওয়াজ" এর বিষয়টাও স্বরণ করিয়ে দিলাম যা তারা বিস্মৃত প্রায় হয়েছিল। তারা নিজেদের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখা মাত্র উচ্চস্বরে দোয়া প্রার্থনা করতে আরম্ভ করল। একসময় কথাটি একান ওকান ঘুরে ম্যাডামের কানেও গেল। আমি জানতে পারিনি। আমাদের কাউকে তিনি বুঝতেও দিলেন না কিছু। অদ্ভুত ঘোষণা দিলেন , "তিন জন করে আইটেম দিতে আসবে।" বলা বাহুল্য, এর আগে পর্যন্ত আমরা "সিঙ্গেল ইন্টারভিউ" টেকনিকে আইটেম দিচ্ছিলাম। (জনান্তিতে বলি, সেটাই ছাত্রের জন্য উত্তম। কারণ তার দোষ ত্রুটি বন্ধু বান্ধব জানতে পারে না এবং পরবর্তীতে তা নিয়ে হাসাহাসি করার স্কোপও কমে যায়। আবার শিক্ষকের "ইম্প্রেশন"ভাল হলে একটুখানি স্বজনপ্রীতি..............!!) আমরা অবাক হলাম, "ঘটনামাইসিন কি?" অবশ্য রাশভারী ম্যাডাম এর কোন উত্তর দর্শাতে বাধ্য নন।
আমার রোল নম্বর তিন। "তোতলা প্রিন্স" এক, "বাচাল এবং ভয়ংকর দ্রুত গতিতে উত্তর দেয়া ফারাহ দীবা" দুই এবং "আঁতেল অনার্স প্রার্থী" আমি তিন-এভাবেই আসন নিলাম। "এ্যানাটমিক্যাল পজিশনে ধরো এবং পয়েন্টস বর্ণনা করো।" প্রিন্সের পালা আরম্ভ হলো। খেয়ে ফেলো সে বেশ খানিকটা সময় প্রথমতঃ পজিশন মতো ধরতে এবং পরবর্তীতে পয়েন্টের সাথে পজিশন মেলাতে । এবার ফারাহর পালা। উত্তর দিতে দিতে ফারাহ ক্লান্ত হলো, তবুও তার উত্তর শেষ হচ্ছে না। কারণ মুখস্ত বিদ্যায় তাকে হারাতে পারে এমন কারো জন্ম অতীতে হয়নি, বর্তমান ও সুদূর ভবিষ্যতেও হবে না-এ আমার আজীনের দৃঢ় বিশ্বাস।
"থামো এবার"- জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বর। এবার আমার পালা। "তুমি বলো ভাস্কুলার সাপ্লাই অব হার্ট"। কমন পড়ে গেল। অবশ্য পড়বেই তো, গ্রে বলে কথা!!!
আরম্ভ করলাম বড় একটা প্রশ্বাস নিয়ে। তারপর কম্পিটিশান। ফারাহ না নাহিদ, কার মুখস্তের জোর কত? চলছে তো চলছেই, থামার কোন লক্ষণ নেই। "কি বললে?" হঠাৎ ছন্দপতন। "এন্টেরিওর ইন্টারভেন্ট্রিকুলার স্পেসে কোন আর্টারী থাকে এবং সেটি কার ব্রাঞ্চ?" ভ্রু-কুঞ্চিত ম্যাডামের অন্য মূর্তি! আর আমার সবগুলিয়ে গেল। মুখস্ত বিদ্যা গেল আউলে।
এবার ম্যাডামের নাম্বার দেয়ার পালা। প্রিন্স "সাড়ে ছয়" পেয়ে গেল। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ফারাহ্ দীবা "সাত" পেল। তাও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এবার আমার পালা। আমার চেয়ে বেশী আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিন্স আর ফারাহ্ দীবা। "হবে তো ল্ক্ষ্য পূরণ?" ম্যাডাম "সাত" লিখলেন। দুই একবার বাতাসে কলম ঘোরালেন। কী মনে করে তাকালেন সবার দিকে এক পলক। স্মিত হাসি ফিরে এলো তার অবয়বে। তারপর "সাত' এর পাশে কলম রাখলেন। দুরু দুরু বক্ষে আমি এবং তৃষ্ণার্ন্ত চোখে আমার বন্ধু-বান্ধবী তাকিয়ে আছে কলমের গতি প্রকৃতির দিকে।
সেই প্রথম, সেই শেষ। আর কখনো আইটেমে ‘অনার্স’ পাইনি। আর পেতেও চাইনি। কারণ, "আওয়াজ" আমাকে ও মাসের জন্য সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল।
অনেক গল্প করে ফেলেছি আজ। আপাতত এখানেই সমাপ্তি টানছি। আরেকদিন না হয় বলব পুরাতন কোনো ঘটনা, নতুন আঙ্গিকে।
ভালো থাকবেন সবাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


