দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে এসেছি। মাত্র দুই রাত বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছিল। যখন বাড়ি থেকে আসি তখন সবাই মোটামুটি ভালোই আছে। আব্বা আম্মা সামান্য অসুস্থ, বৃদ্ধ বয়সে যেমন হয় আর কি। নানা ধরণের রোগ তো লেগেই আছে। একটা ছাড়ে তো আরেকটা জুড়ে বসে। তবুও ভালোই আছে কোনরকম আগের চেয়ে। ছোট ভাইটি গত মাসেই হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ থেকে এখন মোটামুটি সুস্থ। ঠিকঠাক অফিস করছে। ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ওষুধপত্র খাচ্ছে। ধরতে গেলে ভালোই দেখে আসলাম। আমি যথাসময় নিজের কর্মস্থলে এসে হাজির হলাম, তখন রাত প্রায় নটা বাজে। সেদিন আর ফোন দেওয়া হলো না বাড়িতে, যদিও প্রতিবার বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেই ফোন দিয়ে জানিয়ে দেই যে, এসে পৌঁছেছি। তাতে সবারই একটা চিন্তা দূর হয়। কিন্তু, এবার কেন যেন ফোন দেওয়া হলো না! যাক, ফোন না দেওয়া তেমন কিছু চিন্তার কারণও নেই, কারণ, আমাকে নিয়ে কেউ তেমন একটা চিন্তাভাবনা করেও না। কিন্তু, আমার চিন্তা হয় প্রায় সবাইকে ভেবেই। বাড়ি থেকে আসার পর বাড়ি হতে পরিচিত করোর ফোন রিসিভ করতে ভয়ই লাগে। না জানি কোন খবর শুনতে হয়। মনের মধ্যে অজানা সব চিন্তা বাসা বাঁধে।
এবার বাড়ি থেকে আসার পরেরদিন গতকাল ফোন দিলাম বৌ এর কাছে। প্রথমে সবই ঠিকঠাক মনে হলো। কিন্তু শেষে সবার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো, মনি হাসপাতালে। কথাটা শুনেই ফোন কেটে আমি আম্মার মোবাইলে ফোন দিয়ে শুনতে পারি, আমি যেদিন আসছি ওই দিন রাতেই ছোট ভাইটার বুকের ব্যথায় চিৎকারে আব্বা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম এখন কে আছে, আম্মা বললো তোর বাপ ছিল, এখন মনির বৌ আছে। বাড়িতে লোকেরও অভাব। লোক বলতে বৃদ্ধ বাবা মা আর ছোট ভাইটিই। আমার বউ থাকলেও সে না থাকারই মতো। তার দ্বারা কোন সহযোগিতা আশা করাই বোকামি। যাক, সে বিষয়ে বলতে গেলে অনেক ইতিহাস হয়ে যাবে। মা'র কাছ থেকে ফোন কেটে গ্রামে এক চাচাত ভাইয়ের কাছে ফোন দিলাম যে, সে যদি একটু হাসপাতালে আসে তো। সাদ্দামের কাছে ফোন দিতেই সে বলছে আমি যাচ্ছি নয়ন ভাই, জেঠি আমারে ফোন দিছিলো। আমি একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু এই স্বস্তি রাতে আবার অস্বস্তিতে পরিণত হলো। আম্মার কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারি মনিকে জেলা হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সাদ্দাম আর মনির বৌ আছে শুধু। সাদ্দাম ছোট হলেও হাসপাতালের অনেক কিছুই জানে। গতবারও সে গেছিল মনির সাথে। মনে ভীষণ চিন্তা। কি হবে। ছোট ভাইটির কথা মনে পড়লেই বুকটায় খুব যন্ত্রণা শুরু হয়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আজ সকালে ফোন দিয়ে কাঁন্না আর ধরে রাখাই কষ্টের। আরও চিন্তা হচ্ছে সাদ্দাম নাকি চলে যাচ্ছে, তার আগামী কাল কি যেন পরীক্ষা। সে একটা ডিপ্লোমা কলেজে পড়ছে। তাই চলে যাচ্ছে। এখন শুধু মনির বৌ আছে। সেও চলে যেতে চাচ্ছে। পিচ্চি মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে এসেছে। তাছাড়া দুই রাত দুই দিন হাসপাতালে ঠিক মতো ঘুমোতেও পারেনি। তার বাড়িতে যাওয়া জরুরি হয়েই পড়েছে।
সাদ্দামের কাছে তার চলে যাওয়া শুনে ফোন দিলাম বড় ভাইয়ের কাছে। নূর ভাই বললো, তার আজ যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যেতে পারছে না। কারণ, আগামী কাল তার অফিসের কি এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমার মাথাটা আরও নষ্ট হয়ে গেল। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিনা। সঙ্গি সহকর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী আমার ইউনিট ইন্চার্জ কে বললাম বিস্তারিত। সে বললো দেখছি ফোন দিয়ে। কোথায় ফোন দিবে বোঝতে পারলাম না। যাক, তবুও বেরিয়ে এলাম। এসে গোসল করে মোটামুটি রেডি হয়ে আবার গেলাম। এর ফাকে দশ দিনের মঞ্জুর ছুটির ডিও সংগ্রহ করে রাখলাম। তো স্যারকে এবার ছুটির ডিও দিয়ে বললাম। সে এবারও বলছে চেষ্টা করলাম ফোন ধরছে না। দেখি আবার চেষ্টা করে। বেরিয়ে এলাম। মাথায় কিছু কাজ করছে না। কি করবো এখন। ছোট ভাই হাসপাতালে একা শোয়ে আছে, বাঁচা মরা প্রশ্ন। পাশে কেউ নেই।
কিছুক্ষণ পর আবারও গেলাম স্যারের কাছে, সে এবার বলছে অন্য সুরে। সোজা বলে দিচ্ছে ছুটি বন্ধ। আমি তো অবাক আর বিস্মিত হয়ে রইলাম। কোন লোক ছুটিতে নেই বর্তমানে। তো আমাকে ছাড়া তার পক্ষে কোন বাঁধাই নেই। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কেন বন্ধ কি যেনো বললেন বুঝিনি। সে এবার রাগম্বিত স্বরে বলছে, দুই দিন হল আসলেন, আবার আপনাকে ছাড়তে পারবোনা। আমি বললাম, আমার প্রয়োজন তাই ছুটি যাওয়া দরকার। ছোট ভাই হাসপাতালে, তার কাছে থাকার মতো কেউ নাই। সে বললো বাড়িতে সমস্যা থাকলে ম্যাসেজ দিবে। আমার মুখে আর কোন কথা বের হচ্ছে না। সে কিসের ম্যাসেজ দেওয়ার কথা বোঝাতে চাইল?! রাগে ক্ষোভে দুঃখে চুপ হয়ে রইলাম। ভাবছি এখন কি করবো! এর সাথে কি ঝগড়া করবো! না, চুপ হয়েই রইলাম। মনের অবস্থা খুব খারাপ। কিছুই আর ভালো লাগছে না। বিছানায় শোয়ে রইলাম বেশকিছুক্ষণ। তারপর, আবার বড় ভাইকে ফোন দিলাম, নূর ভাই আমাকে তো ছাড়ছে না। সে বললো থাক, তোর যাওয়া দরকার নেই। আমি যাচ্ছি এখন। আগামীকাল এসে কাজ সেরে আবার যাবো। আমার মনে সামান্য একটু স্বস্তি এলো।
বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আমার ফোন বাজছে। ফোন বের করে দেখি মনির ফোন। তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলাম। কেটে দিয়ে ব্যাক দিবো যদি কানেক্ট না পাই, তাই রিসিভ করে কানে ধরেই ছোট ভাইকে শান্তনা দিতে লাগলাম। ওপাশ থেকে বলছে, ভাই, আমি মনে হয়ে বাঁচবো না, ভাই আমাকে বাঁচাও....। তুমি আব্বাকে একটু বল। আমার বুকের ভিতর আগুন জ্বলছে তখন। বোঝতে পারলাম, কেউ বুঝি তার সাথে নাই। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, তোর সাথে এখন কে আছে। সে বললো কেউ নাই নূর ভাই আসছে তাই শাপলা চলে গেল বাড়িতে। আমি বললাম, হ, নূর ভাই যাইতেছে। তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি আব্বা আম্মার সাথে কথা বলেছি। তোর কিচ্ছু হবে না। প্রয়োজনে মাদ্রাজ নিয়ে যাবো তোকে। তুই কোনরকম চিন্তা করিস না। নূর ভাই যাচ্ছে। আমি যেতে চেয়েও যেতে পারলাম না। কোন চিন্তা করিস না। ফোন কেটে দিলাম। মনের অবস্থা কি করে বোঝাবো। বারবার কেবল ভেসে ওঠছে, 'ভাই আমাকে বাঁচাও, আমি মনে হয় বাঁচবো না'।
কিছুক্ষণ পর বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিলাম। সে ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। শুনে একটু শান্তি লাগছে। তখন আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলাম একা একা। খুউব আফসোস হচ্ছে। হাইরে চাকরি! হাইরে আমার কর্মজীবন! বাবার কথা যদি ছোট সময় শুনে ঠিকমতো লেখাপড়া করতাম, তাহলে আজ ভালো একটা চাকরি করতাম। যেখানে নিজের ছোট ভাইকে হাসপাতালে দেখার সুযোগ অবশ্যই পেতাম।। খুব ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি, নিজের চাকরির প্রতি। আমার কান্না আর আত্ম কষ্টের কোন মূল্য নাই এখানে !!!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৩১