ছেলেটাকে বুকে আগ্লেই হাসেন দুখিনী মা,অথচ
কতশত কষ্টবোধ অন্তরে লুকানো বিমলা'র!
সমাজের অবহেলা আর নির্মম বাস্তবতার সাথে
যুদ্ধ করেই যে চলতে হয় তার প্রতিনিয়ত!
যুদ্ধ করতে হয় বর্ষা রাতে ঘুম থেকে জেগে
ছোট্ট ছনের ঘরের চুয়ে পড়া বৃষ্টির সাথে-
পানি যেন না লাগে গায় আদরের ছোট্ট খোকার।
পেটে ক্ষুধা ছেড়া কাঁথা সমাজের দুঃসহ বৈষম্য
নিয়মিত কঠিন বাস্তবতার নির্মম আঘাতেও
ছেলের মুখ চেয়ে হেসে ওঠেন 'দুখিনী মা বিমলা'!
হয়তো বুনেন মনে নতুন কোন স্বপ্ন-বেঁচে থাকার।
এভাবেই যায়দিন স্বামীপরিত্যক্তা-হয়ে অবহেলিত।
এ'বাড়ি ও'বাড়ি কত খাটুনি খাটতে হয় সারাদিন!
ছেলেকে খাওয়াতে হবে,
ভালো শার্ট-প্যান্ট দিতে হবে কিনে,
বাড়ি বাড়ি করে জ্বি-এর কাজ কতটুকুই তহবিল!
কতদিন নিজে না'খেয়ে তুলে দেয় ভাত ছেলের মুখে,
ভাবে, খোকা একদিন বড় হবে,ঘুচবে সকল আঁধার।।
কত স্বপ্ন আর দারিদ্র্যতার নির্মম কষাঘাতে
পেরিয়ে যায় সময়- দিন মাস বছরের পর বছর।
বেড়ে উঠে দিনদিন আদরের ছোট্ট ছেলে-
পরের বাড়ি কাজ করে- টাকা এনে বলে মা-ধর;
কত আনন্দ তখন-
ফেলে আসা কষ্টের সমাহার বিমলার চোখে মুখে,
অনেক সুখ অনুভবে, লায়েক হয়েছে খোকা তার!
দূর গাঁয়ে কাজ দেয় ছেলেকে,
শুনে দুষ্টবুদ্ধি হারিয়ে বোধ-বিচার,
অধিক অর্থ লোভেই শুনেছি!
একমাত্র ছেলের দূর প্রবাস বিরহে পুড়ায় মা'কে।
বুকে পাথর চাঁপা কষ্ট রেখেও ভাবে-দূরেই থাক!
শূন্যতা না হয় আমাকেই ঘিরে থাকুক দিনরাত,
তাতেও যে হই সুখী- কষ্টই তো জীবন আমার!
বারে বারে আসা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে বিমলা!
কিছুদিন পরপর হতে থাকে মা-ছেলের সাক্ষাত।
ভালোই চলছিল সব,
বিমলার মুখে ফুটেছিল হাসি;
বিপত্তির শুরু যখন বউ নিয়ে ছেলে এল বাড়ি!
দিনরাত ঝগড়াটে বউয়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে
সাধ জাগে বড়ই দেখবার- ছেলের মুখ খুশিখুশি।
তাই কি আর হয় দেখা...!
মায়ের মলিন মুখ, বউয়ের খুচখুচ অত্যাচারে-
বিষিত ছেলের মন-জীবন যেন বড়ই বিতৃষ্ণার!
এমনি করেই পেরোয় বছর কয়েক...!
সব কষ্ট যন্ত্রণা ভুলে যান
যখন ছেলের ঘরে আসে নতুন সন্তান।
নাতি সুখে তৃপ্ত বিমলা আঁকে কতনা সুখের ছবি!
সারাদিন খেলা করে নাতি নিয়ে-ঘুরে বাড়ি বাড়ি।
কিছুদিন পর সেই সুখটুকুনও হারাতেই হয়...!
দুঃখের শ্রাবণে ভাসে বিমলার আঁকা সুখস্মৃতি।
নাতি নাই, ছেলে নাই
নাই তার চোখে ঘুম,
কষ্টের ভারে ক্লান্ত হৃদয়-
দুশ্চিন্তা জমতে থাকে ধীরেধীরে
নয়ন-আকাশে জমে ওঠে মেঘ-বারবার ঝরে বৃষ্টি;
কেমন আছে নাতি-ছেলে!
শহরবাসী সন্তান-বিরহে দুঃসহ যন্ত্রণায় হয় ক্ষয়।
পথের দিকেই চেয়ে চেয়ে ভাসে দুখিনী-মা'র বুক!
ছেলে তার আসবে কবে ফিরে বাড়ি-সেই প্রতীক্ষা,
ঘুমহীন হয় রাতভোর, খাবারদাবারে অমনোযোগ;
দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে শরীর,বেড়ে চলেছে অসুখ।
অবশেষ একদিন সকল অপেক্ষার হলো অবসান;
দুনিয়াজোড়া আঁধারে ঢেকে ফিরে এসেছে সন্তান,
জীবনভর কষ্টের সাথে যুদ্ধজয়ী দুখিনী মায়ের
সেদিন হয়েছিল নির্মমভাবে পরাজয়....!
আশা ভরসার সমস্ত ধার হয়েছিল বন্ধ,সময়ের
নির্মমতায়-আত্মচিৎকারে কাঁপছিল বাতাসের বুক
জনমদুখিনী মা দেখছিল চির-ঘুমন্ত ছেলের মুখ;
স্রষ্টা-বুকেও হয়তো জমেছিল সংশয়...!!
একমাত্র সন্তান শোকেজরজর বিমলা'র অন্তর,
দিনরাত কাঁদেন- সামনেই রাখেন ছেলের কবর;
সমাজের সহযোগিতায় দত্তক দেয়া হয় নাতিন,
একা নিঃস্ব সেই দুখিনী মা'র বিমর্ষ-বদন মলিন।
স্বামীপুত্র হারা নিঃশেষ মা কতই আর দুঃখ সয়!
বিদায়ের আগে হল'না কভু তার পৃথিবী সুখময়।
কতনা অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে ছেড়ে গেছেন দুনিয়া;
আজ ভাবি! ভাসাই দুচোখ তোমাকে মা স্মরিয়া।
'বিমলা' আমার গোষ্ঠীবর্গ। আমার আম্মা 'পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর'-এর ভিজিটর পোষ্টে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে বিমলা জ্বি(ফুফু)কে হয়তো অনেক মা ডেকেছি। তার আদরে শান্ত হয়েছি না জানি কতদিন! আমাদের সংসারে বিমলা জ্বি বেশিরভাগ সময় কাজ করতেন। গ্রামের গৃহস্থালি কাজকর্ম আম্মা একা একা সামলে উঠতে পারতেন না। তাই বিমলা জ্বি-এর সহযোগিতা মনে রাখার মতো। সে(বিমলা জ্বি) তার জীবনে সুখের মুখ দেখতেই পারেনি। আমার যতদূর মনে আছে সে এক সন্তান নিয়ে ভাই ভাবিদের যন্ত্রণাময় কথা সহ্য করে নিজের বাপের ভিটেবাড়িতেই সামান্য একটা ছোনের ঘরেই জীবন পার করেছেন। ফুফুটি আমার শেষ পর্যন্ত বড়ই কষ্ট আর দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে পৃথিবী ছাড়েন একমাত্র ছেলে হারানো শোকেজরজর হয়ে। আমার কেন জানি বারবার মনে পড়ে সেই ফুফুকে। মাঝেমধ্যে নীরব শ্রাবণধারাও বয়ে যায়....। তাই ভাবলাম স্মরণীয় করে রাখি জনমদুখিনী সেই মা'কে। একটা গল্প লেখার ইচ্ছে আছে আমার এই ফুফুকে নিয়ে, অনেকটা লিখেছিও। হয়তো কোনদিন পোষ্ট আকারে প্রকাশ করে রাখবো আমার ব্লগে।
আল্লাহ্ তা'আলা বিমলা ফুফুকে বেহেশত নসিব করুক এমনটাই প্রত্যাশা রাখি সবসময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০৪