somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

:: আজকরে এই দিনে বুরুঙ্গায় পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন ৭৮ জন :: পূর্ণাঙ্গ

২৬ শে মে, ২০০৭ রাত ১১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৭১ সালের ২৫ মে বিকেলে সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গায় এসে খানসেনারা ঘোষণা করে, পরদিন সকালে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সভা করে নির্বিঘেœ চলাফেরার সুবিধার্থে সবাইকে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। আশপাশের প্রতিটি গ্রামের পুরুষরা যেন অবশ্যই সে সময় উপস্থিত থাকেন। এ নির্দেশ শুনে অনেকে আশ্বস্ত হলেও কারো কারো মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে।
পরের দিন সকাল ৮ টার পর হতে এখালাবাসীরা যথারীতি নির্দিষ্ট স্থানে এে জমা হতে থাকেন। আবদুল আহাদ চৌধুরী ও অন্য ক’জন দালালসহ পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন খানের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানী হায়েনাও ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে যায়। এসেই কয়েকজন বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের চার পাশে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যরা পার্শ্ববর্তী কিছু বাড়িতে গিয়ে পুরুষদেরকে সভায় আসার তাগিদ দেয়, লুটপাট করে এবং নারী নির্যাতন চালায়।
সকাল ১০টার দিকে জল্লাদরা উপস্থিত লোকজনকে দু’ভাগ করে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর দিকের ভবনে মুসলমানদেরকে এবং পূর্ব দিকের ঘরে হিন্দুদেরকে নিয়ে রাখে। অল্পণ পর আবার প্রথম ভাগের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয়দেরকে পাশের একটি কে নিয়ে গিয়ে অন্যদেরকে ছেড়ে দেয়। এতে অনেকের মনেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন দালাল আবদুল আহাদ চৌধুরী আশ্বাস দেয়, ‘ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা কাউকে নিমন্ত্রণ করে এনে হত্যা করে না’। একই সাথে কার টাকা-পয়সা ও সোনাদানা কোথায় আছে সে খবর প্রকাশের জন্য চাপ দিতে থাকে।
এভাবে আরও প্রায় এক ঘণ্টা চলে যায়। পশ্চিমা হানাদার দল এক পর্যায়ে এলাইছ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে অস্ত্রের মুখে লাগোয়া বাজার হতে দড়ি আনায়। পরে আটক নেতৃস্থানীয় মুসলমানদেরকে পূর্ব দিকের ভবনে জড়ো করে হিন্দু স¤প্রদায়ের শ’খানকে লোককে বাঁধতে বাধ্য করে। এ কাজ করতে কেউ কেউ অসম্মতি জ্ঞাপন করায় নানা ধরনের হুমকির শিকার হন।
যখন এই বাঁধার কাজ চলছিল, ঠিক তখন নিবাস চক্রবর্তী নামে একজন প্রাথমিক শিক কৌশলে বন্ধ একটি জানালা খুলে ফেলেন। একজন খানসেনা সে সময় বাইরে থেকে ঘরের দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল; কিন্তু সেদিকে ভ্র“পে না করে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার নামে এক যুবক লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে শুরু করলে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ শুরু হয়। তবে দু’জনই নির্বিঘেœ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সম হন।
প্রায় দুপুর ২ টায় বন্দি হিন্দুদেরকে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের সবুজ চত্বরে একটি গাছের নিচে এসে বসানো হয়। ইতিপূর্বে পশ্চিমা জল্লাদরা স্থানটিকে ঘিরে ফেলে এবং ৩টি এলএমজি প্রস্তত করে নেয়। এক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন খানের নিকট থেকে নির্দেশ পাওয়া যায়। অমনি প্রতিটি অস্ত্র ‘খই’ ফোটাতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে একটি পবিত্র অঙ্গন রক্তে লাল হয়ে যায়। তবে বিশিষ্ট আইনজীবী রামরঞ্জন ভট্টাচার্যকে আলাদাভাবে বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে কিছুণ পর হত্যা করা হয়।
পশ্চিমারা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার পরও একজন বাঙালির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিল না। তাই জমির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে বুরুঙ্গা বাজার থেকে দু’টিন কেরোসিন আনিয়ে লুটিয়ে পড়ে থাকা সকলের ওপর ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহতদের আর্ত চিৎকার আর মানুষপোড়া গন্ধে তখন বাতাস ভারী হয়ে উঠে; কিন্তু হায়নার দল বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে পৈশাচিক উল্লাস করতে করতে বেলা ১টা নাগাদ ফিরে যেতে শুরু করে। এসময় বেঁচে গেছি মনে করে গুলিবিদ্ধ একজন উচ্চঃস্বরে স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করামাত্র আবার ছুটে এসে হতাহতদের ওপর আরেক দফা গুলি চালায়। অবশ্য এতকিছু সত্ত্বেও নিবাস চক্রবর্তী, গোপেন্দ্র কুমার দেব, জিতেন্দ্র কুমার বৈদ্য, কামিনী কুমার বৈদ্য, ঠাকুর মণি দেব, শশাঙ্ক দেব ও রঞ্জিত দেবসহ বেশ ক’জন বেঁচে যান, তবে সবাই কমবেশি আহত হন। পরদিন সকালে লাশগুলো পাশেই একটি গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়।
পাক হানাদারদের নৃশংসতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেদিন পিতা ও এক ভাই হারা বর্তমানে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক নিবাস চক্রবর্তী বললেন, ‘মৃত্যু নিশ্চিত জেনে প্রতিরোধের চিন্তা কারো কারো মাথায় এলেও পরিবার পরিজনের কথা ভেবে কিছু করা যায়নি। মুসলমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড যাতে না ঘটে সে চেষ্টা করেছিলেন, আর দালালরা বলেছিল, কাউকে মারা হবে না, শুধু সাজা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। ুদে ব্যবসায়ী জিতেন্দ্র কুমার বৈদ্য জানান, পায়ে গুলি লেগেছিল, তিনি মরার ভান করে লাশের ¯তূপের নিচে পড়ে থেকে প্রাণ বাঁচান। নিজ বুরুঙ্গা গ্রামের বৃদ্ধা রামসণি মালাকার একমাত্র যুবক ছেলে চিত্তরঞ্জন মালাকারকে হারানোর ব্যথার ভারে ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না।
এই হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি জল্লাদদের প্রধান সহযোগী আবদুল আহাদ চৌধুরী স্বাধীনতা উত্তরকালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়; কিন্তু ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। এছাড়া ওই দিন পিয়ারাপুর গ্রামের অমূল্য দেবকে একদল দালাল পার্শ্ববর্তী নন্দীর বাজার থেকে ধরে সেই যে নিয়ে গিয়েছিল আর ঘরে ফিরতে দেয়নি।


(দুপুরে এ সংক্রান্ত পোস্ট দিয়ে বলেছিলাম সাময়িক পোস্ট। কিন্তু এখন এসে দেখি সেখানে দু'একজন কমেন্ট করেছেন। তাই আর মুছলামনা। নতুন আরেকটি পোস্ট দিয়ে দিলাম। অবশ্য ছবি যন্ত্রনায় নতুন পোস্ট দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হল। কেউ কেউ হয়ত এতে লজ্জা পেলেও পেতে পারে। এই পোস্টের জন্য আমার বড়ভাই এবং সিনিয়র সাংবাদিক আল আজাদ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি)

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০০৭ বিকাল ৩:৫৩
২৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×