কিছুটা দুর সম্পর্কেরই আত্মীয় তিনি। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে হতো তার সাথে। আমরা এসেছি, সে খবর পেলেই আসতেন। সদাহস্যময় মানুষটি, নানা রকম হাসি, ঠাট্টা আর গল্পে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। বড়দের সাথে যেমন, ছোটদের সাথেও একই রকম। শান্ত, সৌম্য চেহারা তার, এর মাঝে এত হাসিখুশী ভাব, আমাদের ভাল লাগত। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। নিজের জমিজমা ছিল, সেগুলো অন্যদের দিয়ে চাষ করাতেন। তাতে প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব ছিল না।
তারপর শৈশব আর কৈশোর পেরিয়ে কেটে গেল অনেক সময়। নিজে দেশের বাইরে বহুবছর। যদিও প্রায় প্রতিবছরই দেশে যাই, কিন্তু গ্রামে যাওয়া হয়না সবসময়। এরই মাঝে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে গ্রামীন সমাজেও, প্রতিবারই দেশে গেলে শুনি। গ্রামে যেতেও ইচ্ছে হয়, কিন্তু প্রতিবারই যাই যাই করে পেরিয়ে গেল চৌদ্দটি বছর।
এবার তাই ঠিক করলাম, গ্রামেই যাব। অনেকেই বললো, ওখানে তো নেই কেউ, কি লাভ গিয়ে। কথাটি ঠিক, আপন যারা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই প্রয়াত। আমি বললাম, যারা নেই, তাদের কথা আপাতত: না ভেবে যারা আছে, তাদের কথাই নাহয় ভাবি একবার। দলবল ভারি হতে দেরী হলো না। একদিন সকালে হইহই করে রওয়ানা দিলাম সবাই মিলে। নরসিংদি থেকে লঞ্চে চড়ে ছোট্ট একটি ঘাটে নেমে রিকশা নিতে হয়। আমরা অবশ্য লঞ্চের বদলে একটি বড় ইন্জিন নৌকো ভাড়া করলাম। নামার পর আগে শীতের সময়ে হেটে যেতে হতো পুরো পথ, আর বর্ষার সময়ে নৌকো ছাড়া চলতো না একেবারেই।
চারটে রিকশা করে কাফেলার মতোই চললাম। কোন কোন জায়গায় উচু সেতু তৈরী করা হয়েছে, রাস্তা থেকেও অনেকটা উপরে। তখন নামতে হয় রিকশা থেকে। আমি আর আমার বিদেশী বউ নেমে রিকশা ঠেলতে চাইলে হই হই করে উঠলেন রিকশা চালক। তারপরও ঠেললাম। গ্রামের লোকজন বেশ অবাক দৃষ্টিতেই তাকালেন আমার দিকে।
আমাদের গ্রামটি উত্তর দক্ষিনে প্রায় চার কিলোমিটারের মতো লম্বা, চওড়ায় সিকি কিলোমিটারেরও কম। রিকশায় দক্ষিন দিক দিয়ে ঢোকার পথ। প্রথমেই পড়ে প্রায় আধকিলোমিটার লম্বা হিন্দু পাড়া, তারপর মুসলিমদের বসতি। মাঝামাঝি এলাকায় বাজার আর স্কুল, সেটা পেড়িয়ে সামান্য এগিয়েই আমাদের বাড়ী। আগে দক্ষিন দিক থেকে বিভিন্ন বাড়ীর পাশ ঘেসে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়ীর উঠোন পেরিয়ে উত্তরে যেতে হতো। এখন গ্রামের পুব দিক ঘেষে দক্ষিন থেকে উত্তর পর্যন্ত টানা রাস্তা।
গ্রামে ঢুকেই মনের দিক থেকে হোঁচট খেতে হলো। হিন্দু এলাকার শুরুতেই দেখি এই আধ কিলোমিটারের মাঝেই দু’টো মাদ্রাসা। জোহরের নামাজের সময় হয়েছে, ছাত্ররা মাদ্রাসার চত্তরের সামনে টিউবওয়েলের পানিতে অযু সারছে। আগে এগুলো ছিল না। অনেকদিন পর গ্রামে এলাম, মন আনন্দে ভরাট। তাই বিষয়টি নিজের ভেতরে ততটা গাঢ় হতে দিলাম না। রিকসাও এগিয়ে চলল। আরেকটু এগিয়েই দেখি, এক বাগানের বেড়ায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আমাদেরকেই ডেকে রিকশা থামাতে বলছেন সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক। নেমেই দেখলাম, ইনি সেই আত্মীয়, যাকে পরিচিত করে আমার এই কাহিনীর অবতারনা। আমাদেরকে দেখে খুব খুশী হলেন ওনি। কুশল বিনিময়ের বিভিন্ন আত্মীয়ের খবরাদি নেয়া হলো। দেশে এতোদিন দেরী করে এলাম, এই অভিযোগও হজম করলাম।
হঠাৎ মনে পড়লো, ওনার নিজের বাড়ী আরো উত্তরে ছিল বলে জানতাম। অনেকবারই সেখানে গিয়েছি। ওনি এই বাড়ীতে কেন? আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ওনি সাথে সাথেই ধরে ফেললেন। হেসে বললেন,
- হিন্দুর বাড়ী কিনছি।
- হিন্দুর বাড়ী? তাহলে হিন্দুরা কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।
- ইন্ডিয়ায় পালাইছে।
- ওরা ইন্ডিয়ায় পালালো কেন?
- ডরে পালাইছে। বলেই অমায়িক হাসলেন তিনি।
এবার তার এই অমায়িক হাসি আমাকে আনন্দ দিতে পারলো না। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম। মাদ্রাসা আর বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় বাড়ী কেনার একটি যোগসুত্র খুজে পেতে দেরী হলোনা। হিন্দুরা বাড়ীঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, আর মুসলামনরা তা জলের দামে কিনে নিচ্ছে, এটা এই গ্রামের লোকদের মাঝে একেবারেই গোপন কোন কাহিনী নয়। হিন্দু এলাকার অনেকটাই মুসলমানদের দখলে চলে এসেছে, এটা অনেকেই বেশ গর্ব নিয়েই জানালো।
নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কেন হিন্দুরা পালাবে বাংলাদেশ ছেড়ে, কেনইবা মুসলমানরা পালাবে ভারত ছেড়ে? কেন ধর্ম মানবিক যোগাযোগ, পারস্পরিক অবস্থানের মাঝে এত বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, যে মানুষকে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়? ঈশ্বরের ছত্রচ্ছায়ায় মানুষের মাঝে মানবতা, সৌহাদ্র আর শান্তির বানী পৌছে দেবার উদ্দ্যেশ্যে ধর্মের অবতারনা ঘটেছে পৃখিবীতে বলে দাবী করা হয়। এই দাবীর যথার্ততার প্রমান কি এই? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোন নিস্পেষন নেই, এই দাবীরও যথার্ততার প্রমান কি এই?
জানি, আমার এই প্রশ্নগুলো একেবারেই নতুন নয়। কিন্তু অনেক সময়ে পুরোনো ব্যথাই আরো অনেক বেশী ভয়ংকর হয়ে চেপে বসে বুকের ভেতরে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



