ভূমিকাঃ ইসলাম মানুষের জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও শ্বাশত জীবন বিধান। এতে মানব কল্যাণের যাবতীয় দিক বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের মূল উৎস হল আল্লাহর 'অহি' তথা পবিত্র কোরআন ও হাদীস। আল্লাহ তায়ালা নিজেই যিক্র তথা অহি-কে হেফাযত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, "আমিই উপদেশ (সম্বলিত কোরআন) নাযিল করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষণকারী।" {সূরা আল হিজর, আয়াত ৯}। এই ঘোষণা পূর্বেকার কোন আসমানী কিতাব সম্পর্কে তিনি দেননি। ফলে সেগুলির কোন অস্তিত্ব এখন পৃথিবীতে নেই। অনেকের ধারণা 'যিক্র' বলে আল্লাহ কেবল কোরআনের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন, হাদীসের নেননি। একথা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ পাক অনত্র বলেন, "(আজ) তোমার কাছেও কিতাব নাযিল করেছি, যাতে করে যে (শিক্ষা) মানুষদের জন্যে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, তুমি তা তাদের সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে পারো, যেন তারা (নিজেরাও একটু) চিন্তা ভাবনা করে।" {সূরা আন নাহল, আয়াত ৪৪}। আর কোরআনের ব্যাখ্যাই হল হাদীস। যা রসূল (স.) নিজ ইচ্ছা মোতাবেক বলতেন না, যতক্ষণ না তাঁর কাছে 'অহি' নাযিল হত। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, "সে কখনো নিজের থেকে কোনো কথা বলে না, বরং তা হচ্ছে 'অহী', যা (তার কাছে) পাঠানো হয়" {সূরা আন্ নাজম, আয়াত ৩-৪} রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, "জেনে রেখ! আমি কোরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্তু" {আবূ দাঊদ, মিশকাত হা/১৬৩}। সে বস্তুটি নিঃসন্দেহে 'হাদীস', যার অনুসরণ ব্যতীত কেউ মুমিন হতে পারবে না। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, "আমি তোমার মালিকের শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারবে না, যতোক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের ফয়সালায় তোমাকে (শর্তহীনভাবে) বিচারক মেনে নেবে, অতঃপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তাদের মনে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না, বরং তোমার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।" {সূরা আন্ নিসা, আয়াত ৬৫}
অনেকের ধারণা কেবল লেখনীর মাধ্যমেই হেফাজত হয়, স্মৃতির মাধ্যমে নয়। তাদের একথা ঠিক নয়। কেননা প্রাচীন পৃথিবীতে কাগজ ছিল না, তখন শিলালিপি ইত্যাদি ছাড়াও প্রধান মাধ্যম ছিল মানুষের 'স্মৃতি'। জাহেলী যুগে আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তীর মত। যা আজকালকের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। শেষ নবীকে আরবে প্রেরণের পিছনে সেটাও অন্যতম কারণ হতে পারে। এরপরেও রসূলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনায় "কোরআন" লিপিবদ্ধ ও সন্নিবেশিত করা হয়েছে। হাদীস লিখনের কাজও তাঁর নির্দেশে শুরু করা হয়। যদিও ব্যাপকহারে সবাইকে তিনি এ নির্দেশ দেননি। কেননা তাতে কোরআনের সাথে হাদীস মিলে যাবার সম্ভাবনা থেকে যেত। রসূলের মৃত্যুর পরে উক্ত সম্ভাবনা তিরোহিত হবার পর সাহাবীগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনে মনোনিবেশ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীন হাদীস অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীয (৯৯-১০১হিঃ) সর্বপ্রথম ব্যাপকহারে হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্ত রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করেন ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন {বুখারী ১/২০}
কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে খারেজী-শীআ, ক্বাদারিয়া-মুরজিয়া ইত্যাদি বিদ'আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা সমূহের উদ্ভব ঘটলে তাদের মধ্যে নিজেদের দলীয় স্বার্থে হাদীসকে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দেয়। ৩৭ হিজরীর পরের যুগে তখনই প্রথম হাদীস বর্ণনাকারীর দলীয় পরিচয় ও স্বভাব-চরিত্র যাচাইয়ের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীণ (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন, এসময় যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তি 'আহলেসুন্নাত' দলভুক্ত, তাহলে তার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হত। আর যদি দেখা যেত বিদআতী দলভুক্ত, তাহলে তার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হতো না {মুক্বাদ্দামা মুসলিম, পৃঃ ১৫}। বলা বাহুল্য, মুসলিম সমাজে প্রচলিত শিরকী আক্বীদা ও বিদআতী রসম-রেওয়াজ সমূহের অধিকাংশেরই মূল উৎস হল জাল ও যঈফ হাদীস সমূহ।
আল্লাহ পাক মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত স্বীয় 'যিক্র' তথা সর্বশেষ 'অহি' পবিত্র কোরআন ও হাদীস সমূহকে হেফাযত করার জন্য যুগে যুগে অনন্য প্রতিভাসমূহ সৃষ্টি করেছেন। সাহাবী ও তাবেঈগণের যুগ শেষে বিস্ময়কর মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ কুতুবে সিত্তাহ্র মুহাদ্দিসগণ ছাড়াও যুগে যুগে হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাঁর বাছাইকৃত কিছু বিদ্বান চিরকাল হাদীসের খেদমত করে গিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর অতুলনীয় প্রতিভা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) তাঁদের অন্যতম। তিনি সহীহ ও যঈফ হাদীসের উপর পৃথক গ্রন্থসমূহ সংকলন করেছেন। যার প্রতি খন্ডে ৫০০ যঈফ ও মওযু হাদীস সংকলিত হয়েছে। এযাবৎ প্রাপ্ত এর ১৫টি খন্ডের মধ্যে প্রথম ৩টি খন্ডের বঙ্গানুবাদ করেছেন আবূ শিফা মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন বিন বাদীউয্যামান। মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী জানতে এ লাইনটির ওপর ক্লিক করুন।
মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) ১৫-এর অধিক খন্ড বিশিষ্ট যে এক বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে তিনি পূর্বের সকল মুহাক্কিক মুজতাহিদ মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ আলেমদের মতামতকে সামনে এনে কোন হাদীসটি কেন জাল, কেন য'ঈফ তার সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটি খন্ডের প্রতিটি হাদীসের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমি এখানে সে সব বিস্তারিত আলোচনা উল্লেখ না করে শুধুমাত্র মূল হাদীসটি এবং হাদীসের শেষে সেটা য'ঈফ বা জাল বা বাতিল কিনা তা উল্লেখ করছি। যদি কেউ কোনো হাদীসের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান তবে মন্তব্যের ঘরে তা দেয়া হবে ইন্শাল্লাহ। ধন্যবাদ।
১। দ্বীন [ধর্ম] হচ্ছে বিবেক, যার দ্বীন [ধর্ম] নেই তার কোন বিবেক নেই। {হাদীসটি বাতিল}
২। যে ব্যক্তির সালাত তাকে তার নির্লজ্জ ও অশোভনীয় কাজ হতে বিরত করে না, আল্লাহর নিকট হতে তার শুধু দূরত্বই বৃদ্ধি পায়। {হাদীসটি বাতিল}
৩। পুরুষদের ইচ্ছা (মনোবল) পর্বতমালাকে স্থানচ্যুত করতে পারে। {এটি হাদীস নয়}
৪। মসজিদের মধ্যে কথপোকথন পূণ্যগুলোকে খেয়ে ফেলে যেমনভাবে চতুস্পদ জন্তুগুলো ঘাস খেয়ে ফেলে। {হাদীসটি ভিত্তিহীন} [এটি একটি বহুল প্রচলিত হাদীস]
৫। কোন বান্দা একমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে যখন কিছু ত্যাগ করে, তখন আল্লাহ তাকে তার দ্বীন ও দুনিয়াবী ক্ষেত্রে তার চাইতেও অতি কল্যাণকর বস্তু প্রতিদান হিসাবে দান করেন। {এ ভাষায় হাদীসটি বানোয়াট}
৬। ধূলিকণা হতে তোমরা বেঁচে চল, কারণ ধূলিকণা হতেই জীবাণূ সৃষ্টি হয়। {হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই}
৭। দু'টি বস্তুর নিকটবর্তী হয়ো না, আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা এবং মানুষের ক্ষতি সাধন করা। {হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই}
৮। তুমি দুনিয়ার জন্য এমনভাবে কর্ম কর, যেন তুমি অনন্ত কালের জন্য জীবন ধারণ করবে। আর আখেরাতের জন্য এমনভাবে আমল কর, যেন তুমি কালকেই মৃত্যুবরণ করবে। {মারফূ' হিসাবে হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই}
৯। আমি প্রত্যেক পরহেজগার (সংযমী) ব্যক্তির দাদা। {হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই}
১০। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাকে হালাল রুযি অন্বেষণের উদ্দেশ্যে পরিশ্রান্ত অবস্থায় দেখতে ভালবাসেন। {হাদীসটি জাল}
১১। আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষাদানকারী হিসাবে। {হাদীসটি য'ঈফ (দুর্বল)} [এটি একটি বহুল প্রচলিত হাদীস]
১২। আল্লাহ দুনিয়ার নিকট ওহী মারফত বলেছেন যে, তুমি খেদমত কর ঐ ব্যক্তির যে আমার খেদমত করে আর কষ্ট দাও ঐ ব্যক্তিকে যে তোমার খেদমত করে। {হাদীসটি জাল}
১৩। শামের অধিবাসীরা আল্লাহর পৃথিবীতে তাঁর চাবুক। তিনি তাদের দ্বারা তাঁর বান্দাদের থেকে যাকে চান শাস্তি দেন। তাদের মু'মিনদের উপর তাদের মুনাফিকদের প্রাধান্য বিস্তারকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। তাদের মুনাফিকরা শুধুমাত্র চিন্তা ও অস্থির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে। {হাদীসটি দুর্বল}
১৪। তোমরা তোমাদেরকে এবং সার দেয়া ভূমির সবুজ বর্ণকে রক্ষা কর। জিজ্ঞাসা করা হল, সার দেয়া ভূমির সবুজ বর্ণ কী? (উত্তরে রসূল) বললেন, নিকৃষ্ট উৎপত্তি স্থল হতে জন্মগ্রহণ করা সুন্দরী নারী। {হাদীসটি নিতান্তই দুর্বল}
১৫। শাম দেশ আমার তীর রাখার স্থল। যে তার কোনরূপ অনিষ্ট করার ইচ্ছা করবে, আমি তাকে সেখানকার তীর দ্বারা আঘাত করব। {মারফূ' হিসাবে হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই}
১৬। আমার উম্মাতের দু'শ্রেণীর লোক যখন ঠিক হয়ে যাবে, তখন মানুষ ভাল হয়ে যাবে। নেতাগণ এবং ফাকীহ্গণ। (অন্য বর্ণনায় এসেছে 'আলেমগণ')। {হাদীসটি জাল} [এটি একটি বহুল প্রচলিত হাদীস]
১৭। যে ব্যক্তি হাসতে হাসতে গুনাহ করবে, সে কাঁদতে কাঁদতে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। {হাদীসটি জাল}
১৮। তোমরা পরকাটা কবুতর গ্রহণ কর, কারণ তা তোমাদের বাচ্চাদের (সন্তানদের) থেকে জ্বিনকে বিমুখ করে দেয়। {হাদীসটি জাল} [এটি একটি বহুল প্রচলিত হাদীস]
১৯। তোমরা তোমাদের নারীদের মজলিসগুলো প্রেমালাপের দ্বারা সৌন্দর্য মন্ডিত কর। {হাদীসটি বানোয়াট}
২০। তোমাদের দস্তরখানগুলো সবজি দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত কর, কারণ তা বিসমিল্লা বলে আহার করলে শয়তানকে বিতাড়নকারী যন্ত্র। {হাদীসটি বানোয়াট}
চলবে ...
মূলঃ আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)
অনুবাদঃ আবূ শিফা মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন বিন বাদীউয্যামান
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৩