কবরে যা প্রশ্ন করা হবে
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
"কুল্লু নাফছিন যাইকাতুল মাউত।"
অর্থাৎ "জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী।" {সূরা আনকাবুত, ২৯:৫৭}
অনুরূপ সূরা আল-ই-ইমরান {৩:১৮৫} এবং সূরা আল আম্বিয়ায় {২১:৩৫} উল্লেখ করা হয়েছে "জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।"
স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের দুনিয়ার আয়ুষ্কাল যেদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে সেদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমাদেরকে কবরে রাখার পরপরই মুনকার-নকীর প্রশ্ন করবে, "বল, তোমার রব কে; তোমার দ্বীন কি" এবং রাসূলের (সঃ) সূরত মোবারক দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, "ইনি কে?" তখন অথবা পরবর্তীতে হাশরেও কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হবে না, "তোমার মাযহাব কি; তুমি কেন অমুক ইমামের তরীকা মোতাবেক চলনি" ইত্যাদি। বরং জিজ্ঞাসা করা হবে, "তুমি কেন রাসূলের (সঃ) নির্দেশিত তরীকা (বা মাযহাব) মোতাবেক চল নাই?"
রাসূল (স.)-এর সালাত এবং সাধারণ মুসল্লীদের সালাত আদায়ের মধ্যে ভিন্নতার কারণ
আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বাস্তব সালাত এবং রাসূলের (স.) সালাতের তরীকার মধ্যে সচরাচর অনেক পার্থক্য দৃশ্যমান হয়। অথচ সহীহ হাদীস অনুযায়ী রাসূলের (স.) সালাতের একটি মাত্রই নিয়ম ছিল। তবে কোন কোন সময় কোন কোন বিষয়ে কিঞ্চিৎ পার্থক্য দেখা দিত। যেমন, তিনি কখনো সালাতকে লম্বা করতেন আবার কখনো সংক্ষিপ্ত করতেন, এমনি ভাবে সিনার উপর হাত রাখার পর কখনো ডান হাতকে বাম বাহুর উপর রাখতেন, আবার কখনো কব্জির উপর রেখে ধরতেন, আবার কখনো হাতের উপর হাত রাখতেন। এমনি ভাবে রাফ'উল ইয়াদাইন করতে কখনো তিনি কাঁধ পর্যন্ত আবার কখনো কান পর্যন্ত হাত উঠাতেন। মোট কথা এই পার্থক্যগুলি ছিল শুধু বাহ্যিক কার্যভঙ্গি এবং লম্বা ও সংক্ষিপ্ত করার ব্যাপারে, কিন্তু কাজটি করার ব্যাপারে কোন পার্থক্য ছিল না। এই পার্থক্যের মূল কারণগুলি হল রাসূল (স.)-এর সালাত আদায় পদ্ধতি সম্বন্ধে অজ্ঞতা, মাযহাবগত ভ্রান্ত ধারণা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
ইসলামে বিভিন্ন দল/ফিরকা সৃষ্টি
রাসূল (স.) বলেছেন, "বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে।" সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, "হে আল্লাহর রাসূল (স.), সে দল কারা?" উত্তরে রাসূল (স.) বললেন, "আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে তরীকার উপর চলছে, যে দল সেই তরীকা মত চলবে সেই দলই বেহেশতী।" (তিরমিজী)
রাসূল (স.)-এর পর খোলাফায়ে রাশেদীন এই কোরআন ও সুন্নাহর জীবন ব্যবস্থার উপর কায়েম ছিলেন, এক চুল পরিমাণও ব্যতিক্রম ঘটতে দেননি। পরবর্তীকালে অন্যান্য সাহাবা ও তাবেয়ীগণও কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে কিছুমাত্র রদবদল হতে দেননি। বরং রাসূল (স.)-এর কোন হাদীস তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলে বিনা শর্তে তা মেনে নিতেন। সাজাবা কেরাম ও তাবেয়ীগণের পরবর্তী যুগে যেমন নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের লোক ইসলামের পতাকা তলে আসতে লাগল তেমনি তাদের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধর্মমত ও দার্শনিক মতবাদও আসা শুরু হল। ফলে, মুসলিমগণ নীতিগতভাবে এক আল্লাহকে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী ও তাঁর রাসূল (স.)-কে একমাত্র নেতা বলে স্বীকার করলেও কার্যতঃ তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে ইসলামের প্রকৃত নীতি হতে সরে যেতে লাগল এবং কোনো কোনো সম্প্রদায় একেবারে ইসলামের গন্ডীর বাইরে চলে গেল। ফলে, মুসলিম জাতীয় জীবনে ভাঙ্গন শুরু হল। তারা রাসূল (স.)-এর নেতৃত্ব ত্যাগ করে বিভিন্ন নেতার অধীনে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এভাবে ইসলামে শুরু হল ফিরকাবন্দী। অখন্ড ইসলাম হয়ে গেল খন্ড বিখন্ড।
বিভিন্ন দল/ফিরকার সংখ্যা
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তাঁর "৭৩ ফিরকার বিবরণ" গ্রন্থে সমগ্র মুসলিমগণকে প্রথমতঃ ১০ ভাগে বিভক্ত করেছেন, যথা- (১) আহলে সুন্নাত, (২) খারিজী, (৩) শিয়াহ, (৪) মুতাজিলা, (৫) মুরজিয়া, (৬) মুশাব্বিয়া, (৭) জাহমিয়া, (৮) জরারিয়াহ, (৯) নাজ্জারিয়া এবং (১০) কালাবিয়াহ।
উপরোক্ত দলগুলির মধ্যে মুক্তি পাওয়ার যোগ্য দল হল আহলে সুন্নাত কারণ একমাত্র এরাই কোরআন ও সুন্নাহ অবলম্বন ও অনুসরণ করে থাকেন এবং প্রমাণস্থলে উভয়কেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
অন্য ৯টি দল হতে বাহাত্তরটি উপদল বা ফিরকার সৃষ্টি হয়েছে। এ দলগুলো সাহাবাদের বহু জামানার পর সৃষ্টি হলেও কোন কোন সাহাবাদের জীবদ্দশায় দু একটি বিদ'আতের সূত্রপাত হয়েছিল। সাহাবাগণও সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোর প্রতিবাদ করেছেন। একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) শুনলেন যে কিছু লোক মসজিদে সমবেত হয়ে হালকাবদ্ধভাবে বসে (অর্থাৎ কয়েকজন গোল হয়ে বসে) লাইলাহা ইল্লাল্লাহু, সুবহানাল্লাহ ও দরূদ প্রভৃতি পাঠ করছে। এই খবর পাওয়া মাত্র তিনি মসজিদে এসে সমবেত লোকদের বললেন, "হে লোক সকল, রাসূল (স.)-এর ইন্তেকালের পর এখনও খুব বেশী দিন অতীত হয়নি, তাঁর পরিধেয় বস্ত্র এখনও বিদ্যমান রয়েছে, আর তোমরা এখনই তাঁর শরীয়তকে পরিবর্তন করতে আরম্ভ করে দিয়েছ? দেখ, আমি রাসূলের (স.) যামানায় এভাবে কলেমা ও দরূদ পাঠ করতে দেখিনি।" এভাবে সতর্কবাণী করতে করতে তিনি তাদের মসজিদ হতে তাড়িয়ে দিলেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী তাঁর উপরোল্লিখিত গ্রন্থে উক্ত নয়টি দল যে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে সেগুলির নাম উল্লেখ করেছেন নিম্নোক্তভাবেঃ
১ম দল - খারেজী - এরা ১৫টি দলে বিভক্ত
২য় দল - শিয়া - ৩ দলে বিভক্ত, এই ৩টি দল আবার যথাক্রমে (i) ১২, (ii) ৬ ও (iii) ১৪টি উপদলে বিভক্ত
৩য় দল - মুতাজিলা - ৬টি দলে বিভক্ত
৪র্থ দল - মুর্জীয়া - ১২টি দলে বিভক্ত
৫ম দল - মুশাব্বিয়া - এরা ৩টি দলে বিভক্ত
অবশিষ্ট ৪টি দল হল জহমিয়া বা জব্রিয়াহ, জরারিয়াহ, নজ্জারিয়াহ বা ছেফাতিয়াহ এবং কালাবিয়াহ।
মোট ৭২ উপদল বা ফিরকা
উপরোক্ত দল/উপদলগুলি বহু যামানা পরে সৃষ্টি হলেও কোন কোন সাহাবার জীবদ্দশায়ই দু একটি বিদ'আতের সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু সাহাবাগণ সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই এর ঘোরতর প্রতিবাদ করেছেন। (তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া, ১ম খন্ড; মোহাম্মদ মতিউর রহমান মোহাম্মদী সালাফী)
চলবে ...
* তথ্য-উপাত্তগুলো সংকলন করেছেন মুহাম্মদ আবু হেনা