গত কয়েকদিন আগে ক্যাম্পাসে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ছাত্রাবাসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। ল্যাপটপ বের করে ইউনিভার্সিটির ফ্রি নেট লাইন থেকে কেবল দিয়ে লাইন টেনে নিয়ে ইউটিউব ভিডিও দেখছিলাম। কারণ, এখান থেকে যতখুশি নেট ইউজ করা যাবে কোন সমস্যা হবে না। আমার ব্যক্তিগত লিমিটেড নেট প্যাকেজ থেকেও কিছু কমবে না; তাহলে ভিডিও দেখতে সমস্যা কোথায়?? এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে স্বনামধন্য স্কলারদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ডাউনলোড করে নিলে তো খারাপ হয় না।
বিভিন্ন স্কলারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার ভিডিও এবং কুরআনিক মিরাকেলের উপর কয়েকটা জার্নালসহ ৫/৭ গিগাবাইট ফাইল ডাউনলোড করলাম। ডাউনলোডের পাশাপাশি বিভিন্ন ভিডিও দেখছিলাম এবং বিভিন্ন সাইট ব্রাউজ করছিলাম। ইউটিউবে সামনে পড়ল একটা ভিডিও। সেটার শিরোনাম ছিল এমন, ''ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর হাস্যকর কমেন্ট'' ভিডিওটা আল জাজিরা টিভি থেকে নেয়া। কেউ আপলোড করে দিয়েছে ইউটিউবে। সেখানে একটা বিতর্ক হয়েছিল আরব দেশের কোন একজন আলেম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী একজন লোকের মাঝে। আলেমটা অবশ্য আমার পরিচিত নয়; হয়ত আরবদেশের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হবেন।
তাদের আলোচনা ও বিতর্কের এক পর্যায়ে উক্ত আলেম জানতে পারলেন, লোকটা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী। তখন কথার মোড় ঘুরে গেল।
আলেমঃ আপনি কি ধর্ম নিরপেক্ষ??
লোকটাঃ হ্যাঁ, আমি ধর্ম নিরপেক্ষ।
আলেমঃ আপনি কি ধর্ম নিরপেক্ষ নাকি মুসলিম??
লোকটাঃ আমি মুসলিম এবং ধর্মনিরপেক্ষ।
আলেমঃ আশ্চর্য!!! আপনি একসাথে ধর্মনিরপেক্ষ এবং মুসলিম কেমন করে হতে পারেন? হয়ত আপনি মুসলিম হবেন অন্যথায় ধর্মনিরপেক্ষ হবেন।
লোকটাঃ না, আমি মুসলিম ঠিকই কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাস করি!!
আলেমঃ দুইটা তো দুই মেরুর বিষয় এ দুইটা একত্রিত হবে কেমন করে?
লোকটাঃ কেন একত্রিত হবে না? হতেই পারে। একজন লোক মুসলিম হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাস করতেই পারে।
আলেমঃ আচ্ছা!! শুনেন, কেউ যদি বলে আমি "মুসলিম-ইহুদী" তাহলে কি সেটা মেনে নেয়া যায়? একই লোক কি কখনও একই সাথে মুসলিম এবং ইহুদী হতে পারে??? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদও সেরকমই একটা বিষয়। [এটা অন্যান্য ধর্মের মতই একটি ধর্মের মত]
এ ভিডিওটির পরবর্তী অংশ আর তালাশ করে পাইনি।
আসলেই, কেউ যদি বলে- আমি মুসলিম এবং ধর্ম নিরপেক্ষ; তাহলে বুঝতে হবে লোকটা মিথ্যাবাদী। কেননা, একজন লোককে খাটি ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে তাকে অবশ্যই ইসলাম বা অন্য যেকোন ধর্ম ত্যাগ করতে হবে; অন্যথায় সে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিগণিত হবে না। ধর্ম নিরপেক্ষ হতে পারে শুধুমাত্র সেই লোক যে কোন ধর্মে বিশ্বাস করেনা এবং নাস্তিক। অন্যরা যদি বলে আমি ধর্মনিরপেক্ষ তাহলে সে মিথ্যাবাদী বলেই পরিগণিত হবে।
অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ কি জিনিস?? তাহলে আসুন!! জেনে নেই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ কি জিনিস???
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বাংলা শব্দ। যার ইংরেজী হচ্ছে Secularism. আরবীতে বলে العلمانية এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল পরিভাষা। এজন্য এটাকে ইন্টারন্যাশনাল ভাবেই বুঝতে হবে।
বহিঃবিশ্বে আমরা অনেককেই জিজ্ঞাসা করে দেখেছি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে তারা সকল ধর্ম থেকে পৃথক একটা বিষয়ই বলে মনে করে থাকে। অর্থাৎ, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ইসলাম যেমন একটা ধর্ম, ইহুদী একটা ধর্ম, খৃষ্টান একটা ধর্ম ঠিক তেমনি ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদও আলাদা একটা ধর্মের মত। কোন ধর্মের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। আমি একজন খ্যাতনামা মার্কিন লেখক ও সাংবাদিককে টিভিতে বলতে শুনেছি-- "আমি মুসলিম নই, ইহুদী নই, খৃষ্টান নই বরং আমি একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি"।
এবার আসি ধর্ম নিরপেক্ষ বলতে আমরা কি বুঝি? আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে বুঝানো হয়, রাষ্ট্রের আইন কানুন ইত্যাদি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন ধর্মের প্রভাব সহ্য করা হবে না। প্রত্যেক ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করবে। রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা কোন ধর্মের মাধ্যমে আইন জারি করে দেশ চালাবে না ইত্যাদি।
আসুন! এবার দেখি ইসলাম এ সম্বন্ধে কি বলে? আমরা প্রত্যেক মুসলমানই জানি- Islam is the complete code of life. এখানে আমরা যদি ইসলামকে "কোড অফ লাইফ" বলে মেনে নিই তাহলে, আমরা মুসলমান হিসেবে কেমন করে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামকে এড়িয়ে চলতে পারি? এর দ্বারা কি আমরা আমাদের জীবনকে দুইভাগে বিভক্ত করে ফেললাম না? জীবনের একটা ভাগ তথা ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার বিধানকে মানলাম আর অন্যভাগ তথা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানকে এড়িয়ে গেলাম।
রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালনা করতে হবে ইসলাম তো সে কথাও বলে দিয়েছে। ইসলামে বলা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে চোরের হাত কেটে দিতে হবে,(সুরা মায়েদাহ: ৩৮) খুনীকে বদলা হিসেবে খুন করতে হবে (সুরা বাকারাঃ১৭৮) অবিবাহিত ব্যভিচারীকে বেত্রাঘাত এবং বিবাহিত ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করে ব্যভিচারের স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দেয়া হবে(সুরা নুর: ২), সন্ত্রাসীর শাস্তি সন্ত্রাসের স্বরূপভেদে হত্যা, নির্বাসন (সুরা মায়েদা:৩৩) ইত্যাদি শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আর এ সমস্ত বিধান বাস্তবায়নের জন্য ইসলাম রাষ্ট্রকে নির্দেশ দিয়েছে। রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় ছাড়া এ সমস্ত বিধান বাস্তবায়নের অধিকার কারও নেই। কেননা,তাতে সমাজে বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে।
যেমন কাউকে কোন ব্যক্তি হত্যা কিংবা ফাসি দিলে সমাজে বিশৃংখলা হবে; অথচ, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কাউকে হত্যা কিংবা ফাসি দিলে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না।
এ সমস্ত বিধানকে বাস্তবায়ন করার একচ্ছত্র অধিকারী হচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান। এগুলো বাস্তবায়ন করবেন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান।
আমি যদি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান হই তাহলে, আমি কি করে কুরআনের উক্ত বিধানসমুহের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারি?
যদি বলা হয় যে,আমরা সব ধর্মের লোকদেরকে স্বাধীনতা দিতে চাই, তাহলে আমি বলব- ইসলাম কি তাদের জন্য এ স্বাধীনতা নিশ্চিত করেনি??
রাসুল (সাঃ) হিজরতের পর ১০বছর যখন রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন তখন তো তার দেশের অমুসলিম নাগরিকরা ১০০% ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার ভোগ করেছেন। আজকাল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অমুসলিম লেখকও এ কথাকে অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন। রাসুল (সাঃ) খৃষ্টান প্রতিনিধি দলকে মসজিদে নববীর ভিতরে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছিলেন।[আহকামু আহলি জিম্মাহ] সেখানে তাদের ধর্মকর্ম করারও অধিকার ছিল।
যদি ইসলাম এসব স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে দেয় তাহলে,বিদেশী একটা সিস্টেম আমাদের দেশে আমদানী করার দরকারই বা কি?
প্রশ্ন আসতে পারে- অমুসলিমদের বিচার কি ইসলাম অনুযায়ী করব? তারা তো অমুসলিম?
এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে তাদের ধর্মের বিধিবিধান দিয়ে তারা নিজেদের বিচার করবে। তবে,তারা যদি আমাদের কাছে বিচার চাইতে আসে তবেই তাদেরকে আমরা কুরআন অনুযায়ী বিচার করে দেব।
এ সিস্টেম তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোথা থেকে আসল? আসুন সংক্ষেপে জেনে নিই। প্রাচীন ইউরোপে একসময় গীর্জার পাদ্রীরা মানুষের উপর ধর্মের নামে নিজস্ব কথা জুড়ে দিয়ে যুলুম নির্যাতন শুরু করে দিয়েছিল। ফলে,ইউরোপে তাদের উপর ধর্মযাজকদের মনগড়া বিভিন্ন আইনের কারণে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হন। ফলে,তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাখার সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অনেক চিন্তাভাবনা করেই ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদকে চালু করে।
খৃষ্টানদের জীবনে এ ধরণের দৈন্যদশা আসার কারণে খৃষ্টানরা এ সিস্টেমকে প্রবর্তন করেছে। কিন্তু, ইসলাম কি আদৌ এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যার কারণে আমরাও এ সিস্টেমকে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মুলনীতি হিসেবে গ্রহণ করব?
উল্লেখ্য যে, বাইবেল সম্পুর্ণ স্রষ্টার বাণী নয়, তাতে স্রষ্টার বাণীও আছে আবার ঐতিহাসিক কিংবা অন্যান্যদের বাণীও আছে। যা কখনো মানবতার জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুষ্টু সমাধান দিতে পারে না। কেননা, কোন জিনিসের স্রষ্টাই শুধুমাত্র তার সৃষ্টির সমস্যার সুষ্টু সমাধান দিতে পারেন।
এ এছাড়াও খৃষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে- কায়সার তথা রাষ্ট্রনায়ককে তার অংশ দিয়ে দাও এবং স্রষ্টাকে তার অংশ দিয়ে দাও। অর্থাৎ, দুই দিককে জীবনের দুইটা সাইডের কর্তৃত্ব দিয়ে দাও। তাদের একজন অন্যদিকে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবেনা।
কিন্তু, ইসলামে এমনটি করা হয়নি। বরং, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَاناً لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
অর্থাৎ, আর আমি আপনার উপর নাযিল করেছি এমন এক গ্রন্থ; যাতে সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে দিয়েছি। আর এটা মু'মিনদের জন্য পথনির্দেশ, অনুগ্রহ ও শুভ সংবাদ। (সুরা নাহল: ৮৯)
অতএব, আমাদের জেনে রাখতে হবে যে, ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ সকল ধর্মের বাইরের একটি ধর্ম বা মতবাদ। এটাতে বিশ্বাস করার পাশাপাশি কেউ অন্য ধর্মের অনুসারী হতে পারে না।
ধন্যবাদ সবাইকে!!!
(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





