আগের পর্বঃ সমুদ্রযাত্রা (২) Click This Link
(৫) নাফনদীর তীরে
ঘুম ভাঙল পর দিন সকাল নয়টায়। চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম সবাই উঠে গেছে। রুম ভাগ করে দেয়া সত্ত্বেও কে যে কোথায় ঘুমিয়েছি ঠিক নাই। যার যেখানে ঘুমাতে ইচ্ছা হয়েছে ঘুমিয়েছে।
বিছানাতে শুয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম আবিদ,রাজর্ষি, ফুয়াদ আর মুণ্ডু ভাই দরজার সামনে ভীড় করে আছে। দরজা সামান্য ফাঁকা করে চোরের মত কি যেন দেখছে বাইরে।
আলসেমীতে উঠতে ইচ্ছা করছে না। শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, “ কিরে, ঘটনা কি?”
আমি যে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা কেউ পাত্তাই দিল না। নিজেরা নিজেরা ফুশুর ফুশুর করছে। আর ইতিউতি করে বাইরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। প্রবল কৌতূহলে আলসেমি ঝেড়ে উঠে আসলাম। “কি হচ্ছে রে?” বলে দরজার ফাঁকা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমিও আটকে গেলাম।
বাইরে লবিতে তিনটা মেয়ে গল্প গুজব করছে। দেখে আমাদের বয়সীই বলে মনে হল। দেখতে পরীর মত। অসম্ভব সুন্দরী! যেমন গায়ের রঙ তেমনি চেহারা। ভেসে আসা কথা বার্তা শুনে মনে হল ঢাকা থেকে এসেছে। পেছনে বয়স্ক আঙ্কেল আর আন্টিরা সম্ভবত এঁদের গার্জিয়ান। আরো একটু ভাল করে দেখতে গিয়ে চাপাচাপিতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সুন্দরীদের বেশীক্ষণ দেখার সৌভাগ্য হল না। ফের দরজা ফাঁক করে দেখি ওরা চলে গেছে। হায় হায়! আফসোস!
সবাই হায় হায় করতে করতে বিছানায় এসে বসলাম।
“এরা কারা? কই যায়?” অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল ফুয়াদ। আমারও একই প্রশ্ন।
“তোরাও জানিস না?” আমার অবাক লাগল, “ কতক্ষণ ধরে এরা আছে এখানে?”
মাথা নেড়ে মুণ্ডু ভাই বলল, “আমিও জানি না। আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। রাজর্ষি ডেকে তুলল।”
“কিরে হারামজাদা, কাহিনীটা কি বল!?” রাজর্ষিকেই জিজ্ঞেস করলাম।
“সে এক বিরাট ইতিহাস, ঘরে ছিল না কেরাসিন...” রাজর্ষি জোকারি শুরু করল।
বললাম, “ আরে ধ্যাত! ঠিক করে বল।”
রাজর্ষি শুরু করল, “ ঘুম থেকে উঠেছি অনেক সকালে। ক্ষুধা লাগল। গেলাম নাস্তা করতে। পরোটা, গরুর মাংস আর ডিম ভাজি দিয়ে পে...ট ভরে খেলুম। তারপর মনে হল একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস খাই...”
আমরা রাজর্ষির কথা হা করে শুনছিলাম। এসব কথা শুনে আমি ফুয়াদ আর মুণ্ডু একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। পর মুহূর্তে রাজর্ষির উপর বৃষ্টির মত কিল ঘুসি পরতে লাগল।
“ হারামজাদা, আমাদের তুই বলদ পেয়েছিস?”
হি হি করতে করতে কোন রকমে কিল ঠেকিয়ে রাজর্ষি বলল, “ মাফ করে দে। মাফ করে দে। বলছি। বলছি।”
“ হ্যাঁ! এইবার ঠিক মত বল।” রাজর্ষির ঘাড় ধরে মুণ্ডু বলল। আবার উল্টা পাল্টা হলেই মাইর।
মাথা চুলকে রাজর্ষি বলল, “ কি যেন বলছিলাম...”
অধ্যর্য হয়ে বললাম, “ আরে ওই যে ওই তিনটা মেয়ে...”
“ ও হ্যাঁ!” এমন ভাব দেখাল যেন মনে পড়েছে, “ খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়েছি। এমন সময় এক আঙ্কেল আমাকে জিজ্ঞেস করল হোটেল তাজ চিনি কিনা।”
“আঙ্কেল টা কে?” ফুয়াদ জিজ্ঞেস করল।
“আহহা! কথার মাঝ খানে বাম হাত!”
ফুয়াদকে থামালাম, “আচ্ছা বাদ দে, ওরেই বলতে দে”
“হ্যাঁ! যা বলছিলাম। আঙ্কেল আমাকে শুধাইল হোটেল তাজ চিনি কিনা। আমি বলিলাম, আলবৎ! চলেন আমার সাথে। আঙ্কেলকে সাথে নিয়ে হোটেলে এলাম। আসার পথে শুনলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে উনি হাঁটতে বের হয়েছিলেন। ফেরার পথে হোটেলের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।” রাজর্ষি গেঞ্জির কলার উঁচু করে বলল, “আমিই উনাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এলাম।”
“তারপর?”
“তারপর আবার কি? হোটেলে এসে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা সেইন্ট মার্টিন যাচ্ছি শুনে বললেন উনারাও সেখানেই যাবেন।” চোখে মুখে খুব সেয়ানা মার্কা একটা ভাব নিয়ে শেষে বলল, “আমাকে বলছিলেন সাথে যাবার জন্য। তোদের কথা ভেবে আর গেলাম না।”
ঘটনা এতক্ষণে বোঝা গেল। যাক, খেল খতম, পয়সা হজম। পুরস্কার হিসেবে রাজর্ষিকে কয়টা লাথি দিয়ে আমরা খুশিতে বাকুম বাকুম করতে করতে বাকিদের ডাকতে গেলাম। তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে!
কোন রকমে নাস্তা করেই রওনা দিলাম। তিনটা মাইক্রো বাস ভাড়া করা হল। একসাথে এতগুল ছেলে দেখে কেউ প্রথমে যেতে চাইছিল না। ইয়াং ছেলে মানেই ঝামেলা। কথায় কথায় এরা ঝামেলা করে। অন্তু ওদের বুঝিয়ে রাজী করল।
দুপুরে টেকনাফ পৌঁছে দেখা গেল, বড় বড় যে জাহাজগুল সেইন্ট মার্টিন আসা যাওয়া করে, অফ সিজনে সেগুল বন্ধ থাকে। এবার? বিনা মেঘে বজ্রপাত। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। ঘেমে নেয়ে সবার অবস্থা কাহিল। সবাই গাছের ছায়া টায়া দেখে গায়ে বাতাস করতে লাগল। এমন একটা অবস্থা, বাতাস ও নাই। মাইক্রোতে সবাইকে খুব ঠাসা ঠাসি করে বসতে হয়েছে। খুব কষ্ট হয়েছে সবার। সবাই ত্যাক্ত বিরক্ত ক্লান্ত। অরগানাইজারদের মধ্যে অন্তু, সুমন, মুণ্ডু, সজীব এদিক ওদিক দেখতে লাগল কিছু করা যায় কিনা। এর মধ্যে কয়েক জন বিদ্রোহ করে উঠল।
বি সেকশনের শাহিন বলে উঠল, “এইভাবে আসার কোন মানে হয়? ধুর! কোন কিছুর কোন ঠিক নাই। জাহাজ যে এই সময় চলে না এটা তোরা কেউ জানিসই না। সেইন্ট মার্টিন যাবে! ফুহ!”
কথাটা অন্তুর খুব গায়ে লাগল। বলল, “ভাল না লাগলে চলে যা। কেউ তোকে বেঁধে রেখেছে?”
তীরে এসে তরী ডুবানোর মত অবস্থা। সবাই শাহিন আর অন্তুকে বোঝাল যে এই মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়ে আসলে নেতাজী সুমনকে পাঠালেন একটু আশেপাশে দেখে আসতে।
সুমন ঘুরে এসে রিপোর্ট করল ব্যাবস্থা একটা আছে। কি? ট্রলারে করে যেতে হবে। সুমন দূর থেকে ট্রলারটা দেখাল। দেখে বেশ বড়সড় ট্রলারই মনে হল।
ট্রলারের কথা শুনে সবাই বেকে বসল। ট্রলারে করে সমুদ্র পার হতে হবে? অসম্ভব! সবাই মুখ শুকিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করতে লাগল। এত কষ্ট করে, এতদুর এসে কি শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হবে না?
আমি যুক্তি দেখালাম, “ এই ট্রলারে করে এরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। তাছাড়া আমরা তো আর সমুদ্র পার হচ্ছিনা! কেবল নাফ নদী পার হব। ব্যাপারই না!”
কেউ আমার কথায় বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। ইতস্তত মুখে সবাই ঘুরে বেড়াতে লাগল। ট্যুর এখানেই শেষ এমন ভাব করে ছবি-টবি তুলতে লাগল। একদম হতাশাজনক পরিস্থিতি।
জুয়েল বিড়ালের মত মুখ করে নেতাজিকে জিজ্ঞেস করে বসল,
“নেতাজী, ট্রলার ছাড়া আর কোন উপায় নাই?”
“আছে। উড়ে চলে যা।” গম্ভীর মুখে নেতার উত্তর আসল।
“নেতাজী, আমার তো ডানা নাই” উত্তেজিত হয়ে জুয়েল প্রশ্ন করে।
“ডানা নাই তো এত কোথা কস কেন?” নেতাজী এবার রাগে ফেটে পড়ল। “ভাগ, এখান থেকে হারামজাদা।”
দুপুর হয়ে গেছে। গরমে আর ক্ষুধায় সবার অবস্থা কাহিল। ক্ষুধা পেটে এত টেনশন নেয়া যায় না। আগে খেয়ে নেই তারপর দেখা যাক কি করা যায়। আশেপাশে ভাল কোন খাবার দোকান দেখলাম না। একটামাত্র টিনের ছাপরা দোকানে খাওয়া পাওয়া গেল। খাওয়ার ব্যবস্থা ভাল। প্রচুর মসলা দিয়ে সামুদ্রিক মাছ রান্না করা আছে। মুরগীর তরকারীর অবস্থা আরও ভাল। তেল আর মসলার সাগরে মুরগী ভেসে বেড়াচ্ছে! এসব খেলে পেট খারাপ হবে নিশ্চিত। কিন্তু কি আর করা? না খেয়ে থেকে তো দাঙ্গা লেগে যাচ্ছে! বিসমিল্লাহ বলে সবাই বসে পড়ল!
খেতে বসে পদ্মা নদীর মাঝি গল্পের কপিলাকে নিয়ে সমীর আসর জমিয়ে ফেলল। ট্রলারে করে যাওয়ার দুশ্চিন্তা সবার মাথা থেকে নেমে গেল। কি আছে জীবনে? একবার যখন ঠিক করেছি যাব। তখন আমরা যাবই! হোক! তাহলে ট্রলারেই হোক। খাওয়া দাওয়া করে চাঙ্গা হয়ে সবাই সুমনের দেখানো ট্রলারে চড়ে বসল।
ট্রলারে বসে আছি দশ পনের মিনিট হয়ে গেল, কিন্তু কারো কোন দেখা নেই। আরে! ট্রলার চালাবে কে? মাঝি কই? এমন সময় সুমন হন্তদন্ত করে এসে বলল, “ ইয়ে, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। ট্রলার আসলে এটা না। অন্য পাশে ট্রলার রেডি আছে। চল।”
“কেন, এটায় সমস্যা কি?”
সুমন তাড়া দিয়ে বলল, “এটা যাবে না। দেরী করিস না। দেরী করলে সেইন্ট মার্টিন পৌছাতে রাত হয়ে যাবে। রাতে সেইন্ট মার্টিনে কারেন্ট থাকে না।”
সবাই বসে পড়েছিল। ব্যাগ নিয়ে উঠে আবার চলল।
যে ট্রলারে করে আমরা সেইন্ট মার্টিন যাব সেটা দেখে সবাই একটা ধাক্কা খেল। আগের ট্রলারে ছাদ ছিল, এটাতে নেই। সবচেয়ে বড় কথা আগেরটার তুলনায় এটাকে বড় জোর নৌকা বলা যায়, ট্রলার বলা যায় না কিছুতেই! কিন্তু এসব দেখার আর সময় নেই। মাইক্রো বাস ছেড়ে দিয়েছি। ফেরত যাওয়ার কোন উপায় নেই। আল্লাহ্ ভরসা বলে সবাই নৌকায় উঠে পড়ল। সবাই উঠেছে কিনা একবার দেখে নৌকা ছেড়ে দিল।
টেকনাফে নামার পর যতটা গরম লাগছিল, এখন অতটা গরম লাগছে না। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যাওয়াতে রোদের তাপও তেমন লাগছে না। ট্রলার নদীর ধার ঘেসে যেতে লাগল। নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে সবার গা জুড়িয়ে গেল। আহা! এই নাহলে জীবন!
আমি, আবিদ, রাজর্ষি আর কাবু – চার রুমমেট গলা ধরে অন্যদের মত ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষ হলে কাবুর গলা ধরে, বসে বসে নদীর প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করছি। এমন সময় কাবু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, “ ঐ যে দূরে ওইটা কি দেখা যায়? দ্যাখ তো ভাল করে!”
আমি কিছুই দেখলাম না। শুধু পানি আর পানি। বললাম, “হুর! কি দেখা যায়?”
“ আরে ভাল করে ওইদিকে তাকিয়ে দ্যাখ।” কাবু আঙ্গুল তাক করে দেখাল।
আমি আরও মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ! এইবার দেখা যাচ্ছে! পানির মধ্যে একটা লাইনের মত দেখা যাচ্ছে!
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে এটা নদীর মাঝখানে? দেখতে ফেনার মত লাগছে।”
“ওটা তো নদীর মোহনা বলে মনে হচ্ছে! কিন্তু আমাদের ট্রলার ওই দিকে যাচ্ছে কেন?” কাবু আঁতকে উঠে বলল, “ মোহনায় তো অনেক ঢেউ থাকে। আর নদীর পানি – সমুদ্রের পানিতে মেশার সময় বড় বড় ঘূর্ণি তৈরি হয়! একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়লেই সব শেষ!”
“তাহলে?”
“চল মাঝিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি।”
“চল”
ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করেছি কিনা একবার দেখে নিলাম। নাহ, কেউ এখনও ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। নাফ নদীর ওই পাড়ে নাকি মায়ানমার। আরেকটা দেশের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, সবাই সেই উত্তেজনায় আছে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সামনে কি আছে সেই খেয়াল নেই।
আমি আর কাবু আস্তে করে উঠে পেছনে মাঝির কাছে গেলাম। মাঝির স্বাস্থ্য ভাল। লুঙ্গি হাঁটুর উপর তুলে একাই দাঁড় টানছে। মুখে পান। উদাস দৃষ্টি। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, “ ভাই, দূরে ওইটা কি দেখা যায়?”
কথা বলার লোক পেয়ে মনে হল খুশিই হল। “ওইডা নদীর মোহনা। দেখতাসেন না কিমন জব্বর ঢেউ!” কাবুর কথাই ঠিক। সামনে বিপদ।
শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “ ঢেউ তো বুঝলাম। তো আমরা সেইদিক যাচ্ছি কেন?”
মাঝি জবাব দিল, “আমরা তো ওদিক দিয়া যামু না। নদী আড়াআড়ি করস করমু। বার্মার ছাইড দিয়া সমুদ্রে গিয়া পড়ুম।“ পিচিক করে পানের পিক ফেলে বলল, “বার্মার পাশ দিয়া যাওনের টাইম নাসাকা বাহিনী গুল্লি করতে পারে। হালারা জংলীর জাত। তয় সমস্যা নাই। গুলি করলে মাতা নৌকায় হান্দায় রাখবেন। তাইলেই আর পোবলেম নাই। ডর দেহানির লাইগা গুলি করে।”
আরে হারামজাদা বলে কি? শালা, পাগলের হাতে পরলাম নাকি? মারল তো!
সব কথা শুনে আমি আর কাবু ঢোক গিলে বললাম, “খাইসে রে!”
আমাদের মাঝির সাথে কথা বলতে দেখে সেতু দুলতে দুলতে এগিয়ে এল। খুব ফুর্তিতে আছে। হাসি হাসি মুখে সুর করে বলল, “ কিইই কোওরছিস দো...ওস্ত!”
কাবু কোন কথা না বলে আবার আঙ্গুল তুলে দেখাল, “ওইদিকে দ্যাখ।”
“কো...ও...ন দিকে দো...ওস্ত!” বলে সামনের দিকে তাকাল। তাকিয়েই কথা আর হাসি একসাথে বন্ধ হয়ে গেল। মোহনা ভয়ঙ্কর রূপ ততক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পানিতে সে কি আলোড়ন! বিশাল আজদাহা সাপ যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে।
সেতু হা করে সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখছিল। আতঙ্কে বেচারা হ্যাং হয়ে গেছে।
“কিরে আটকে গেলি কেন?”
সেতু একটা ঢোক গিলে বলল করুন চেহারা করে বলল, “ আমরা কি মারা যাচ্ছি দোস্ত?”
“আরে নাহ!” সেতুর ভয় ভাঙ্গানর জন্য বললাম। বেচারা ভয় পেয়েছে। সেতুকে মাঝির কথা সব বললাম। সব শুনে সেতু ছুটে গিয়ে সবাইকে ঘটনা জানিয়ে দিল। সব দেখে শুনে সবার হাসি বন্ধ হয়ে গেল। সবাই এতক্ষণ মায়ানমার কিভাবে যাওয়া যায় সেই চিন্তা করছিল। নাসাকা বাহিনীর কথা কারো মনে নাই। গুলির কথা শুনে সবাই মাথা নামিয়ে ট্রলারের খোলে আশ্রয় নিল। ভাগ্য ভাল, ট্রলারে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ছিল। সবাই একটা একটা করে লাইফ জ্যাকেট পড়ে আল্লাহ্-খোদার নাম নিতে থাকল।
কিছুক্ষণ পর ট্রলার বাঁক নিয়ে নদীর আড়াআড়ি যাওয়া শুরু করল। মোহনার ঢেউ ততক্ষণে ট্রলারে এসে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। ঢেউয়ের তালে নৌকা একবার উপরে উঠছে আবার নিচে নামছে। কি যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! ট্রলার যখন মোহনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন মাথা উঁচু করে আরেকবার মোহনার দৃশ্য দেখলাম। অস্বাভাবিক একটা অবস্থা! উঁচু উঁচু একেকটা ঢেউ এ ওর গায়ে আছড়ে পড়ছে। যখন তখন এখানে সেখানে বিশাল বিশাল সব ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে। আমাদের ট্রলার, এর মাঝে পড়লে যে দুমড়ে মুচড়ে শোলার নৌকার মত ভেসে যেত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মোহনা পার হয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমরা সমুদ্রে গিয়ে পরলাম। চারপাশ থেকে একসময় স্থলসীমা রেখা মুছে গেল। যেদিকে তাকাই শুধু ঢেউ আর পানি, পানি আর ঢেউ। সমুদ্র মোহনার তুলনায় অনেক শান্ত। ঢেউ আছে। তবে সহ্য করা যায়। মোহনার মত অত খাই খাই ভাব নাই। ধীরে ধীরে সবার আতঙ্ক কেটে গেল। আবার গাল গপ্প চলতে লাগল।
ভট ভট করতে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলছে। আর ভাল লাগছে না। বিকেল শেষ হওয়ার পথে অথচ কখন পৌছাব আল্লাহই জানেন। দুই একবার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিবারে একই উত্তর, “চইল্লা আইছি।”
পরে শুনেছিলাম জাহাজে যেতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে। এই ট্রলারগুলো অনেক স্লো। তাই সেইন্ট মার্টিন পৌছাতে আমাদের বেশী সময় লেগেছিল।
অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছে তখনই মাঝি হাক দিয়ে বলল, “ওই দ্যাখেন! চইল্লা আইছি!”
আমরা দূরে তাকিয়ে দেখলাম সেইন্ট মার্টিন তখনও একটা বিন্দু ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু আমাদের জন্য ওটাই বিশাল আনন্দ বয়ে নিয়ে এল। খুশিতে সবার চোখ মুখ ঝলমল করতে লাগল। কোলাকুলি করে একজন আরেক জনকে অভিবাদন জানাল। ইয়েস! আমরা পেরেছি! অবশেষে আমরা পৌছাতে পেরেছি দারুচিনি দ্বীপে!
দেখতে দেখতে দারুচিনি দ্বীপ কাছে চলে এল। সন্ধ্যা তখন হয় হয়।
ট্রলার যখন জেটিতে এসে ভিড়ল তখন এক লোক আমাদের দেখে এগিয়ে এল। লুঙ্গি পড়া লোকটাকে দেখে দালাল বলে মনে হল। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, উনি হোটেলের ম্যানেজার। অফ সিজন বলে এই সময় এখানে কেউ বেড়াতে আসে না। আর ট্যুরিস্ট না থাকলে কাজও নাই। বিকেলে জেটিতে হাঁটাহাঁটি করার সময় আমাদের ট্রলার দেখতে পেয়েছে। আর তারপর থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। লোকটা স্থানীয় উচ্চারনে জানাল, তার কাছে ভাল হোটেলের সন্ধান আছে। আমরা চাইলে সেখানে যেতে পারি।
আমাদের কাছে অন্য কোন অপশন ছিল না। টাকা পয়সার ব্যাপারটা মিটমাট করে নিয়ে আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম।
আমাদের এত সাধের সেইন্ট মার্টিনে বিদ্যুৎ নাই। জেনারেটরই বিদ্যুতের একমাত্র ব্যবস্থা। হোটেলের ম্যানেজার বলল, রাতে বাতাস ঠাণ্ডা থাকে। ফ্যানের প্রয়োজন নাই। তবে এক ঘণ্টার জন্য জেনারেটর ছাড়া হবে। আর আমরা চাইলে হোটেলেই খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।
হোটেলেই খাওয়ার ব্যবস্থা হল। থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর সবাই খালি পায়ে বিচের দিকে ছুটে গেল। বাইরে বেরিয়ে এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য দেখে আমদের থমকে দাঁড়াতে হল। এটা কি দেখছি আমরা? মনে হল আমরা অপার্থিব কোন জগতে চলে এসেছি। এটা আমাদের চেনা পৃথিবী হতে পারে না। চাঁদের আলোতে চারপাশ ঝকমক করছে। দ্বীপে বিদ্যুৎ না থাকায় চাঁদের আলো আরও মায়াবী, আরও অলৌকিক, আরো রহস্যময় হয়ে উঠল। ঠাণ্ডা নোনা বাতাসে যেন কোন যাদু আছে। তার স্পর্শে শুধু শরীর না, মনটাও কেমন যেন অধরা হয়ে গেল। দূরে সমুদ্রের ঢেউ মৃদু গর্জনে আছড়ে পড়ছে তীরে। এ দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নাই।
আফসোস, ইলাকে সাথে আনতে পারিনি! ওর নরম হাত ধরে কিছু একটা বলে হালকা হতে পারতাম। বুকের ভেতর অনেক অনেক কথা যেন জমে আছে। খুব মিস করছি ওকে। হায়রে ভালবাসা!
ম্যানেজার পানিতে নামার ব্যাপারে আমাদের সাবধান করে দিল। ভাটা চলছে। ভাটার সময় পানিতে নামা নিষেধ।
সবাইকে সাবধান করে দিয়ে আমি,অন্তু, ফুয়াদ, সেতু, কাবু, আবিদ, রাজর্ষি - দশ বারোজন তীরে গিয়ে বসলাম। সবার চোখে মুখে মুগ্ধতা!
পরবর্তী পর্বঃ সমুদ্রযাত্রা (৪)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৩ রাত ৯:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




