somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় (Season-2) - পর্ব- ৯

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঝিকঝিক ঝিকঝিক ...ঝিকঝিক ঝিকঝিক …
ট্রেনের এই শব্দটা আমার কাছে এত বেশি ভালো লাগে যে মাঝে মাঝেই মনে হয় কোন এক অবিবাহিত ট্রেনের সাথে বিয়ে করে ফেলি!! অবশ্যই মেয়ে ট্রেন হতে হবে! খুব ইচ্ছা হয়- কোন এক ঝড়ের রাতে ভেজা শরীরে দূর্বার বেগে ছুটে চলা কোন এক যুবতী ট্রেনের সামনে হাঁটু গেড়ে এক তোড়া তাজা গোলাপ ধরে মাথা নিচু করে বাম হাত দিয়ে মাথার হ্যাট টা খুলে বলি - "আই লাভ ইউ"!!
ট্রেনের যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকতো তবে হয়তো ভয়ার্ত চোখে উত্তেজিত হয়ে সে বলতো -
"একি পাগল নাকি? মরবে তো"!!
আমি বলতাম -
"আমি তোমার পায়ের নূপুরের ওই শব্দে তোমার প্রেমে পাগল হয়ে তোমার হাতেই মরতে চাই"
"ওটা পা নয় গর্ধভ!! ওটা আমার চাকা!! লোহার চাকা। মূহুর্থেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে!! সরে যাও! সরে যাও বলছি!!"
"না আমি সরবোনা!! তোমার ওই চাকা দিয়ে পিষে দাও আমায়। কেন জানিনা তোমায় খুব ভালবেসে ফেলেছি গো।”
“মিথ্যা !! আমায় ভালবেসেছ নাকি মৃত্যুকে ভালবেসে ফেলেছ? ওসব বাজে কথা রাখো! কেন মিথ্যে বলছো আমায়? প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তোমরা কত শত মানুষ এসে জীবন দিয়েছ আমার এই চাকার নিচে, আর এখন নিজেদের সেই দোষ ঢাকতে বলছো আমায় ভালোবাসো? হাহাহা। লজ্জা লাগেনা???”
ট্রেনের বিকট শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল!! কিন্তু কানের কাছে তখনও কোথা থেকে যেন কেউ বলছে “লজ্জা লাগেনা?”।
খুব রাগ হল নিজের উপর। এটা কেমন স্বপ্ন!! আচ্ছা ট্রেনের প্রেমে কেউ পড়ে, একথা কেউ শুনেছে কোনদিন? আচ্ছা আমি আবার পাগল টাগোল হয়ে যাচ্ছি নাতো!! নাকি আমার ভিতরে আত্মহত্যা টাইপের কিছু একটা বাসা বেঁধেছে আমার অজান্তেই!! পৃথিবীর প্রতি আমার ঘেন্না ধরেছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি তো আর হাল ছাড়তে পারিনা।
আমি এখন খুলনায়। ষ্টেশনে নামতেই দেখা পেয়ে গেলাম অসহায় সেই বৃদ্ধ “মা” টির। লাঠি ছুড়ে ছুড়ে হাটতে দেখেই বুঝলাম তিনি অন্ধ। আর তার সাথে “খোকা খোকা” বলে বিলাপ করে যাচ্ছে অনবরত। আশ-পাশে প্রচুর মানুষের কোলাহল আর ভিড় ভেঙে আমি এগিয়ে গেলাম বৃদ্ধার দিকে। কাছে গিয়ে বুঝলাম তার বয়স কমপক্ষে ৬০ থেকে ৬৫ এর ভিতরে হবে। এই শীতের সকালে ছেঁড়া একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে থরথর করে কাপছে সে। আমি বৃদ্ধার হাত ধরে পাশেই একটি বসার জায়গায় বসলাম। বৃদ্ধা আমার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল-
“এই... এই... যে খোকা আইছস তুই? অহন আওনের টাইম হইলো তোর?”
আমি যেন খুব চিন্তিত কণ্ঠে বললাম-
“মা তুমি এখানে কি করছো?”
বৃদ্ধা যেন একটু অবাক হয়ে বলল-
“কেন খোকা তোর মনে নাই? তুইনা আমারে কইলি- মা একটু বয় আমি আইতাছি?”
তারপর একটু থেমে আবার বলল-
“সেই সকাল থাইকা আমি এহনও বইয়া আছি... তুই এত দেরী করলি কেন খোকা?”
কথাটা বলেই বৃদ্ধা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো!!
আমি জানি, সকাল থেকে নয়, গত দুই বছর যাবত সে তার খোকার অপেক্ষায় বসে আছে এই স্টেশনের চত্তরে… তার জীবনের সেই সকাল আর ফুরইনি। অন্ধদের জন্য সকাল দুপুর রাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও তিনি জন্মান্ধ নন। তার খোকা গত দুই বছর আগে তার জন্মদাতা মা কে এখানে ফেলে চলে গেছে ঝঞ্ঝাটহীন সুখের জীবনের সন্ধানে।
আমি তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম -
“মাফ করে দাও মা, একটু দেরী হয়ে গেল”
বৃদ্ধা বলল-
“মায়ের কাছে আবার মাফ কিয়ের? দেরী হইলেও আমি তরে ঠিক খুইজ্জা বাইর করতাম। এই যে তুই আমারে তোর যে ছবিডা গলায় ঝুলাইয়া দিছিলি হেইডা অহনো আমার গলাই ঝোলানো আছে… এই… এই দেখ”
বলে, বৃদ্ধা আমাকে তার গলায় ঝোলানো লেমেনেটিং করা কার্ডের কিছু একটা বের করে দেখালো। আমি ওটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাদা একটা কাগজে কম্পিউটারে প্রিন্ট করা বড়বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে লেখা-
“আমি একজন অসহায় মানসিক প্রতিবন্ধি। আমাকে সাহায্য করুন” !!!
“থ” হয়ে গেলাম আমি। বৃদ্ধা আবারো বলা শুরু করলো-
“জানস খোকা, যহনই তোর ছবি দেহাইয়া কাউরে জিগাইতাম, ‘আমার খোকারে দেখছোনি?’ তহনই মাইনসে আমারে পয়সা দিছে, খাওন দিছে… কিন্তু কেউ তোর খোঁজ দিবার পারে নাই।”
আমি তার কান্না থামিয়ে বললাম-
“আমি চলে এসেছি মা…আর কোন চিন্তা নেই... এবার বাড়ী চলো”
বৃদ্ধা যেন খুব অবাক হল আমার এই কথাটি শুনে… আনন্দে তার সাদা ভ্রু দুটি সামান্য কুঞ্জিত হল। তারপর আমার গালে হাত দিয়ে ফিস ফিস করে বলল-
“বাড়ি!! সত্যিই আমারে বাড়ি নিয়া যাবি বাপ?”
“হ্যাঁ বাড়ি নিয়ে যাব।”
“কিন্তু, বাড়িত নিয়া গিয়া তোর বউয়ের কতা হুইনা আবার আমারে মারবি নাতো বাজান? আমার খুব লাগে রে বাপ…”
কথাটা শুনতেই চমকে উঠলাম আমি!! মাথার উপরে বাজ পরলে মানুষ যেমন জমে যায়, আমিও তেমনি জমে পাথর হয়ে গেলাম… পার্থক্য শুধু এটাই যে আমি এখনো বেঁচে আছি। যে সন্তান এমন একজন অসুস্থ বৃদ্ধ মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারে, তার রক্তের গ্রুপ নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে ক্রমেই নিজেকে ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছি!! আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে তার হাত ধরে ধীরে ধীরে স্টেশন থেকে বের হয়ে এলাম।
খুলনার প্রধান সড়কগুলোতে আসার পর লক্ষ্য করলাম সেই পুরনো দিনের বেবিটেক্সি গুলো এখনো চলাচল করছে এখানে, তবে আপগ্রেড ভার্সনে। মনে হচ্ছে যেন হলুদ পোশাক পরে পুলিশের মত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমস্ত শহর জুড়ে। সেই কবে ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম খুলনাতে মনেই নেই। ষ্টেশন রোডের পাশে “নিউ বরিশাল ট্রান্সপোর্ট” নামের এক দোকানের পাশে লক্ষ্য করলাম একটি বেবিটেক্সি দাড়িয়ে আছে। আমি আর বৃদ্ধা সেদিকে এগিয়ে গেলাম। বেবিটেক্সির চালককে ভিতরে বা এর আশেপাশে দেখতে না পেয়ে আমরা অন্যদিকে এগোতেই পিছন থেকে-
“কই যাইবেন?”
বলে উঠলো কে যেন। তাকিয়ে দেখলাম চালক সাহেব চা খেতে খেতে এগিয়ে এসেছেন আমাদের দিকে।
“বয়রা, রায়ের মহল বাজার”
বললাম আমি।
“ঠিক আছে আফনেরা ভিতরে বহেন, মুই কাপ টা দিয়া আইতাছি”
বলে বেবিট্যাক্সির দরজা খুলে দিয়ে দৌড় দিল ড্রাইভার। আমি বৃদ্ধা কে নিয়ে উঠে বসলাম গাড়ির ভিতরে। তারপর তার মাথাটা আমার বুকের সাথে চেপে ধরে বললাম-
“আমার উপর তোমার অনেক রাগ তাইনা মা?”
“ধুর পাগল !! রাগ করুম ক্যান?”
“এই যে তোমাকে রেখে চলে গেছিলাম…”
“তাতে কি? আমি জানতাম আমার খোকা ঠিক আইবো… আমার পোলারে আমি চিনমু না!!”
তারপর ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করলো-
“জানিস বাজান, তুই যহন ছোড আছিলি হেই সুমাই একদিন তোর বাপে নেশা কইরা তরে বেইচ্চা দিবার চাইছিল… কিন্তু আমি দিই নাই। তরে বুকের মইদ্দে নিয়া ভাগছিলাম… কই কই দউরাইছি তরে নিয়া আল্লাহ্‌ মালুম হাহাহা...”
আশ্চর্য !!! এত কিছুর পরেও মানুষ হাসতে পারে? তাও যে সে হাঁসি নয়!! ছেলের বুকে মাথা রেখে কোন এক মায়ের তৃপ্তির হাঁসি।
গাড়ী চলতে শুরু করেছে… মা তার সন্তানকে কাছে পেয়ে সুখ দুখের গল্প করেই চলেছে… আর আমি কুলাঙ্গার সেই সন্তানের বেশ ধরে মনোযোগ দিয়ে শুনছি তার কথা, আর তার গলায় ঝোলানো খোকার ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি...কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে- ছবিতে যে মানুষটিকে দেখতে পেলাম তার চারটা পা, একটা লেজ আর লম্বা একটা জিভও আছে!!!
চলবে…

(বিঃদ্রঃ আগামী পর্বে সমাপ্তি টানা হবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×