দ্য কমান্ডমেন্টস।
নাহ, মুসা নবীর নয়।
জর্জ অরওয়েলের 'অ্যানিমল ফার্ম'।
"ওয়াটেভার গোয আপন টু লেগস ইয অ্যান এনিমি।"
"ওয়াটেভার গোয আপন ফোর লেগস, অর হ্যায উইংস, ইয আ ফ্রেন্ড।"
অরওয়েলের বহুমাত্রিক অ্যালিগরী আর ডিসটোপিয়ান দর্শনের ঝক্কি-ঝামেলায় না গিয়ে নিতান্ত সোজা-সাপ্টা সরলরৈখিক আক্ষরিক ভাবটা যদি টানি, কী দাঁড়ায়? স্থান, কাল, পাত্র ভেদে আমাদের 'মহাজাগতিক উপলব্ধি' আমূল বদলে যায়, এই-ই তো?
এমন যদি হত, ইচ্ছে হলে আমি হতাম প্রজাপতির মত!
এক জনমে বেছে নিতাম মৎস্যকুমারী-জীবন, পুনর্জন্মে ডাইনী বুড়ি'র।
নিদেনপক্ষে বিপরীত মেরুর কারো সাথে তো অদল-বদল করা যায় বছর কয়েক! যেমন ধরুন, শ্রমিক নেতা-কারখানার মালিক, কিংবা ইসরাইলী-ফিলিস্তিনি। পরের জুতো-জোড়া ধার করে কদম কয়েক হেঁটে হেঁটে কি সারিয়ে তোলা যেত না পৃথিবীর গেঁটেবাত?
"ভিলেনের" মুখে গল্পের বয়ান, হালের ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিরও ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ধীরে ধীরে।
স্লীপিং বিউটির "দুষ্টু" পরীর কাহিনী আমরা শুনেছি Maleficent -এর মুখে; কিংবা শয়তানের মুখে "দ্য ডেভল'স অ্যাডভোকেট"-এর সেই পাঞ্চলাইন ক'টি , "I've nurtured every sensation man's been inspired to have. I cared about what he wanted and I never judged him. Why? Because I never rejected him. In spite of all his imperfections, I'm a fan of man! I'm a humanist. Maybe the last humanist."
বাক্সবন্দী চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে হোক, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের দেশ ভ্রমণের নেশায় হোক, কিংবা হোক 'বনে-সুন্দর' বন্যের সৌন্দর্যের তৃষ্ণায় - আফ্রিকার সাভানায় অদৃশ্য হওয়ার মতলব আঁটলাম।
অভিযাত্রার প্রস্তুতি চলতে থাকুক, এ'বেলা মুখোশের ভেতরের কেচ্ছা ভাঙি।
উচ্চমার্গীয় আলাপ খানিক লোক-দেখানো। আসল ঘটনা অন্যখানে। কৃতিত্ব সব আমার নাছোড়বান্দা কন্যার, আর আমার প্রমত্তা জোয়ারের মত মাতৃস্নেহের (পড়ুন 'প্রশ্রয়ের' )। আমরা থাকি দুবাইয়ের কাছাকাছি; মরুপ্রান্তরের চিড়িয়াখানায় সবেধন উট ছাড়া অন্য পশুপাখীরা রা-টি করেনা। গুহার বাইরে শ্রী-মুখটি পর্যন্ত বের করতে নারাজ - কে জানে কোন গোপন গোলটেবিল বৈঠকে আইন পাস হয়েছে কি' না! পশু-পাখীদের একযোগে হরতাল চলে বারোমাস। এক, দুই, তিন দিনেও মেয়ের 'সিংহমামা'র দেখা না পাওয়ার শোকে মেয়ের মা ততোধিক কাতর।
আফ্রিকা মহাদেশে এই-ই প্রথম।
বোকা-না-বনার চেষ্টায়, আর ওয়ালেটের স্বাস্থ্য বাঁচাতে ঘোড়া ডিঙিয়ে সরাসরি আফ্রিকার স্থানীয় এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করি ই-মেইলে। প্রতিদিন ডজনখানেক চিঠি পাই। যে যার ঢাক বাজাতে উদগ্রীব। এরিমধ্যে একটা চিঠি সতেজ হাওয়ার মত আমার মন ছুঁয়ে দিলো। আমাদের আফ্রিকাযাত্রায় ভজঘট না বাঁধে, চিঠির প্রেরিকা এ-নিয়ে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট। পত্রলেখিকার আন্তরিকতায় কৃতজ্ঞতাবনত আমি ম্যালেরিয়ার ভ্যাকসিন, মশার কয়েল, আর দূরবীন জোগাড়ের ভাবনা মুলতবি রেখে দোকানে দোকানে আরবী সুগন্ধি'র খোঁজ করে বেড়াই, তাকে উপহার দেব। বাড়িতেও আফ্রিকা ভ্রমণের বিশাল আয়োজন চলতে থাকল। সারাদিনের অফিস আর স্কুল শেষে বাবা-মেয়ে বাড়ি ফিরলে আমি বাটন চেপে "লায়ন কিং" চালু করে দেই। স্কুলের পড়া মুখস্থ না হলেও, "হাকুনা মাটাটা"র কথা আর সুর পিতা-কন্যার আগাগোড়া মুখস্থ হয়ে গেল। এভাবে দিন গড়াতে লাগলো। অবশেষে প্লেনে ওঠার আর যখন দু'দিন বাকী সর্বসাকুল্যে, তখন পরিবারের সহৃদয় কর্তা আমার কর্মদক্ষতা বিবেচনায় টীকা, কয়েল, দূরবীন, ক্যামোফ্লাজের মিলিটারি পোশাকের যাবতীয় বন্দোবস্ত নিজেই করলেন।
ল্যান্ডিংয়ের মিনিট পাঁচেক আগে মেয়ের উল্লসিত চিৎকার কানে এলো, "ঐ যে যেব্রা"! "ধুর! এয়ারপোর্টে যেব্রা ঘোরে নাকি রে, বোকা মেয়ে!" ঘাড় ঘুরিয়ে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি, তিনটা যেব্রা জটলা পাকাচ্ছে। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে উড়োজাহাজের চাকা মাসাইমারার মাটি স্পর্শ করলো।
অবর্ণনীয় সৌন্দর্য যার, তার বর্ণনা করার পন্থা আমার জানা নেই। মাসাইমারার সৌন্দর্যে সিক্ত হতে হলে, কেনিয়ায় পাড়ি জমানো ছাড়া গত্যন্তর নাই। এখানে আদিগন্ত ক্যানভাসে নামে সাঁঝের মায়া। তারপর আকাশে একটা একটা করে ফুটতে থাকা তারার মত তৃণভূমি ছেয়ে যায় পশুপাখীতে। এই-ই মাসাইমারা, বন্যপ্রাণীদের "চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির...যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে..."
বনপুরীর রাজবর্গ যার যার স্থানীয় এলাকায় মিম্বারে দাঁড়িয়ে নিজের প্রভুত্ব ঘোষণা করেন।
প্রকৃতি থেকে ক্রমশঃ এত দূরে ছিটকে পড়ছি আমরা যে, মিম্বারের বিষয়টা নিজের চোখে না দেখলে ভাবতাম ওটা বুঝিবা ডিযনীর লায়ন কিং-এরই একটা অংশবিশেষ। অভিযানে সামান্যতম সময়ও যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য আমরা তৃণভূমির মাঝে তাঁবু গেড়ে সেখানেই ছিলাম, হোটেলে নয়। তাঁবুর ভেতর থেকেই যেব্রার দলের খুরের আওয়াজ পাওয়া যেত। তাঁবু সুরক্ষিত, পর্যটকদের জন্য সব রকমের সুব্যবস্থা আছে, মজুদ আছে আধুনিক সরঞ্জাম। স্থানীয় মাসাই উপজাতির জোয়ানেরা তাঁবুর প্রহরায় সদা নিয়োজিত। সাথেই লাগোয়া মাসাইদের গ্রাম। মন চাইলে গ্রাম ঘুরে দেখবারও ব্যবস্থা আছে।
ভীত, শোষিত শ্রেনীদের চেহারায় যে বিনয়ের ছাপ থাকে, তার বাইরেও কেনিয়াবাসীদের চোখেমুখে কিছু একটা ছিলো। আফ্রিকা ভ্রমণে উপরি হিসেবে যা মিললো, তা হল এজেন্টের সাথে জমজমাট খাতির হয়ে গেল। এই-ই সেই এজেন্ট, যার প্রসঙ্গ শুরুতেই টেনেছি। বেটিনা লেকা। বাবা কৃষ্ণাঙ্গ, কেনিয়ান, মা শ্বেতাঙ্গ, ওলন্দাজ। নেদারল্যান্ডের টপ-নচ ইউনিভার্সিটি থেকে চমক লাগানো ফলাফল নিয়ে গ্র্যাজুয়েইশনের পর স্বেচ্ছায় মাসাইমারাতে বাকী জীবনটা কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গল্পে-গল্পে জানা হল, বেটিনা'র মা-ও অল্পবয়সী তরুণী যখন, তখনও প্রেমিকের (পরবর্তীতে স্বামী) সাথে সেভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি, সেসময়ের কথা। বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত বেটিনার মা, দেশ-ভ্রমণের খেয়ালে সুদূর নেদারল্যান্ড থেকে কেনিয়ায় বেড়াতে এসে এখানেই আটকা পড়ে গেছিলেন মায়ার জালে। মম্বাসা'র এমন একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘর বানালেন, যেখানে না ছিলো ইলেকট্রিসিটি, না ছিলো রানিং ওয়াটার। কেনিয়াবাসীর চোখের দ্যুতিতে যে স্বচ্ছতা, সেখানেই কি লুকোনো ছিলো যাদুর কাঠি?
বনপুরীর গল্পে ফেরা যাক। বন্যেরা বনে সুন্দর। 'গ্রেইট মাইগ্রেইশন'-এর মৌসুমে বন্যেরা দলবেঁধে কেনিয়া থেকে তানযানিয়ায় পাড়ি দেয়। লাখে লাখে একযোগে ওদের পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া মারা (Mara) নদীতে, সাঁতরে ঐ পারে তানযানিয়ার পথে রওয়ানার দেবার সুরিয়াল দৃশ্য শতচেষ্টার পরও ক্যামেরায় ধারণ করতে পারিনি - যদিও ফ্রেমবন্দী করেছি অসংখ্যবার। ভয়ানক সাহস সঞ্চয় করে ফটোরিয়ালিযমে টেকনিকের অনুকরণে, আর্টিস্টিক ফ্লেইভারে একটা ছবি জুড়ে দিলাম তার মধ্যে থেকে।
মজার প্যারাডক্স হল, সাভানায় প্রবেশের আগে বেশ খানিক সময় নিয়ে "বনের আইন" সংক্রান্ত ব্রিফিং শুনিয়েছিলেন ট্যুর গাইড। এসইউভি দেখে বনপুরীর বাসিন্দারা যেন ভড়কে না যায়, ওদের অধিকার সর্বাগ্রে, ওদের প্রচ্ছন্ন ক্ষতির কারণ যেন আমরা না হই, এজন্য কেমন কায়দা-কানুন মেনে চলতে হবে, প্রকৃতিপ্রেমী হতে হলে করণীয় কী কী, ইত্যাদির অ, আ, ক, খ।
দ্য কমান্ডমেন্টস।
"দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান" প্রজন্মের অন্ধকার সংষ্কৃতি পেছনে ফেলে মানবজাতি এগিয়ে গেছে।
চিড়িখানার প্রচলিত বিনোদনের শৃঙ্খল টুটবে কবে?
==
[উৎসর্গপত্র: প্রিয় সহব্লগার ও পর্যটক বাণীব্রত রায়, যাঁর মাসাইমারা ভ্রমণের মুগ্ধকর ব্লগ পড়বার সৌভাগ্যই আমাদের সাফারীর জন্য মাসাইমারাকে বেছে নেবার একমাত্র কারণ। সুলেখক ও বন্ধুবর ফারুক আব্দুল্লাহ, তাঁকে জবরদস্তি করে আমার আবোল-তাবোল শোনাতে একটুও বাধে না!]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৬