somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভুনা মাংসে পাল্টে যাওয়া জীবন

১৩ ই আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘর থেকে পালিয়ে আর ঘরে ফেরা হয়নি রুস্তমের। পুরো নাম রুস্তম আলী। বাড়ি দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। গ্রামের লোকেরা সবাই তাকে আদর করে ডাকতো ‘রোস্তম’ বলে।

ছোটবেলা থেকেই রুস্তম ছিল ডানপিঠে স্বভাবের। রুস্তম তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাবা- মা এবং সাত ভাইয়ের সংসারে চলছিল অভাব-অনটন। বাবা হাবিবুর রহমানের পক্ষে তাই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে বন্ধ হয়ে যায় রুস্তমের স্কুলে যাওয়া।

স্কুল বন্ধের কষ্ট সহ্য হয় না তার। তাই একদিন বাবার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় অজানা গন্তব্যে। মনের মধ্যে শুধু একটিই লক্ষ্য। তাকে দাঁড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। আনতে হবে আর্থিক স্বচ্ছলতা।

ঘর থেকে পালিয়ে রুস্তম আশ্রম নেয় দিনাজপুর শহরে। মাত্র পনের বছর বয়সে কাজ নেয় এক হোটেলে। মাঝে মধ্যেই মায়ের কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দিনরাত কাজ করেও হোটেল ম্যানেজারের মন ভরাতে পারে না রুস্তম। নানা অজুহাতে বিনা কারণেই চলতে থাকে গালাগাল। ভুল করে যদি একটি গ্লাস বা প্লেট ভেঙ্গে যায় তাহলে তো কথাই নেই। অকথ্য ভাষায় গালাগালের পর বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হয়।

এতকিছুর পরও রুস্তম দমে না। সবকিছু মেনে নিয়েই হোটেলে রান্নার কাজ শিখতে থাকে। রপ্ত করতে থাকে হোটেল চালানোর উপায়। একই সাথে খরচ কমিয়ে বেতন থেকে টাকা জমিয়ে সঞ্চয় করতে থাকে।

এভাবেই কেটে যায় বছর তিনেক। রুস্তমের সন্ধান পায় পরিবারের লোকেরা। কিন্ত তবুও তার বাড়ি ফেরা হয় না। হোটেলে কাজ করায় নিজের ভাইয়েরাও দূরে সরে যায়। মান সম্মান যাওয়ার ভয়ে অনেক সময় তারা ভাই হিসেবে রুস্তমকে পরিচয় দেওয়া থেকেও বিরত থাকে। আপনজনের এমন ব্যবহারে রুস্তম ব্যথিত হয়। তাই মাঝে মাঝে হোটেলে পরিচিতজনদের দেখলে লুকিয়ে থাকতে হতো রুস্তমের।

এরই মধ্যে রুস্তমের জীবনে আবারো ঝড় ওঠে। একদিন সামান্য অজুহাতে হোটেল ম্যানেজার তার গায়ে হাত তোলে। মার সহ্য হয় না। প্রতিবাদ করে ছেড়ে দেয় হোটেলের কাজ।

কাজ ছাড়লেও থেমে থাকে না রুস্তমের জীবন। নিজেই শুরু করেন ছোট্ট একটি হোটেল। সাথে ছিল জমানো পুঁজি আট হাজার টাকা এবং মানুষকে ভালো খাওয়ানোর মানসিকতা। সেই থেকেই পথ চলা শুরু ।

ঘটনাটি আজ থেকে বিশ বছর আগের। রুস্তমের হোটেলে বসেই শুনছিলাম তার সফলতার কাহিনীটি।

কাটারি চালের ভাত দিয়ে যদি গরুর ভুনা মাংস খেতে চান তবে যে কেউই বলবে রুস্তম হোটেলটির কথা। দিনাজপুরের বড় মাঠের পাশে,ডিসি অফিস থেকে সামনে এগোলেই রুস্তম হোটেল। রাস্তার পাশেই সাইনবোর্ড বিহীন কোন ছোট দোকানকে ঘিরে মানুষের ভিড় কিংবা মোটরসাইকেল বা গাড়ির জটলা দেখলেই বুঝতে হবে এটিই বিখ্যাত ‘রুস্তম হোটেল’।

রুস্তম হোটেলে আধুনিকতার ছোয়া নেই। আধুনিক কোন আসবাব নেই। কিন্তু তবুও আধুনিক মানুষদের ভিড় জমে হোটেলটিতে। উদ্দেশ্য ভেজাল মুক্ত ভালো রান্না খাওয়া। রুস্তম হোটেলে অন্য কোন তরকারী নেই। গরুর ভুনার সাথে দেওয়া হয় কচুশাক, পেঁয়াজের সালাদ, ডাল, লেবু আর কাঁচা মরিচ।

হোটেলে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড় পাত্রে রাখা লালচে ধরণের ‘গরুর ভুনা মাংস’। পেছনের দিকে রান্নাঘর। সেখানে রান্নায় ব্যস্ত আব্দুল ওয়াহিদ। সবাই ডাকে ‘ধলা মিয়া’ নামে। তাকে রান্নার কৌশল শিখিয়েছেন রুস্তম।

রুস্তম জানালেন তার হোটেলে মাঝারি বয়সের গরুর মাংসের মধ্যে বেশি করে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর সয়াবিন তেল দিয়ে ভুনা করা হয়। সয়াবিনের দাম বেশি হলেও তিনি রান্নায় ডালডা বা অন্য কোন তেল ব্যবহার করেন না। দিনে কতজন খায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১০০০ থেকে ১৫০০জন পর্যন্ত।’

রুস্তম হোটেলের ভেতর থেকে এক যুবক চেঁচিয়ে ওঠে বলেন, ‘মামা, পেয়াজের সালাদ আর এক হাফ গরু’। কথা হয় তার সঙ্গে। যুবকটির নাম মশিউর রহমান। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রায়ই সে আসে ভুনা মাংস খেতে। তার কাছে এখানকার মাংসের ভুনা ‘অসাধারণ’।

রুস্তম হোটেলে কর্মচারী পনেরজন। সবাই হোটেলটিকে তাদের নিজ প্রতিষ্ঠান মনে করে। তিন বেলা খাওয়াসহ দিনে ১০০টাকা করে বেতন পায় তারা। বেতন ছাড়াও পরিবারের চিকিৎসা বা অন্য যে কোন বিপদে তারা পাশে পায় তাদের মালিক রুস্তমকে। তাদের ভাষায়, ‘মালিক সকলের দুঃখ বোঝে’। তারা বলেন, ‘গ্লাস ও প্লেট ভাংলে অন্য হোটেলে পয়সা দিতে হয়। কিন্তু তাদের মালিক রুস্তম পয়সা নেয় না’।

রুস্তম জানালেন হোটেলটি তিনি চালু করেন ১৯৯৭ সালে। ব্যবসার প্রথমদিকে ৪ কেজি মাংস রান্না করলে রাতে হোটেল বন্ধের সময়ও অবশিষ্ট থাকত ২ কেজি। তার ওপর ছিলো বিনা পয়সায় খাওয়া স্থানীয় চাঁদাবাজদের অত্যাচার। সব মিলিয়ে টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাকে। কিন্ত তবু তিনি হাল ছাড়েননি। এভাবেই দিনে দিনে বদলাতে থাকে সবকিছু।

মানুষকে খাইয়ে ভালো লেগেছে কখনও? হাসিমুখে রুস্তম উত্তরে বলেন, ‘একবার আওয়ামী লীগের আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্ -কে এখানে বসিয়ে খাইয়েছি। বিল হয়েছিল ২৫৬/-। তিনি তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলেন। দোয়া করেছিলেন আমাকে।’

তার সন্তানদের নিয়ে অন্য ধরণের স্বপ্ন দেখেন রুস্তম। তার সন্তানেরা শিক্ষিত হবে, লেখাপড়া করে প্রকৃত মানুষ হবে, প্রতিষ্ঠা পাবে সমাজে। আর গর্বিত হবে পিতার জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনে।

Click This Link
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×