somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ-জাহিদুল ইসলাম

২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সম্প্রতি গুরুত্ত্বপূর্ণ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে যে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতের রাষ্ট্রয়াত্ত্ব জলবিদ্যুৎ সংস্থা (NHPC Limited); ভারত সরকার ও হিমাচল প্রদেশের সমন্বয়ে গড়া Satluj Jal Vidyut Nigam Limited (SJVN Ltd ); এবং মনিপুর সরকারের মধ্যে একটি যৌথ সংস্থা গঠনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যাতে NHPC, SJVN Limited ও মনিপুর সরকারের যথাক্রমে শতকরা ৬৯ ভাগ, ২৬ ভাগ ও ৫ ভাগ অংশীদারিত্ব থাকবে। NHPC এর ওয়েবসাইটেই এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। মণিপুর সরকারের মুখপাত্র ও রাজ্যের সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী এন বীরেন সিং এর বক্তব্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ‘টিপাইমুখ নিয়ে ভারত সরকারের নীতি খুবই পরিস্কার, টিপাইমুখ প্রকল্প হবেই; কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায়, বিশেষত উত্তরপূর্ব ভারত উন্নয়ন দপ্তর এর জন্য টাকা দেবে।’ অর্থাৎ ধরেই নেয়া যায় যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছি আমরা। বলতে দ্বিধা নেই যে এই সাম্প্রতিক খবর প্রায় ২ বছরের শীতনিদ্রার পর আবারো আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে টিপাইমুখ বাঁধকে।

টিপাইমুখ বাঁধঃ
বারাক নদী থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারনা আসে মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রনের চাহিদা থেকেই। অনেক আগে সেই ১৯৩০ সালের দিকে যখন আসামের কাছাড় উপত্যকায় এক ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয় তার পর থেকেই মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদী বন্যা নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনা করা হয় যার অংশ হিসেবে ১৯৫৪ সালে ভারতের Central Water Commission (CWC) একটি বহুমুখী জলাধারের জন্য সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। বাঁধ তৈরীর জন্য মাইনাধর, ভুবনধর ও নারাইনধর নামক আরো তিনটি প্রস্তাবিত স্থান প্রকৌশলগত কারনে বাতিল হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৪ সালে টিপাইমুখ বাঁধের চুড়ান্ত স্থান হিসেবে নির্ধারিত যা কিনা তুইভাই নদী ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থল থেকে ৫০০ মিটার ভাটিতে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২০০ কিমি উজানে। নির্মিতব্য ১৬২.৮ মিটার উচ্চ এই বাঁধটি একটি রকফিল ড্যাম অর্থ্যাৎ নদীর প্রবাহকে গ্রানুলার (দানাদার) মাটি দিয়ে ভরাট করা হবে এবং পানির প্রবাহকে এক বা একাধিক পানি অভেদ্য স্তর ( যেমন স্টীল পাইল বা কনক্রীট, বা প্লাস্টিক পর্দা) দিয়ে রোধ করা হবে।এতে নুন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩৪ মেগাওয়াট তবে সর্বোচ্চ ১৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হবে।উল্লেখ্য যে বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার যার প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই মনিপূর রাজ্যের আর বাকী ৫ ভাগ মিজোরাম রাজ্যের।ভারত সরকারের তথ্য মতে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষদের উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা যাবে, এটি বন্যা নিয়ন্ত্রন করবে যা বাৎসরিক ৪৫ কোটি রুপির ক্ষয়ক্ষতি রোধ করবে, এই প্রকল্প থেকে ৯৫ কিলোমিটার ভাটিতে ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মানের প্রস্তাব রয়েছে যা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেয়া পানিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ১,২০,৩৩৭ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় নিয়ে আসবে, প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদে মৎস্য চাষের মাধ্যেমে বার্ষিক আয় হবে ১৪ কোটি রুপি, প্রকল্প এলাকা একটি উৎকৃষ্ট পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে, সৃষ্ট হ্রদ উজানের এলাকার মানুষদের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করবে সেই সাথে প্রকল্পের ফলে বছরের বিভিন্ন সময় নদীর পানির গভীরতার উঠা নামা কমে যাওয়ায় কলকাতা বন্দর থেকে বাংলাদেশ হয়ে শীলচর পর্যন্ত পণ্য পরিবহণের সম্ভাব্যতা দেখা যাবে।

বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাবঃ
একটি বাঁধের মূলত দুই দিকেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, প্রথমতঃ বাঁধের উজানে আর দ্বিতীয়তঃ বাঁধের ভাটিতে। যেকোন বাঁধই তার উজানে একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরী করে এবং এই জলাধারকে কেন্দ্র করেই কিন্তু উজানে বাঁধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে ভাটিতে মূল সমস্যা সৃষ্টি করে বাঁধের কারনে সৃষ্ট নিয়ন্ত্রিত প্রবাহ। অর্থ্যৎ ভাটিতে আগে যেখানে প্রাকৃতিক ভাবে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হতো সেখানে বাঁধের কারনে প্রবাহের পরিমান কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। এই প্রবাহের মান ও বছরের বিভিন্ন সময়ে তার বন্টনের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হবে তার উপর নির্ভরশীল জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশ। একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ টিপাইমুখের ভাটিতে থাকায় বাংলাদেশে তার প্রভাব পরবে দ্বিতীয় ভাবে।

টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার আগে দেখা যাক এই প্রকল্প নিয়ে কী কী গবেষণা হয়েছে। টিপাইমুখ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার জানা মতে তিনটি স্বীকৃত গবেষণার উৎস রয়েছে, একঃ উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (FAP 6)[২], দুইঃ টিপাইমুখ প্রকল্পের জন্য NEEPCO এর EIA রিপোর্ট[১], এবং তিনঃ IWM (Institute of Water Modeling) এর টিপাইমুখ এর উপর একটি অপ্রকাশিত স্টাডি যা ২০০৫ এ একটি কর্মশালায় উপস্থাপিত প্রবন্ধে তথ্যসুত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় [৩]। এখন দেখা যাক এই গবেষণাসমুহ ও পানিসম্পদ কৌশলের মৌলিক জ্ঞানের আলোকে এই প্রকল্প বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলতে পারেঃ
o এই প্রকল্পের ফলে বর্ষাকালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে প্রবাহ ১০% থেকে ৩০% হ্রাস পাবে।
o বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে ফলে পলিমুক্ত পানি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।
o বাঁধের কারনে বন্যার সময় পানি না আসায় বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের হাওড়গুলি একসময় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে সেই সাথে বিলুপ্ত হবে বেশ কিছু প্রজাতি। এই এলাকার মানুষদের তখন বর্ষা মৌসুমে জীবিকার জন্য অন্য কোন পথ বেছে নিয়ে হবে।
o বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ শতকরা ৬০ ভাগ থেকে ১১০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে । এই বর্ধিত প্রবাহের ফলে নৌচলাচল, সেচ ও মৎস্য চাষ বৃদ্ধি ঘটবে কিন্তু কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যহত হবে।তবে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হলো বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে।
o কখনো কখনো পর্যায়ক্রমে কিছু বছর থাকে যেখানে যেসময় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক গড় প্রবাহ থেকে অনেক কমে যায়।প্রাপ্ত তথ্য মতে বরাক অববাহিকায় ১৯৭৯-১৯৮১ পর্যন্ত এরকম একটি পর্যায় গিয়েছে যেখানে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে পানির অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম ছিল। টিপাইমুখ বাঁধ হবার পরে এরকম একটি সময় আবার যদি আসে সেক্ষেত্রে বাঁধের উজানে জলাধারের পানির স্তর কমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের টারবাইন থেকে যে পরিমান পানি ভাটিতে প্রবাহিত হবে তা বাঁধ পূর্ব পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে অনেক অনেক কম। এই অতি শুষ্ক মৌসুমের কারনে জলাধারের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে লক্ষ্য থাকবে বেশী পরিমান পানি সঞ্চয় করার যা প্রকারান্তরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাবে এবং সেই সাথে বর্ষা মৌসুমে ভাটিতে পানির প্রবাহ আরো কমে যাবে। এই পরিস্থিতি তিন চার মৌসুম ধরে চললে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে বাংলাদেশে।
o প্রত্যেক জলাধারের একটা ধারন ক্ষমতা থাকে, সেই ধারন ক্ষমতার চেয়ে বেশী পানি জলাধারে জমা হলে তা স্পিলওয়ে বা বিকল্প পথ দিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত করা হয়। বরাক অববাহিকায় যদি পর পর কিছু অতি বর্ষা মৌসুম আসে সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা আগের মতই থাকলে এই অতিরিক্ত পানি বিকল্প পথে বের করে দিতে হবে।বাঁধ হবার পর ভাটিতে মানুষের জীবন যাত্রা পরিবর্তিত হবে অর্থাৎ মানুষ স্বাভবতই তাদের ঘরবাড়ি আগের মত উঁচু করে বানাবেনা, বন্যার প্রকোপ কমে যাওয়ায় অববাহিকার অধিক মানুষ বসবাস করবে। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় অতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য অধিক পানি ছেড়ে দিলে তা ভাটিতে অকষ্মাত বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে।
o ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।ভূতাত্ত্বিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল আসলে অসংখ্য ‘ফোল্ড ও ফল্ট’ বিশিষ্ট এবং এই অঞ্চলে গত ১৫০ বছরে রিক্টার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে শেষটি ছিল ১৯৫৭ সালে যা কিনা টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে। এছাড়া “জলাধার আবেশিত ভূমিকম্প”এর আশঙ্কা আছে।
o যদি কোন যান্ত্রিক কারনে বাঁধের টারবাইনগুলো অকার্যকর হয় অথবা গ্রীডের কোন সমস্যার কারনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় তখন টারবাইন ছাড়া অন্য কোন পথ দিয়ে সেই সময়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা থাকবে কিনা বা থাকলেও তা কত লেভেলে ( সমুদ্র সমতল থেকে ) থাকবে সেটিও বিবেচ্য বিষয়।
o টিপাইমুখ প্রকল্পের বাঁধ থেকে ১০০ কিমি ভাটিতে একটি সেচ প্রকল্পের প্রস্তাব আছে। আপাতত বলা হচ্ছে এক লক্ষ বিশ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা রাখে হবে। যদি এই প্রকল্পের জন্য পানি অপসারন আর অতিশুষ্ক মৌসুম এর প্রভাব একসাথে হয় সেক্ষেত্রে বরাক নদীর প্রবাহ আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যেতে পারে বাংলাদেশে যার প্রভাব হবে আরেকটা ফারাক্কার মত।

টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানঃ
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশে সরকারের অবস্থান ঠিক পরিষ্কার নয়। টিপাইমুখ নিয়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার এর পক্ষ থেকে প্রজাতন্ত্রের সাংসদ, আমলা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় যারা ২০০৯ সালে ভারত সফর করেন। এই সফরের পূর্বে ও পরে এই ইস্যু নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাক্তিবর্গের বক্তব্য সরকারের অবস্থানকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

সফরের পূর্বে পানিসম্পদ মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক সংবাদ মাধ্যমে বলেন যে, ‘টিপাইমুখ বাঁধটি যদি সেচ প্রকল্প হয় তাহলে তা অবশ্যই ক্ষতিকর হবে, এর বিরোধিতা জাতীয়ভাবে করা উচিৎ। কিন্তু বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে আরো সমীক্ষা চালিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে(প্রথম আলো, ৩০ জুলাই, ২০০৯)’। সংসদীয় দলের পানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ‘যেহেতু জলাধারে পানি সংরক্ষণ করা হবে তাই এর কিছু প্রভাব ভাটিতে পড়বে। তবে সেই প্রভাব টিপাইমুখ পানি বিদ্যুত প্রকল্পের সারপ্লাস বিদ্যুত বাংলাদেশ ব্যবহারের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে (সাপ্তাহিক ২০০০, ১২ জুন, ২০০৯)’

সফর শেষ করে সাংবাদিক সম্মেলনে সংসদীয় দল মত প্রকাশ করে যে, ‘হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমণকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। সেই সাথে প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারাজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি।’ তারা এই মর্মে সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯)। সফর শেষে জনাব রাজ্জাক আবারো উল্লেখ করেন যে, ‘তারা এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ভারত বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছুই করবেনা (দি ডেইলী স্টার, ৫ আগষ্ট, ২০০৯)’। একই সময়ে সাংসদ এ বি এম রুহুল আমীন মন্তব্য করেন যে, ‘এই প্রকল্প এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং তিনি মনে করেন যে তার জীবদ্দশায় এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবেনা(দি ডেইলী স্টার, ৫ আগষ্ট, ২০০৯)’।

সাম্প্রতিক কালে যখন এই বাঁধ নির্মানে ভারতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি সংগঠনের সংবাদ যখন এই ইস্যুটিকে আবার আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে তখনো এই নিয়ে সরকারের বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গের মন্তব্য আমাদের বিভ্রান্ত করছে। যেমন বাংদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহি:প্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক শামীম আহসান মন্তব্য করেন যে, ‘টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রশ্নে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক কিছু ভারত করবেনা না (বিবিসি, ১৯ নভেম্বর, ২০১১)’। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সংসদীয় কমিটির সফরকারী দলের অন্যতম সদস্য সাংসদ আবদুর রহমান মন্তব্য করেন যে, ‘প্রতিনিধিদলে আমাদের কারিগরি কমিটি ছিল, তারাও সে জিনিসটি তাদের কাছ থেকে বুঝেছে যে ওখানে বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশ বরং উপকৃত হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে যখন পানি থাকবে, তখন বাংলাদেশ প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাবে এবং যখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকবে না, তখন বাংলাদেশ পানি সেখান থেকে পাবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ বরং সংরক্ষিতই হবে (প্রথম আলো ২০ নভেম্বর, ২০১১)’। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান মন্তব্য করেন যে, ‘টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয় (ইটিভি, ২০ নভেম্বর, ২০১১)’। তিনি তুলনা করে বলেন যে, ‘গড়াই নদীর খনন যেমন আমাদের (বাংলাদেশের) নিজস্ব ব্যাপার তেমনি টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীন ব্যাপার।’

সর্বশেষে টিপাইমুখের প্রকল্প নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি [৮] অনুযায়ী বাংলাদেশ মনে করে যে, ‘টিপাইমুখের প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বেগ ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে ভারতের উচিৎ ছিল স্বচ্ছতার সঙ্গে বাংলাদেশকে তথ্য দেয়া। আর ভাটির দেশ হিসেবে বরাকসহ যেকোনো নদীতে কোনো অবকাঠামো তৈরির আগে বাংলাদেশকে আগে জানানোটা জরুরি।সেই সাথে বাংলাদেশ এটাও মনে করে যে এই প্রকল্পের বিষয়ে পরবর্তী কোন পদক্ষেপে বাংলাদেশকে অবহিত করার প্রয়োজন রয়েছে।’ উল্লেখ্য যে এই প্রেস রিলিজেও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রভাব বা ক্ষতিকর দিক নিয়ে কোন বক্তব্য দেয়নি বা আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতকে তা খতিয়ে দেখার বা এই বিষয়ে যৌথ গবেষনার কোন প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেনি।

উপরোক্ত মন্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করলে করেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ঃ
১) বর্তমান সরকার ভারত কর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানে আদৌ চিন্তিত নয়। সরকারের সর্বোচ্চ মহল এটাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম বলে মনে করে।
২) সরকার মনে করে, বা টিপাইমুখ নিয়ে গঠিত সংসদীয় কমিটি ভারত সফরের পরে এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছে যে, এই বাঁধ নির্মানে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা বরং এটি বাংলাদেশের জন্য উপকার বয়ে আনবে।
৩) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের এমন একটি ধারনা হয়েছে যে সেচ প্রকল্প না হলে সেটি বাংলাদেশের জন্য কম ক্ষতিকর হবে।
আমি নিচের পরিচ্ছেদের এই বিষয়গুলিতে আমার অভিমত ব্যক্ত করছিঃ
আসলেই কি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয়ঃ
নৌচলাচল ব্যাতিরেকে আন্তর্জাতিক নদী সমূহের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কনভেনশন [৬] মতে, ‘আন্তর্জাতিক নদী বলতে বোঝায় সেই সকল নদী যা একাধিক রাষ্টের মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান’ (ধারা ২বি)। সেই বিচারে বারাক নদী একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীতে বাঁধ নির্মান হলে তার প্রভাব ভাটিতে অর্থাৎ বাংলাদেশে পড়বে। জাতিসংঘের কনভেনশনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ‘আন্তর্জাতিক নদী সমুহের অংশীদার রাষ্ট্রসমূহ ঐ নদীসমুহের ব্যবহারে এই মর্মে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে যেন তা অন্য দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমানে ক্ষতির কারন না হয়’ (ধারা ৭ এর ১)। উল্লেখ্য যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের সংবিধির ৩৮ ধারা অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক যেকোন চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস। এই বিচারে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তি একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের চুক্তি ( Vienna Convention on the Law of Treaties 1969) এবং এই দুই দেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইন যা কিনা ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেনে চলতে দুই দেশই বাধ্য। গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ তে স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতা-প্রসূত এবং কোন পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমুহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ব্যাপারে একমত।’ বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ দল যদি প্রমান করতে পারে টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ও সাম্যতা বিনষ্ট হচ্ছে তাহলে তার পরেও টিপাইমুখ বাঁধ করতে গেলে তা গঙ্গাচুক্তি ভঙ্গের কারন হবে।

উপরের আলোচনায় এটি প্রতীয়মান হয় যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান কোন মতেই ভারতের অভ্যান্তরীন বিষয় নয় বরং তা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং বংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পরিমান ক্ষতি সাধন করে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

আসলেই কি টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচকঃ
সরকারের কারিগরী কমিটির মতে টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের উপকার হবে দুই ক্ষেত্রে, একঃ বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমবে, দুইঃ শুষ্ক মৌসুমে অধিক পানি পাবে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
• প্রথমতঃ বন্যা আসলে কি কমবে ?
বরাক নদীর ভাটির দিকের অঞ্চল সিলেটের হাওড় এলাকায় বর্ষার শুরুতে আগাম বন্যা হয় আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি কমে আসে।টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে।এর প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়বে [৪]। অর্থাৎ বন্যা মুক্ত হবার যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়, যেটি হতে পারে তা হলো বন্যার স্বাভাবিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে।

এছাড়া এই লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে, ফলে যে পানি ভাটিতে আসবে তাকে এক কথায় বলা যায় “রাক্ষুসী পানি”। এই পানি পলিমুক্ত বলে এর পলিধারন ক্ষমতা অনেক বেশী আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।

আর যদি ধরেই নেই যে বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে সেখানেও প্রশ্ন আসে, এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক? এ প্রসংগে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ ডঃ জহির উদ্দীন চৌধুরী বলেছিলেন[৬] যে, সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে বন্যার সময় যদি পানি কমানো যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির পরিমান কম থাকে তখন পানির সরবরাহ বাড়ানো যায়–এটা খুবই ভাল একটি বিষয়। সে বিবেচনা থেকেই ভারত টিপাইমুখ বাঁধের পেছনে তাদের যুক্তি হিসেবে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়। এর একটি নিজস্ব ইকোসিস্টেম রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ফলে বন্যার পানি কমা বা শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশী পাওয়ার যে আশ্বাস ভারত দিচ্ছে তা এই এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

• দ্বিতীয়তঃ শুষ্ক মৌসুমে অধিক পানি কি ইতিবাচক ?
এ প্রসংগে এই লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এই হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোকগুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে। আর যদি ধরেও নেই যে এই বর্ধিত প্রবাহ চাষাবাদের জমিকে খুব বেশী প্লাবিত করবেনা সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়। এই জমিগুলো বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ায় বিপুল পরিমান পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় তা আগের মত আর প্লাবিত হবেনা। ফলে জমিগুলো তাদের উর্বরতা হারাবে।

ফুলেরতল ব্যারেজ না হয়ে শুধু মাত্র বাঁধ হলে কি বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক কিছু হবেনাঃ
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে এমনটি মনে হচ্ছে যে তারা মনে করেন যে এই প্রকল্পে সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান না করে শুধু বাঁধ হলে তেমন ক্ষতি হবেনা। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক মতামত। এই লেখাতে ‘বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাবঃ শীর্ষক শিরোনামে পরিচ্ছেদটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেখানে এই বাঁধের ফলে বাংলাদেশে প্রভাবের যে নয়টি পয়েন্ট আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ফুলেরতল ব্যারেজ সম্পর্কিত, বাকী আটটিই হচ্ছে বাঁধ সম্পর্কিত। সুতরাং এই যুক্তি অসাড় ও বিভ্রান্তিমূলক।

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের অবস্থানঃ
শুরু থেকেই টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের অবস্থান ছিল এই যে এই বাঁধে বাংলাদেশের উপর কোন প্রভাব পড়বেনা। ২০০৯ সালে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে তখনও ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তারা এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। ঠিক একই রকম আশ্বাস আমরা পরবর্তীতেও পেয়েছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষক দল টিপাইমুখ সফরের সময়কাল আর বর্তমান সময়ের মধ্যে এই ইস্যু নিয়ে ভারতের অবস্থানের কোন পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়েনি। এর সমর্থন পাওয়া যায় সম্প্রতি মণিপুর সরকারের মুখপাত্র ও রাজ্যের সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী এন বীরেন সিং এর বক্তব্যে যেখানে তিনি বলেছেন যে টিপাইমুখ নিয়ে ভারত সরকারের নীতি খুবই পরিস্কার, টিপাইমুখ প্রকল্প হবেই। এছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ প্রকাশের প্রতি উত্তরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে যে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। সেই সম্মেলনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রকল্পটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু সেচকাজের জন্য নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া হবে না [৭]। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কিসের ভিত্তিতে ভারত জানাচ্ছে যে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হবেনা? এই প্রকল্পের জন্য ভাটিতে বিশেষত বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক, পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক কি পরিবর্তন হবে সেই বিষয়ক কোন গবেষণা বা নিদেনপক্ষে কোন কেইস স্টাডিও হয়নি ভারতের পক্ষ থেকে। শুধুমাত্র এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাই রিপোর্টে ( Environmental Impact Assessment) এর ‘Impact of The Project on Environment’ শীর্ষক চ্যাপ্টারটিতে একটি মাত্র প্যারাগ্রাফে ভাটিতে কী হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে যতে বলা হয়েছে, ‘বাঁধের কারনে বর্ষা মৌসুমে পানি ৩০% কমে যাবে আর শুষ্ক মৌসুমে ১১০% বেড়ে যাবে, এবং এই বর্ধিত পানি দিয়ে সেচের মাধ্যমে রবি শস্য ফলানো যাবে।’ সুতরাং শুধু প্রযুক্তিগত কোন তথ্য ব্যাতিরেকে ঢালাও ভাবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা– সেটা মেনে নেয়া অবাস্তব এবং অবান্তর। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এখনই এর প্রতিবাদ জানানো। এবং সেই সাথে বাংলাদেশ সরকার শুধু উদ্বেগ প্রকাশ না করে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রভাব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া উচিৎ।

পরিশেষেঃ
ভারত এই টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের দু’টি মূল প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে, একঃ বন্যা নিয়ন্ত্রন আর দুইঃ বিদ্যুৎ উৎপাদন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরো বিকল্প প্রযুক্তি ভারতের কাছেই আছে, উদাহরণ সরূপ Indo-Us Nuclear Agreement কথা বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মরিয়া হয়ে এই প্রকল্প হাতে নেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত যেখানে খোদ ভারতেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বিদ্রোহ চলছে। বন্যা নিয়ন্ত্রনের কথা যদি বলি পৃথিবীতে এখন বন্যা নিয়ন্ত্রন এই কথাটিই ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে তার পরিবর্তে আসছে বন্যা ব্যাবস্থাপনা। সেই আলোকে এটি এখন প্রমানিত যে বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য ” স্ট্রাকচারাল” পদ্ধতির চেয়ে “নন-স্ট্রাকচারাল” পদ্ধতি অধিক পরিবেশ বান্ধব এবং তা ভবিষ্যতের জন্য ভাল। অর্থাৎ ভারত ইচ্ছে করলেই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন না ঘটিয়েও তার দেশের সমস্যা সমাধান করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই রকম একটি বিতর্কিত প্রকল্প হাতে নিয়ে দু’টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অহেতুক শত্রুতা বাড়িয়ে বিশ্বশান্তির বিঘ্ন ঘটানোর কোন অধিকার ভারতের নেই। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে একই সাথে কুটনীতি আর আর বিচক্ষণতার আশ্রয় নিয়ে হবে, যোগ্য স্থানে যোগ্য লোককে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বিশেষজ্ঞের কাজ যেমন রাজনীতিবিদ দিয়ে হয়না তেমনি বিশেষজ্ঞদের রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। দেশের প্রয়োজনে আমাদের ব্যাক্তিগত বা দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে তবেই আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দিতে উপহার পারব। আর এ জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চাইঃ
o কূটনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ সরকার জরুরী ভিত্তিতে “কীভাবে ভারত সরকার নিশ্চিত হয়েছে যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান হলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা” এই প্রশ্নের উত্তর বা ব্যাখ্যা চা্ওয়া ভারতের কাছে।
o সেই সাথে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত অগ্রসর হলে কীভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে আলোচনা বা আইনের আশ্রয় নিতে পারে সেটি নিয়েও অগ্রসর হবার সময় এসেছে।

জাহিদুল ইসলাম: পানিসম্পদ কৌশলে পিএইচডি গবেষণার জন্য কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টাতে অবস্থানরত।

Click This Link
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×