somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেমন ছিল শেখ মুজিবের শাসনামলঃ মানুষের আয় এবং দ্রব্যমূল্যের 'লাগামহীন ঘোড়া'

২৬ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কেমন ছিল মানুষের আয় ও দ্রব্যমূল্যের হালচালঃ
মুজিবের কৃষিনীতির ফলশ্রুতিতে লাভের অংক গুণেছে জোতদার,ধনিক শ্রেণী। সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে তারা যথেচ্ছভাবে বিভিন্ন পণ্যের বিশেষত খাদ্যশষ্যের দাম বাড়িয়েছে বহুলাংশে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যকে কমিয়ে আনার ন্যুনতম উদ্যোগ পর্যন্ত না নিয়ে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতেও শেখ মুজিব রসিকতা করে বলেছিলেনঃ “কেমন বুঝছেন শহরের সাহেবেরা।” – যেন এই বর্ধিত মূল্যের অর্থ তিনি গরিব এবং ভূমিহীন কৃষকদের হাতে পৌছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ভূমিহীন ও গরীব কৃষক তথা ক্ষেত মজুরদের অবস্থা যে কত শোচনীয় ছিল তার চিত্র মিলবে নিচের এই পরিসংখ্যানে।

১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন “এ মোহ পরিত্যাগ করুন- সিপিবির বন্ধুদের প্রতি” এর পৃঃ ৩৮ এ।

এখানে ৬টি অর্থবছরে খাদ্যমূল্য এবং কৃষি বেতনের তুলনামূলক সূচক উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং উভয় সূচকের ক্ষেত্রেই ১৯৬৯-৭০ সালকে ভিত্তি অর্থাৎ ১০০ ধরা হয়েছে।




দেখা যায়, আওয়ামীলীগের শাসনকালের কোন সময়েই খাদ্যশস্যের মূল্য বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালের কাছাকাছিও থাকেনি। আয় যখন হয়েছে ৯৯টাকা, মূল্য তখন থেকেছে ১২২টাকা। এই ব্যবধান মাত্রাতিরিক্ত সীমা ছাড়িয়েছিল ৭৪-৭৫ শাসনামলে। এ সময়ে একজনের আয় ছিল ২৬১.৪০ টাকা আর খাদ্যমূল্য চলে গিয়েছিল ৪৬৯.৫৫ টাকায়।
এ তো গেল কেবল খাদ্যের দিকটি। অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ‘পাগলা ঘোড়া’ বুঝতে নিচের পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ্য করুন। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ‘সিলেক্টেড ইকনোমিক ইন্ডিকেটরস’ এ উল্লেখ করা হয়েছে যেখান থেকে মুনীর উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত “বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর” এর পৃঃ ১৭২ এ তা তুলে ধরা হয়েছে।



২২ মাসে মূল্যবৃদ্ধি ১৫০০ ভাগঃ

৭২ সালের জুলাই থেকে ৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ২২ মাসের মধ্যে ১০০ ভাগ নয়,২০০ ভাগ নয় কোন কোন ক্ষেত্রে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেড়েছে ৮০০ ভাগ, বিশেষ ক্ষেত্রে তা ১৫০০ ভাগ হতেও দেখা গেছে !
সরিষার তেল ও নারিকেল তেলের দাম বেড়েছে ১৩২ ভাগ ও ২১৮ ভাগ। হলুদের দাম বেড়েছে ২২০ ভাগ। আদার বেড়েছে ৩৫০ ভাগ। চালের দাম বেড়েছে ১৪০ ভাগ। আর সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে লংকার, একেবারে ১৫০০ ভাগ।
চালঃ এই সময়ে সরকার রেশনের চালের দাম বাড়িয়েছেন ২৯ টাকা থেকে ৪০টাকায়। বৃদ্ধির হার ৩৮%, ১৯৭২ সালের ১ জুলাই প্রতিমণ সরু আমন চালের খুচরো দাম ছিল বাজারে ৭৫ টাকা। ৭৩ এর জুলাইয়ে হয়েছে ১১৫ টাকা। ৭৪ এর মার্চে বেড়ে হয়েছে ১৬০ টাকা। বৃদ্ধির হার ২১৫%
মশুরঃ ১৯৭২ এর পহেলা জুলাই প্রতিমণ ৪১ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ১৫০ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৫৪%
মুগ ডালঃ ৭২ এরজুলাইয়ে প্রতিমণের ৫০টাকা আর ৭৪ এর মার্চে ১৮০ টাকা, বৃদ্ধির হার ২৬০%
মটরঃ ৭২ এর জুলাইয়ে প্রতিমণের দাম ৩৫ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ১৩০ টাকা, বৃদ্ধির হার ২৭০%
সরিষার তেলঃ ৭২ এর জুলাইয়ে প্রতিমণের দাম ২৮০-৩২৫ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ৬২০-৬৫০ টাকা, বৃদ্ধির হার ১৩২%
সয়াবিনঃ ৭২ এর জুলাইয়ে প্রতিমণের দাম ২৩০ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ৫৯০ টাকা, বৃদ্ধির হার ১৫৬%
ঘিঃ ৭২ এর জুলাইয়ে প্রতিমণের দাম ৪২৬-৪৫০ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ১০০০-১১০০ টাকা, বৃদ্ধির হার ১৩০%
গরুর গোশতঃ ৭২ এর জুলাইয়ে প্রতি সের দাম ৩.০০ – ৩.২৫ টাকা, ৭৪ এর মার্চে ৯-১০ টাকা, বৃদ্ধির হার ২৩৩%
এরকম, খাসির গোশতের দাম বেড়েছে ২০০ ভাগ, মোরগের ১৫৫ ভাগ, জিরার ৩০০ ভাগ, হলুদের ২৬০ ভাগ, লম্বা হলুদের ২৫৩ ভাগ, ধনিয়ার দাম ১৫০ ভাগ, ছোট ও বড় এলাচীর যথাক্রমে ২৫০ ভাগ ও ১৫০ ভাগ, কালজিরার ৩১৭ ভাগ, সুপারির ২২৫ ভাগ, গরুর দুধের দাম ১১০ ভাগ বেড়েছে। জ্বালানি কাঠের দাম বেড়েছে ২৪০ ভাগ, কেরোসিনের বেড়েছে ২৪৩ ভাগ। ৭২ সালের জুলাইয়ে প্রতিমণ তোলা তেজাবী সোনার দাম ছিল ৩০০টাকা, ৭৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৫০ টাকা, বৃদ্ধির হার ২১২ ভাগ। গিনি সোনার দাম বেড়েছে ২০৩ ভাগ এবং রূপার দাম বেড়েছে ২০৮ ভাগ।

(উপরোক্ত তথ্যগুলো মুনীর উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত “বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর” এর পৃঃ ৩৭৯-৩৮০ হতে নেয়া। )


সোনার বাংলা শ্মশান কেন?

আওয়ামী লীগ ৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রদত্ত ঘোষণায় ১০ টাকা মণ দরে গম এবং ২০ টাকা দরে চাল খাওয়ার অংগীকার করেছিল। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ শীর্ষক যে প্রচারনাপত্রটি লক্ষ লক্ষ কপি দেশব্যাপী প্রচারের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ এই অঙ্গীকারটি করেছিল তাও উল্লেখ করা দরকার। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব বাংলার দুরবস্থার বিভিন্ন দিকের বর্ণনা প্রসঙ্গে খাদ্যশস্যের মূল্যের কথাও বলা হয়েছিল। প্রচারপত্রটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলঃ




অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে সেই একই আওয়ামীলীগের শাসনামলে প্রতিটি জিনিসসের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বহু দূরে চলে গিয়েছিল। সে চিত্রটিই ফুটিয়ে তুলেছে অন্য একটি প্রচারপত্র। ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই প্রচারপত্রটি প্রচারকরে। ৭০ সালে আওয়ামীলীগ প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এর আদলে স্বাধীনতার আগে এবং পড়ে বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের পার্থক্যের চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছিল। সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ভাসানী’ প্রথম খণ্ডের পৃঃ ৪৬৩-৪৬৪ এ হতে তা তুলে ধরলামঃ



বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক বক্তব্যেও উঠে এসেছে এসব অনাচার নিয়ে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে মোজাফফর ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্য এক বিবৃতিতে বলেন,
“ন্যাপ কর্মীরা দুর্নীতি, অরাজকতা ও দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণের পর বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনযন্ত্র তাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে।”
কিছুদিন পর ন্যাপ প্রধান মোজাফফর আহমেদ পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি ভাত দিতে পারবেন না, তবে কিল মারার গোঁসাই কেন?” “২২ পরিবারের পরিবর্তে ২২শ পরিবার গড়ে তোলা হচ্ছে” বলেন একই জনসভায় মতিয়া চৌধুরী
(তথ্যটুকু উল্লেখিত হয়েছে জগলুল আলমের ‘বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-১৯৮৯” এর পৃঃ ৭৭ এ) ।
--- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- --- ---

আজ এ পর্যন্ত ই, পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোকপাত করবোঃ
=> খাদ্য সংকট, ৭৪ এর ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ এবং বৈদেশিক সাহায্যের কড়চা
=> রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং রক্ষীবাহিনী
=> বাকশাল, সংবাদপত্রের উপর আঘাত
=>মওলানা ভাসানীর সরকারবিরোধী আন্দোলন
আর সেই সাথে থাকতে পারে উইকিলিক্সের ফাঁস করা কিছু গোপন নথিপত্রের অনুবাদ।

আর প্রথম পর্ব পাবেনঃ
কেমন ছিল শেখ মুজিবের শাসনামলঃ ৭০ এর নির্বাচনী ওয়াদা, কৃষি খাত আর সমাজতন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য

আর ফেসবুক হতেঃ কেমন ছিল শেখ মুজিবের শাসনামলঃ ৭০ এর নির্বাচনী ওয়াদা, কৃষি খাত আর সমাজতন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১:৩৬
২২টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×