ভূমিকা : আকাশে ফোটা ফুলেদের ধর্মই এমন-যারা ফোটায় ফুল ফুটানোর আনন্দে ফোটায়, আর যাদের জন্য ফোটায়...?
এক
যখন একুশ শতকের ড্রয়িংরুমগুলোর দেয়াল জুড়ে সভ্যতা ঝুলে ছিল, শিল্প ঝুলে ছিল হরিণ আর ব্যাঘ্র্যের চামড়ায়, ঝুলন্ত মোনালিসার রহস্যবৃত হাসির রহস্য ব্যবচ্ছেদ করণের তীব্র প্রয়াসে যখন রাত দুপুরে কোন কোন ড্রয়িং রুমের ভদ্রলোকরা নেশাতুর চোখ সমেত আঙ্গুর ফলের রস থেকে তৈরী পানিয়ের পেয়ালায় তুমুল ঝড় তুলতো, সেই সময়ের ভোরগুলোতে দৈনিক খবরের কাগজগুলো ভদ্রলোকদের বাড়ির ফটকের ফাঁক-ফোকর খুঁজে নিয়ে নিজেদের ক্ষীণকায় শরীর গলিয়ে দিতে পারার আনন্দে সাদা সাদা দাঁত কেলিয়ে হাসতো ! সেই সময়ে ভদ্রলোকরা বেড টি খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলাতো । খবরেরর কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে তারা কখনও বিষম খেতো, চায়ের পেয়ালা ছলকে যেতো, ভদ্রলোকদের সুগন্ধি পরিচ্ছদ কিম্বা ধবধবে চাদরে ছলকে যাওয়া চায়েরা খানিক দাগ রেখে যেতে সমর্থ হতো এমন কোন খবরে, যেমন-' উন্নত বক্ষদেশী অমুক হৃদয় কাঁপানো তরুণী তারকা তার সুগঠিত স্তনযুগল প্লাস্টিক সার্জারি করে চির উন্নত রাখার ব্যবস্থা করেছেন,'- ভদ্রলোকদের চোখগুলো তখন চকচক করতো । সেই সময়ের এক ভোরে দৈনিক খবরের কাগজের একটি খবরে ভদ্রলোকদের চোখ আটকে গিয়েছিলো । তাদের কেউ কেউ অস্ফুটে 'আহারে' শব্দ মুখনিসৃত করে দিয়েছিল, কেউ কেউ সহমর্মী হয়ে উঠেছিল । কারো কারো মুখে থু থু জমেছিল-ঘৃণার থুথু, জানালার কাছে গিয়ে ভীষণ ঘৃণায় তারা থুথুগুলো ছুঁড়ে দিয়েছিল বাতাসে । মোটের ওপর, খবরটি তাবৎ ভদ্রলোকের দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিল-ঘৃণায় কিম্বা ভালোবাসায় । নজর কাড়া সেই খবরটি ছিল,- 'বিশ্ব মোড়ল দ্বিতীয় সম্রাট অমুকের প্রিয় পোষা কুকুরটির আকস্মিক প্রয়াণে শোকার্ত সম্রাট পরিবার !'
দুই
সেই সময়ে একুশ শতকের সভ্য আকাশে যখন ফুটছিল ফসফরাস ফুল, ফুলগুলো যখন ঝরে ঝরে পড়ছিল, বিদ্ধ হচ্ছিল অপাপবিদ্ধ কোন শিশু যিশুর বুকে, ফসফরাস ফুলের ধারালো পাপড়িরা যখন কেটে কেটে দিচ্ছিল কোন শিশু যিশুর পাঁজর, গলার কন্ঠা হাঁড়, কোন শিশু যিশুর মুখ দিয়ে যখন গলগল করে রক্তের স্রোত উদগিরন হচ্ছিল, তারপরও যখন ফসফরাস ফুলগুলো আকাশে ফুটে ফুটে ঝরে পড়ছিল শিশু যিশুদের আবাদি জলপাই বাগানে, জলপায়ের সবুজ সবুজ বাগানগুলো যখন ধূসর হচ্ছিল, ধূসর থেকে পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছিল, তারপরও যখন ফুটে পড়া ফসফরাস ফুলের বিষাক্ত চুম্বনে শিশু যিশুদের আবাসনগুলো কর্পুরের মতন গুড়োগুড়ো হচ্ছিল, চূড়চূড় হয়ে যাচ্ছিল, তখনও যখন ভদ্র সমাজ ভদ্রভাষায় 'তীব্র নিন্দা আর তীব্র নিন্দা' জানিয়ে যাচ্ছিল যথারীতি, তখনও যখন ধর্মীয় উপাসনালয় মসজিদগুলোর চার দেয়ালজুড়ে অসহায় কিছু শব্দ আর্তনাদের মতো মাথাকুটে মরছিল- 'হাজবুনাল্লাহু ওয়ানিয়মাল ওয়াকিল- হাজবুনাল্লাহু ওয়ানিয়মাল ওয়াকিল', 'হে ঈশ্বর তুমি তাদের বিচার করো- তুমি তাদের বিচার করো;' এরকম প্রার্থনার করুণ সূরে, আস্তচলের বোবা ঈশ্বর তখনও নীরব ছিলেন, আর উপাসনালয়ের দ্বারে দ্বারে করুণার সিকি-আধুলি ভিক্ষারত, কোমড় থেকে দু'পা উড়ে যাওয়া ৬৫ বছরের ভিক্ষুক আবু হিশাম তখন ক্রুর হাসি হাসছিলেন, হেসেই যাচ্ছিলেন !
বিশ বছর আগের, বুড়ো বিশ শতকের সভ্যতার পড়ন্ত বেলার লালচে আকাশেও মূর্হমুর্হ ফুল ফুটতো, ফসফরাসের মতো অন্য কোন ফূল, আবু হিশাম সেই ফুলগুলোর নাম জানতো না, সে সময়ে একদিন একটি ফুল ফুটে-ফেটে আবু হিশামের পরিবারের মাথার উপরের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে কোমর থেকে আবু হিশামের দুটি পা ! আশ্রয়হীন আবু হিশামের পরিবারটিকে পাশ্ববর্তী শেখদের দেশ সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল । শেখদের গড়ে তোলা উপাসনালয়গুলোর দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাবৃতি করে করে আবু হিশামের পরিবারের পেটের ভেতরের জ্বলন্ত উনুনগুলো যখন নিভে নিভে আসছিল বিশ-আর একুশ শতকের সভ্যতার সন্ধিক্ষণের বিশাল জীবন্ত উদাহরণ হয়ে, শেখদের উপাসনালয়ের দেয়ালে দেয়ালে যখন প্রার্থনা সঙ্গিতরা মাথাকুটে মরছিল আর আবু হিশাম অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছিলো, তখনও যখন একুশ শতকের সভ্য আকাশে অবিরাম ফুটতে থাকা ফসফরাস ফুলগুলো শিশু যিশুদের পানীয় জলের লাইনগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হচ্ছিল, তৃষ্ণার্ত শিশু যিশুদের একেকটা বুক যখন ১৪০০ বছর আগের প্রাচীন কারবালা, আবু হিশামের বড় মেয়ে জুবেরীর বুকে তখনও ডুবানো ছিল কোন এক আরব শেখের সন্তান সুলতানের মুখ !
শিশু যিশুদের সমাধি রচনার জন্য অবশিষ্ট মাটিগুলোও যখন রক্ত রাঙ্গা হয়ে ভিজে ওঠছিল, তারপরও যখন একুশ শতকের সভ্য আকাশে নিষ্ঠুর রক্ত পিয়াসী ফসফরাস ফুলেদের ফুটে ফুটে ঝরে পড়া থামছিল না, সেই সময়ের এক ভোরের খবরের কাগজে এসেছিলো সেই খবর,- 'প্রিয় কুকুরটির প্রয়াণে অমুক দ্বিতীয় সম্রাট পরিবার শোকাচ্ছন' !
তিন
খবরে প্রকাশ, একুশ শতকের ফসফরাস ফুলেদের ফুটে পড়া একসময় থেমেছিল, বুক কেটে ফসফরাস ফুলের পাপড়ি সাদরে হৃদপিন্ডে ধারণ করার মতো একজনও শিশু যিশু যখন আর অবশিষ্ট ছিল না !
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ রাত ৮:৩৩