পুরো প্ল্যাটফর্মে মানুষ গিজগিজ করছে। এই প্রচণ্ড গরমে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান; ঘণ্টা বাজবে, ট্রেন আসবে, শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর।
প্ল্যাটফর্মের মাইকে ট্রেনের আগমনী বার্তা ঘোষিত হবার অল্পক্ষণ পর বেজে ওঠে হৃদয় তোলপাড় করা মিহি সুরের ঘণ্টা। ট্রেন আসে। শুরু হয় কুলিদের ছোটাছুটি, বিভিন্ন পণ্য কিংবা তেলেভাজা খাবার নিয়ে ফেরিঅলাদের হাকডাক। কেউবা হাতে মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয় নিয়ে ছুটে চলে এক বগি থেকে অন্য বগিতে।
.
ট্রেন থামতে না থামতেই ভেতরের যাত্রীদের নামতে না দিয়েই ওঠার জন্য বাইরের যাত্রীদের হুড়োহুড়ি আর তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়; সবাই চায়, সবার আগে আমি উঠি, পাছে ট্রেন আমাকে ফেলেই চলে যায়। কিন্তু সংকীর্ণ দরজা দিয়ে ক' জনই-বা আগে উঠতে পারে? মিতুর এসব দেখলে চলবে না, ওকে পানি বেচতে হবে।
সাত-আট বছর বয়সের মিতু পানির কলসি নিয়ে দ্রুত পায়ে ইঞ্জিনের বগির দিকে এগিয়ে যায়। অন্যদের মতো বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার কিনে বেচার টাকা নেই ওর। অভিজাত শ্রেণির লোকেরা তাই ওর পানি সচরাচর খায় না। গরিব শ্রেণির লোকেরাই ওর খোলা পানির ক্রেতা।
.
পানি বেচার জন্য সারা দিন রোদে ঘোরে ঘোরে গায়ের চামড়া পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। অনেক দিন হয় গায়ে সাবান দেওয়া হয় না। সাবানই-বা কোথায় পাবে? পরনের ময়লাটে জামাটার বেশ কয়েক জায়গায় জোড়াতালি। চোখ দু'টোতে আশ্চর্য এক মায়া। বিত্তবানের ঘরে ওর মতো মেয়ের জন্ম হলে এই বয়সে পরীর সাজে সজ্জিত থাকে। আদর করে সবাই হাজারো বিশেষণে ডাক পাড়ে। ওর কপালে এসব জোটে না, জুটবে বলে আশাও করা যায় না।
.
সারা দিন পানি বেচে যে কয় টাকা পায় সন্ধ্যায় মায়ের হাতে তুলে দেয়; একটি টাকাও রাখে না নিজের জন্য।এ বয়সেই ও বুঝতে পারে, টাকা রেখখে দিলে সসংসার চলবে না। এমনিতেই অসুস্থ বাবার অভাবের সংসারে নুন-তেল কিনতে টাকা কয়টা ফুরিয়ে যায়। সারা বছর টানাপোড়েন লেগেই থাকে। প্রায়ই ওদেরকে ভাত দিয়ে ভাত খেতে হয়। এ অবস্থায় ওর টাকা রাখা মানায় না।
.
মায়ের হাতে টাকা তুলে দেবার সময় মিতু মায়ের মুখের দিকে তাকায় ; সে দেখতে পায়, —আসলে কিছুই হয় না, এসব তার ছোট্ট মনের আবেগ বৈ কিছু নয়— কুপির লাল আলোয় আলোকিত মায়ের মুখখানা আরেকটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি দেখতে মিতুর খুব ভালো লাগে। ওর মনে হতে থাকে, এই দুনিয়ায় সেই একমাত্র সুখী। হৃদয়ে তার অনুভূত হয় অপূর্ব শান্তি। সহসা দূর হয়ে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি দেখার লোভও স্টেশনে পানি বেচতে আসার একটা কারণ ৷
তার মায়ের হয়তো সামর্থ্য নেই ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার। কিন্তু তাঁরও হৃদয়ে আছে মমতার ঝর্ণাধারা। তাঁরও প্রাণ কাঁদে সন্তানের জন্য। তিনিও স্বপ্ন দেখেন তাঁর বুকের মানিকের জন্য৷ হয়তো সে স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু তা এক মায়েরই স্বপ্ন ৷
.
কম্পার্টমেন্টে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ইঞ্জিনে বসে। টিটিএকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলে আর সমস্যা হয় না, নির্বিঘ্নে পৌঁছা যায় গন্তব্যে।
.
কাঠফাটা রোদ, মাথার ওপর খাড়া দুপুর, গলা শুকিয়ে কাঠ; একটু পানি দিয়ে গলা ভেজাতে পারলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। মিতুকে পানির কলসি হাতে এগিয়ে আসতে দেখে হাতের ইশার কাছে ডাকে এক লোক। ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা বলে,
—‘পানি কয় টেহা গেলাশ?’ মিতু আগ্রহী হয়ে ওঠে।
—‘দুই টেহা।’ মিতু বলে।
—‘আমারে এক গেলাশ পানি দে ৷’ লোকটা বলে৷
মিতু পানি ঢালে গ্লাসে, বাড়িয়ে দেয় লোকটার হাতে। লোকটা গ্লাসে চুমুক দিতেই হুইসেল বাজিয়ে যান্ত্রিক সরিসৃপটা নড়ে ওঠে। চট করে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারে মিতুর দিকে।
.
ট্রেন এগুতে থাকে একটু একটু করে ৷ মিতু ভাবে, লোকটা এখনই দুইটি টাকা ছুঁড়ে মারবে, আর সে দৌড়ে গিয়ে কুড়াবে ৷ কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই ঘটে না। তবু একবুক আশা নিয়ে সে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে দেখতে অনেক দূরে চলে যায় লোকটা।
—‘আমার টেহা দিয়া যান।’ চিৎকার দিয়ে বলে মিতু ৷
—‘কীয়ের টেহা?’ রাগতস্বরে বলে লোকটা। ‘টেহা কি গাছে ধরে?’ ততক্ষণে ট্রেনের গতি অনেক বেড়ে যায়।
এতটুকুন মেয়ের পক্ষে এই গতির সঙ্গে দৌড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবু, দু'টি টাকার আশায় সে ছুটতে থাকে। তখনও কলসিটা ওর হাতে। ওর দৌড় দেখে সঙ্গের লোকজন হয়তো লোকটাকে বলে দু'টি টাকা দিয়ে দিতে। কাউকে পাত্তা না দিয়ে চেহারায় ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বসে থাকে।
.
দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় মিতু। ওর দিকে তাকিয়ে থাকা সবাই আঁতকে ওঠে অজানা আশঙ্কায়; এই বুঝি ও ট্রেনের নিচে চলে যায়।
কলসি থেকে পড়ে যাওয়া পানির প্রবাহিত ধারায় মিলিত হয় ছোট্ট চোখের কিছু নোনা জল। দুটি টাকা হলেই থেমে যেত এইসব জলের ধারা।