somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন সভ্যতা প্রজনন করি, কি আমার দায়ভার ??

১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একঃ
আমার এক বন্ধু বিদেশি কোম্পানীতে চাকরি করে। মাস শেষে যে মোটা বেতন পায় তা দিয়ে মোটামোটি নয় বরং স্বচ্ছন্দেই কেটে যায়। কিন্তু তার মনে দুঃখের সীমা নেই। এই দুঃখটা তার দু-বছর বয়সী এক মাত্র মেয়ে সন্তানের জন্য। মেয়েটা কিচ্ছু মুখে দেয় না। যা-ই মুখে তুলে দেয়া হয়না কেন মেয়েটা থু থু করে ফেলে দেয়। ডাক্তার, কবিরাজ, বদ্যি ওঝা কিছুই বাদ রাখেনি সবার কাছেই মেয়েকে নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য। আমি যখনি তাকে ফোন করি সে বলে মেয়েকে নিয়ে অমুক ডাক্তারের কাছে আছে, অমুক পীরের কাছে ইত্যাদি। ডাক্তার, মেয়েটাকে দেখে প্রেসক্রিপশনের গায়ে Lost of Appetite লিখে নানান ধরনের ভিটামিন জাতীয় ঔষধ লিখে দেন কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়না। কবিরাজ, দুনিয়ার যত শক্তিশালী ঔষধি গাছের ছাল-বাকল দিয়ে তৈরী করা বড়ি ধরিয়ে দেন ওতেও মুক্তি মেলেনা। ওঝা, মেয়েটাকে দেখে আঁৎকে উঠে নিঃশ্বাস টানা তিন মিনিট বন্ধ রেখে বলে ক্ষুধা মন্দা জিনের আছর লেগেছে। তারপর গোটা দশেক তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে দেন। তাবিজ-কবচ গুলি এখন ঝুন ঝুনির কাজ দেয় কিন্তু আহার গেলাতে পারেনা। তাই বাধ্য হয়েই আমার বন্ধু দম্পতি নানান কসরত করে মেয়েকে এখন খাইয়ে দেন। বন্ধুটি এখন প্রতিদিন দুপুরের সময় অফিসে লাঞ্চ না করে বাসায় এসে ঘোড়া সেজে মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে সেও একটু কিছু মুখে তুলে আবারো অফিসে দৌড় দেয়। আমার সাথে দেখা হলেই বলে মেয়েটা কিচ্ছু খায়না। কিন্তু মেয়েকে দেখে সেটা বুঝার কোন উপায় নেই। সন্তানের জন্য বাবা মায়ের এই দরদ আমাদের সমাজে একটু বিরল নয়। প্রতিটা বাবা-মা-ই তাদের সন্তানদের জন্য এমন ভালোবাসা মমতা মনের মধ্যে পুষে রাখেন এবং এটাই স্বাভাবিক। আমার মনের মধ্যে সন্তানের জন্য এখনো কোন মায়া জন্মায়নি কারণ আমি এখনো বাবার সন্তান, যেদিন আমিও সন্তানের বাবা হবো হয়তো আমিও তার ব্যতিক্রম হবো না।

দুইঃ
পহেলা বৈশাখের সারা দিন কোন এক বিশেষ কারণে মন খারাপ ছিলো বলে সারাদিন বাসায় ছিলাম কোত্থাও বের হইনি, ফেসবুকেও তেমন একটা ছিলাম না। ইদানিং কেন জানি ফেসবুকেও থাকতে ইচ্ছে হয়না। মানুষ সারাদিন বাইরে কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে আর আমি সারাদিন ঘরে অলস সময় পার করে সন্ধ্যায় বের হই। প্রাত্যহিকতায় ছেদ পড়েনি বলে সেদিনও সন্ধ্যায় বের হয়ে নিয়ম মাফিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে আসি। বন্ধুদের সাথে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ ভালোই ছিলাম কিন্তু বাসায় এসে আবারো সেই এক ঘেঁয়ে পরিবেশ। সেই এক ঘেঁয়েমি থেকে মুক্ত হতে ফেসবুকে ঢুকি। হোম পেজ আসতে বেশ সময় নিচ্ছে কারণ ধীর গতির ইন্টারনেট আর সেদিন পহেলা বৈশাখের নানান উৎসব হবার কারণে অনেকেই সেই উৎসবের ফটো আপলোড করেছেন। আমি একটা একটা করে সেই ছবিগুলো দেখছি। হঠাৎ একটা ছবি আমার দৃষ্টিকে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করলো। বেশ ভালো ভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই ছবিতে দুটো বাচ্চা মেয়ে (৭/৮ বছরের হবে) একটা রিক্সায় বসা আর আশে পাশে অসংখ্য জনতা তাদেরকে ঘিরে রয়েছে। আমি সেই ছবির মর্ম উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ক্যাপশনে ছবির কোন বিবরণ ছিলোনা। ধারণা করে নিলাম বৈশাখী মেলায় অবিভাবকদের সাথে এসে হয়তো ওরা হারিয়ে গেছে। আশ-পাশের লোকজন ওদের হাতে মুখে ধরে ওদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। মনে মনে ভাবলাম আমাদের এই পৃথিবীটা অনেক ছোট্ট তারচে ছোট্ট আমাদের এই দেশ। মেলায় এসে ওরা হারিয়ে গেলে অবিভাবকরা হারিয়ে যাবেনা, যেহেতু এদেশের হৃদয়বান জনগণের হেফাজতে রয়েছে ওরা, নিশ্চয় আমাদের দেশের জনগণ তাদের অবিভাবকদের খোঁজে বের করে তাদেরকে পৌছে দিবেন। এই ভেবে ভেবে আমি ফেসবুক থেকে বের হয়ে আসি। গত রাতে আবারো ফেসবুকে ঢুকতেই সেই ছবিটা আবারো হোম পেজে ভেসে উঠলো। এবার ঐছবি গুলোর সাথে আরো বেশ ক'টি ছবি যুক্ত ছিলো। আমি সেগুলো দেখার জন্য ছবির উপর মাউজ বসালাম। ছবিটা বড় হয়ে আমার চোখে ভাসলো সেই সাথে ভাসলো ছবির বিবরণ। বিবরণ পড়েই আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। নিজেকেই অপরাধী মনে হলো। এ অপরাধ মানুষ হয়ে জন্মানোর, এ অপরাধ মনুষ্যত্ব লালন করার। প্রদর্শিত ছবির মেয়ে দুটি ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতে কোন একটা দোকান থেকে অর্ধেক পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে। আর আমাদের হৃদয়বান জনতারা ক্ষণিকের জন্য ভুলে যান এরা নেহায়েত বাচ্চা মানুষ। বাবা-মায়ের সামর্থ্য নেই তাদের ক্ষুধা মেটানোর, তাদেরও সামর্থ্য নেই গায়ের শক্তি খরচ করে সৎ পথে দু-পয়সা আয় করে নিজের আহার যোগানোর। তাই ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতে তারা বাধ্য হয়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করেছিলো। জনতার চোখে তারা চোর! চোরকে শাস্তি দিতেই হবে। তাই তারা দিলো।

এবার আসুন এই নোটের প্রথম অংশের সাথে দ্বিতীয় অংশকে একটু মেলানোর চেষ্টা করি। প্রথম অংশের বাবাদের সামর্থ্য আছে তাদের সন্তানদের মুখে আহার তুলে দেবার কিন্তু তাদের সন্তানেরা খাচ্ছেনা বলে তাদের দুঃখের অন্ত নেই। আর দ্বিতীয় অংশের বাবারা তাদের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন না বলেই সন্তানেরাই খাবারের সন্ধানে বের হয়ে জনতার রোষানলে পড়ে আধা মরা হচ্ছে। আমরা সবাই কথায় কথায় মানবতার কথা বলি। নির্লজ্জের মতো নিজেদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে দাবি করি। অথচ এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা কি বুকে হাত বলতে পারবেন যে তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী ? আমরা অনেকেই বাসা বাড়িতে কুকুর বিড়াল পালন করে থাকি। একটা বিড়াল বা কুকুরের জন্য আমরা যে মততা ধারণ করি সেই বখাটে মমতা থেকে কিছু অংশ যদি এই সব অন্নহীন মানব সন্তানদের কে দেয়া হতো তাহলে হয়তো আজ এই সব অমানবিক দৃশ্য আমাদেরকে দেখতে হতো না... কুকুর বিড়ালের মায়ায় আদ্র হয়ে চোখের জল ফেলার মতো লোকের অভাব নেই আমাদের সমাজে, শুধু অভাব মানুষের মায়ায় আদ্র হয়ে সত্যিকারের দু-ফোটা চোখের জলা ফেলা লোকের। আমাদের চোখের সামনে সমাজের তথা কথিত নামি-দামি মানুষেরা দিনে দুপুরে পুকুর চুরি করে নিয়ে যায়, আমরা কিছুই বলিনা বরং সম্মানের সাথে তাদেরকে সুযোগ করে দিই এমন কি বছর শেষে এনাদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়ে থাকি কিন্তু একটা বাচ্চা যদি পেটের দায়ে অর্ধেক পাউরুটি চুরি করে তবে তাকে আমরা ছাড় দিইনা। আমরা কথায় কথা মনবিকতার কথা বলে থাকি, সভ্যতার কথা বলে থাকি, গণতন্ত্রের কথা বলে থাকি অথচ আমরাই আজ গণতন্ত্রকে গণ ধর্ষণ করে চলেছি......

সুমন আহমদ
সিলেট।
১৬ই এপ্রিল, ২০১১ খৃষ্টাব্দ।
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×