somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নির্বাসিতের আপনজন।পর্ব-১৯(ক)।

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুনেছি যখন তার জন্ম হয়, সেদিন আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা। ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বজ্রের হুংকার আর বিদ্যুতের চমক। জন্মের পরমুহুর্তেই শিশুটি প্রথম যা দেখেছিল যা ছিল প্রকৃতির রুদ্র মূর্তি। হয়তো সে কারণেই বড় হবার পর শিশুটি অমন একটি রুদ্ররূপকে তার নিজের স্বভাবের অন্তর্গত করে নিয়েছিল।

শিশুটির বয়েস যখন পাঁচ বছর তখন তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। মাতৃহারা শিশুটি তাই অল্প বয়সেই এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মায়াময় জিনিসটি হারিয়ে ফেলে। স্নেহহীন, মমতাহীন, ভালবাসাহীন একটি ভুবনে বেড়ে ওঠার কারণেই শিশুটির চোয়ালে ক্রমে ক্রমে জন্ম নেয় কাঠিন্য? এই কারণেই কি সে অবলীলায় যাবতীয় কোমল জিনিসের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে?

শিশুটির বাবা ছিলেন একজন অতি দরিদ্র স্কুল শিক্ষক। মা-হারা শিশুটি সংসারে তাই প্রতিনিয়ত দেখেছে অভাবের আগুন, ক্ষুধার দাবানল। সেই থেকেই কি সে বড় হয়ে সর্বক্ষণ শুধু কাজে ব্যস্ত রেখেছে নিজেকে? এমনই ব্যস্ত যে নিজের পরিবার-পরিজনের সাথে তার দিনের মধ্যেও পনেরো মিনিটও দেখা হোতনা?

এতসব প্রশ্নের জবাব আমাদের কারোরই জানা নেই। কেননা এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতে পারার মতো বুকের পাটা নিয়ে জন্মানো মানুষ আমি দেখিনি।

আমি যে শিশুটির কথা বলছি, সে যখন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হোল, তখন তার দাপটে চারিদিকে ধুন্ধুমার অবস্থা। তার ধারেকাছে ভিড়বার মতো সাহস ছিলনা কারো। এই মানুষটি আমার বাবা। মিস্টার হিটলার নাম্বার টু।

বাবা ছিলেন আইনজীবি। আমি আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখছি যে বাবা হচ্ছেন একজন মহাব্যস্ত মানুষ। সূর্য্যোদয় থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাবা ব্যস্ত থাকতেন। তার সকাল বেলাটা কাটতো তার চেম্বারে তার ক্লায়েন্টদের সাথে। দশটার দিকে ভেতরবাড়ীতে ঢুকে দ্রুত কোট-টাই পরে কোর্টে চলে যেতেন। ফিরতেন সেই বিকেল পাঁচটায়। তাড়াতাড়ি কিছু একটা মুখে দিয়ে চলে যেতেন ল' কলেজে। সেখানকার তখন তিনি ভাইস-প্রিন্সিপাল, পরে প্রিন্সিপালও ছিলেন বহুদিন। এরই ফাঁকে চলছে অল্প-বিস্তর রাজনীতি, আর সমাজসেবা। রোটারী ক্লাব সহ গোটা পনেরো সংগঠনের সাথে খুব অ্যাকটিভ্‌লি জড়িত ছিলেন।

এই পর্যন্ত পড়ে আপনাদের অনেকেই নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে বলছেন,"ওয়েট আ মিনিট। ধান ভানতে শিবের গীত বলে মনে হচ্ছে। শিরোনামে লেখা রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, আর ভিতরে চলছে কোথাকার এক উকিল সাহেবের কেচ্ছা। ঘটনা কি?"

অভিযোগটি আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। এবং একই সাথে এখানে বলে রাখছি যে আজকের এই পর্বটির সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সংস্রব নেই। এই পর্বটিতে আমি একজন দোর্দন্ডপ্রতাপ পুরুষের কথা লিখছি। আমি আমার বাবার কথা লিখছি।

অতএব যারা এই পর্বটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজতে যাবেন, তাদেরকে আমি এখনই সতর্ক করে দিচ্ছি যেন তাঁরা আর না অগ্রসর হন। ও জিনিস সামনে নেই।

যাই হোক- ফিরে আসি যা বলছিলাম। বাবাকে আমার চিরটা কাল মনে হয়েছে তিনি যেন সূর্য্যের মতোন। যার আলো নিয়ে, উত্তাপ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু তার কাছে যাওয়াটা যেন ঠিক হবেনা। কাছে গেলে তার প্রবল উত্তাপে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে যাবো। তার থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখাটাই হচ্ছে নিরাপদ।
ছেলেবেলা থেকেই মনে হয়েছে বাবা যেন দূরের মানুষ, বাইরের লোক। তাতে অবশ্য আমাদের কোন সমস্যা ছিলনা। দিনের যে পনেরো মিনিট তিনি ভেতরবাড়ীতে থাকতেন, সেই পনেরো মিনিট আমরা সবাই মহা তটস্থ থাকতাম। তিনি বেরিয়ে গেলেই যেন বাঁচোয়া। আমরা (এমনকি মা সমেত) যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। আবার ফিরে আসতো নিশ্চিন্ত গল্পগুজবের পরিবেশ।

বাবার ধারেকাছে না যাওয়াটাই শ্রেয় ছিল। কিন্তু বছরের কয়েকটা দিন তার কাছে যেতেই হোত। যেমন স্কুলের প্রগ্রেস রিপোর্টে তার দস্তখত নেবার দিনটি। রেজালট ভালই হচ্ছিল, কিন্তু বাবারাতো সবসময়েই চান আরো ভাল রেজালট। তায় সই করবার আগে প্রতিবারই ভুরু কুঁচকে তিনি বলতেন," হুমম- অংকে পেয়েছ পচানব্বই। এখন তুমি পড়ো ক্লাস সিক্সে। এখন যদি পাও পচানব্বই, তাহলে ক্লাস এইটে পাবে পচাত্তর, আর ক্লাস টেনে পাবে পঞ্চান্ন। ম্যাট্রিকে তার মানে পাবে পয়তাল্লিশ, আর এই রেটে চলতে থাকলে ইন্টারমিডিয়েটে অংকে করবে ফেল। এখনো সময় আছে। পড়াশুনা করতে যদি ইচ্ছে না হয়, তাহলে এখনই আমাকে বলে দাও। খান দুয়েক রিকশা কিনে দেই। তুমি আর তোমার ভাইয়েরা রিকশা চালানো শেখা শুরু করো। শুনেছি আজকাল নাকি রিকশা চালিয়ে বেশ ভাল পয়সা রোজগার করা যায়।"

অংকের এই পর্যায়ক্রমিক অধঃপতনের দুরূহ ক্যালকুলেশন ক্লাস সিক্সের একটি ছেলের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। তাই বাধ্য হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।

ছেলেদের মাথায় লম্বা চুল রাখাতে বাবার ছিল চরম গাত্রদাহ। তখন স্কুলের ওপরদিকে পড়ি। লম্বা চুল রাখা ফ্যাশন তখন। বড় ইচ্ছে করে ছবিতে দ্যাখা রবীন্দ্রনাথা বা নজরুলের মতো ঘাড় বেয়ে নেমে যাবে চুল। আমি সেই চুল নিয়ে বাবড়ি দোলাবো, অ্যাফ্রো ফোলাবো, পনি টেইলের ঝুঁটি বাঁধবো। কত শত প্ল্যান। কিন্তু চুল আধা ইঞ্চি বাড়তে না বাড়তেই বাবার রাডারে ধরা পড়ে যাই ঠিকই একদিন।
কোর্টে যাবার আগে আমায় ডেকে নীরবে দুটো টাকা হাতে ধরিয়ে দেন। মুখে কিছু না বললেও নির্দেশনা পরিষ্কার। "বিকেলে আমি বাড়ী ফিরে যেন তোমার মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল দেখি। তা না হলে---।"
তা না হলে কি হবে, সেটা জানবার সাহস হয়নি কোনদিন। আমার মাথাতো একটাই, নাকি?

(এখানে বলে রাখা ভাল, যে ঢাকাতে পড়তে গিয়েই আমার প্রথম কাজটি ছিল লম্বা চুল রাখা।)

বাবা ছিলেন কাজের মানুষ। সংসারের চার দেয়ালে তিনি কোনদিন নিজেকে আটকে রাখেননি। তার কাছে কাজই ছিল ঈশ্বর। শহরের একজন সফল আইনজীবি হিসেবে তার পরিচয় ছিল। এর বাইরে তো অন্য পরিচয় তার ছিলই। ছোটবেলায় অতটা বুঝিনি, কিন্তু পরে কে জানিনে আমার মনে হোত যে বাবা আসলে কাজের মধ্যেই হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তার কোমল দিকটিকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। হয়তবো তিনি টের পেয়েছিলেন যে একবার যদি তার কোমল দিকটির সন্ধান আমরা পেয়ে যাই, তাহলেই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে সব নিয়মকানুনের ইমারত। অতএব তিনি মুখে চড়ালেন মিস্টার হিটলারের কঠিন মুখোশ।

আমার আমার ভাইবোনদের কাউকে বাবার কোলে চড়তে দেখিনি। আমার ছোট বোনটি যেদিন প্রথম শাড়ী পরলো, আমার মনে পড়েনা যে বাবা তার দিকে মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে বলেছিলেন,"আমার মামণি কবে এতো বড় হয়ে গেল? কি সুন্দর লাগছে তোমাকে দেখতে।"
কখনো দেখিনি বাবা আমাদের মাথার চুল নেড়ে দিচ্ছেন সোহাগ করে, গালে হাত বুলিয়ে আদর করছেন। (এইখানে বলে রাখা ভাল যে আমার গালে বারদুয়েক বাবার হাত স্পর্শ করেছিল। অনুভূতিটি মোটেও সুখকর ছিলনা। চড়ের দাপটে মাথার ঘিলু অবধি নড়ে গিয়েছিল।)

বাবা আমাদেরকে কখনোই আর্থিক প্রাচুর্য্যের স্বাদ পেতে দেননি। যদিও তার সে সামর্থ্য ছিল। কিন্তু দেননি। স্কুল আর কলেজ জীবনের গোটা সময়টাই দুটো প্যান্ট আর দুটো শার্ট দিয়েই চালিয়েছি আমরা সবাই। নানান রকম ঝুলোঝুলি করে একটা টেনিস বল কিনতে পারলেই মনে হোত হাতে পৃথিবীটাকে পেয়ে গেছি। সেই টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম, ফুটবল খেলতাম, হকি খেলতাম, এমনকি দু একবার ভলিবল খেলারও চেষ্টা করেছি। বাবার কল্যাণে টেনিস বলের নানান ব্যবহারে জেনেছি।

এটাও সত্যি যে আজকালকার মতো এত বেশ জিনিসপত্র পাওয়া যেতনা তখন। তার পরেও যা দু একটা জিনিস পাওয়া যেতো সেগুলোও কিনে দিতেও বাবার মহা আপত্তি। রাগে তখন মাথা ঝিম ঝিম করতো। কিন্তু কি আর করবো? উনি যে মিস্টার হিটলার নাম্বার টু। কথা বলতে গেলেই ফায়ারিং স্কোয়াড এর হুকুম জারী হয়ে যাবে।

তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে বসে আছি। কাজকাম নেই। মাঝেমাঝে স্কুল-কলেজের বন্ধুরা আসে, ওদের সাথে রাজা-উজির মারি।

এমনি এক সময়ে বাবা ডেকে বললেন,"দুদিনের জন্যে চিটাগং যাবি নাকি?"
আমি সে প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেইনা। কে জানে আমাকে কি ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোন এক জায়গায় নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে নাকি? সন্দিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞেস করি,"চিটাগং যাবো? কেন?"
"আমার একটা কাজ আছে চিটাগং কোর্টে। দিন দুয়েক লাগবে। তোর তো এখন কোন ক্লাশ-ট্লাশ নেই। ইচ্ছে করলে যেতে পারিস। ফেরার সময়ে ঢাকা হয়ে ফিরবো।"
শুধু চিটাগং নয়, এর সাথে ঢাকাও রয়েছে! বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মত আধো আধো গলায় বলতে ইচ্ছে করছে তখন, "এত সুখ আমার ভাগ্যে সইবে তো?"
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবা তাড়া দিলেন,"কিরে চুপ করে আছিস কেন? যাবি কিনা তাই বল তাড়াতাড়ি। আমাকে প্লেনের টিকিট বুক করতে হবে।"
ও মাই গড! প্লেনে করে যাবো! আমি কার মুখ দেখে উঠেছিলাম সকালে?
আর চুপ করে থাকাটা সমীচীন হবে না। মাথা নাড়লাম। আমি যাবো, আমি যাবো।

খবরটা যখন বাড়ীর আর সবার কানে গেল, তখন তো সবাই ভয়ানক ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লো আমার সৌভাগ্যে। একেবারে প্লেনে করে চিটাগং যাওয়া! চাট্টিখানি ব্যাপার না।
আমার এক পুরনো স্কুলের বন্ধু তখন ঘটনাক্রমে চিটাগং থাকে, তাকে তাড়াতাড়ি টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলাম যে আমি আসছি। আমি জানি যে আপনারা অনেকেই "টেলিগ্রাম" করার কথা শুনে হাসছেন। যেহেতু তার ফোন নাম্বার জানতাম না, দ্রুত খবর পাঠানোর এটাই তখন ছিল সর্বোত্তম উপায়।

প্লেনের জার্নিটা ছিল অসাধারণ। পাশে বাবা বসা ছিলেন বলে বিমানবালাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে পারিনি, জানালার পাশে সিট থাকায় সারাক্ষণই বাইরে তাকিয়েছিলাম। আর বারবার বাবাকে দেখছিলাম। তাকে আমার অন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। স্বাভাবিক, একজন আর দশটা বাবার মতো। একবার তিনি আমার সিটবেল্টটা ঠিক করে বেঁধে দিলেন। বিমানবালার দেওয়া তার ভাগের চকোলেটটা নিজে না খেয়ে আমাকে দিয়ে দিলেন।

চিটাগং পরের দুদিন কাটলো স্বপ্নের মধ্যে। আমি আর আমার বন্ধুটি গোটা শহর তোলপাড় করে ঘুরলাম। বাটালী হিলে উঠে সূর্যাস্ত দেখা, বিপণিবিতানের এস্কেলেটরে ওঠানামা করা, লাভ লেনের বিখ্যাত পান খাওয়া, সবই হোল প্রথম দিনে। পরের দিনে বাসে করে চলে গেলাম কাপ্তাই। পকেটে না চাইতেই বাবার দেওয়া টাকা কচকচ করছে। তা দিয়ে এ জিনিস কিনি, সে জিনিস খাই।

সাথের বন্ধুটি আমার বাপজানকে ভালভাবেই চেনে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,"ব্যাপার খানা কি বলতো? চাচা হঠাৎ এত দিলদরিয়া কেন?"
আমি ঠোঁট ওলটাই। "নো আইডিয়া।"
"সাংঘাতিক ব্যাপার। হিটলার থেকে একেবারে দাতা হাতেম তাই। তোকে নিয়ে এলো চিটাগং, তারপর পকেটে টাকা পুরে দিয়ে আমার সাথে ঘোরাঘুরি করতে পাঠিয়ে দিল। রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।"
আমরা তখন গাছের ছায়ায় বসে আইসক্রীম খাচ্ছিলাম। মুখভর্তি, তাই কথা বলিনা বেশী। উত্তেজিত বন্ধুটি অবশ্য থামেনা। সে কথা বলেই চলে। "আমার কি মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় চিটাগং এর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে চাচার মনটা নরম হয়েছে।"
"কে জানে? হতেও পারে। মানুষের মন বলে কথা।"
"তাই যদি হয় তাহলে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।"
এর পাল্লায় পড়ে তো দেখছি শান্তিমতো আইসক্রীমও খাওয়া যাবে না। "বল কি বুদ্ধি?"
"তুই চিটাগং এ থেকে যা আরো কদিন। এই ধর আরো পাঁচ-ছয় দিন।"
"বুঝিয়ে বল।"
"আমার খুলনা যাবার একটা প্ল্যান আছে শিগগীর। চাচাকে বলে তোকে রেখে দেই এখানে কয়েকদিন। তারপর আমি আর তুই একসাথে খুলনা যাবো। ওই কয়দিন তুই আমাদের বাসাতেই থাকবি। তুই আর আমি মিলে ওই কয়দিন শুধু ঘুরে বেড়াবো। কত জায়গায় যাওয়া হয়নি। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, টেকনাফ। এসব জায়গায় গেলে তুই একদম পাগল হয়ে যাবি, এমন সুন্দর। আর কক্সবাজারে বার্মিজ মেয়েদের কথাতো বললামই না। তোর চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।"

তার কথা শুনে আমারও বুকের ভিতরটা নড়চড়ে ওঠে। বুদ্ধিটা খারাপ না। কিন্তু পরমুহুর্তে বাবার মুখটি মনে আসতেই আবার চুপসে যাই। এই প্ল্যানে জনাব হিটলার রাজী হবেন সেটা মনে হয়না।

"বাবা এতে রাজী হবেন না। বাদ দে এইসব প্ল্যান। পরে কোন একদিন হবে।"
বন্ধুটি নাছোড়বান্দা। সে বলে,"আরে রাজী উনি হবেনই। তোদের হোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালে দূরের পাহাড় গুলো খুব সুন্দর দেখা যায়। আজকে ঠিক সূর্য্য ডোবার সময় ওইখানে বসে আমরা চা খাবো চাচার সাথে। দু এক কথা বলে আমি চাচার মন ঠিকই নরম করে ফেলবো। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ। এক কোপে আমি একদম গলা নামিয়ে দেবো।"

তার উপমাটা ঠিক পছন্দ হয়না আমার। হিটলার হোক আর কঠিন-হূদয়ের লোকই হোক, আফটার অল বাবাতো।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বন্ধুটি আবার বলে,"কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোর? কেন মনে নেই স্কুলে পড়ার সময়ে কিভাবে আমি হেড স্যারের কাছ থেকে ছুটি আদায় করতাম?"
সেটা অবশ্য সত্যি কথা। আমাদের স্কুলের হেড স্যার ছিলেন মাহতাব সাহেব। ভয়ানক কঠিন লোক। তাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে আমরা বেশ কয়েকবার ছুটি আদায় করেছিলাম। এবং প্রত্যেকবারই আমার এই বন্ধুটি ছিল স্যারের সাথে কথা বলার জন্য আমাদের প্রতিনিধি। প্রথমে বিনীত অনুরোধ, পরে যুক্তিসহ তর্ক, তাতে কাজ না হলে কাঁদোকাঁদো গলায় অনুনয়, ইত্যাদি নানান ধরণের স্ট্র্যাটেজীতে সে ছিল অতিশয় দক্ষ। এবং প্রতিবারই সে সাফল্যের সাথে ছুটি বাগিয়ে নিয়ে এসেছিল।

এবার আমার মনেও কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়। সত্যিই কি তবে বাবাকে সে রাজী করাতে পারবে?

বন্ধুটি বলে,"কেন নয়। উনি আমাকে চেনেন, আমার গোটা ফ্যামিলিকে চেনেন। তোর সাথে আমি একসাথে স্কুলে পড়েছি বহুকাল। আর তুই চিটাগং এ আমাদের বাসায় থাকবি, আর তারপর আমরা দুজন একসাথে খুলনা যাবো। এমন তো না যে আমি তোকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে ভেগে যাবো, আর তুই পথ হারিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবি।"
একদম হক কথা। যুক্তিতে কোন ভুল নেই। আমি নিজেই রাজী হয়ে যাই।
বন্ধুটি তাড়া লাগায়, "তাহলে তাড়াতাড়ি চল। সন্ধ্যের আগেই হোটেলে পৌঁছুতে হবে।"
আমি আপত্তি জানাই। "কিন্তু কাপ্তাইটা যে ভাল করে দেখা হোলনা।"
"আরে সব পরে হবে। আগে চাচাকে রাজী তো করাই, তারপর কাপ্তাই হবে, পতেঙ্গা হবে, ফয়েজ লেক হবে।"

শেষ বিকেলে আমরা হোটেলে পৌঁছে যাই। বাবাও ততক্ষণে ফিরেছেন। আমাদের দেখে তার মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল। "কি তোমরা এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে? ঘোরাঘুরি শেষ?"
বন্ধুটি মাখন মাখন গলায় বলে,"আজকে আমরা তিনজনে বারান্দায় বসে চা খাবো চাচা। ওখান থেকে পাহাড়গুলোকে সূর্য্য ডোবার সময়ে যা সুন্দর দেখা যাবে।"
বাবার মুখে হাসিটি লেগেই থাকে। "তাই নাকি? চলো তাহলে।"

হোটেলের বারান্দা থেকে যা দেখা গেল তা আসলেই সুন্দর। বাবাও বেশ হাসিমুখে তার একটি ভ্রমনের গল্প করলেন। সূর্য্য যখন পশ্চিমা আকাশে ডুবুডুবু করছে তখন আমার বন্ধুটি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে হাত কচলে বললো," চাচা, একটা কথা ছিল।"
বাবা হাসিমুখে তার দিকে তাকালেন। "বলো, কি বলবে?"
বন্ধুটি খুবই নরম গলায় তার অনুরোধটি পেশ করলো। বাবা চুপ করে তার পুরো কথাগুলো শুনলেন। তারপর আগের মতোই হাসিমুখে বললেন,"না- এটা সম্ভব না। ওকে আমি এখানে একা রেখে যাবো না।"

বাবা উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। আমরা দুজন প্রায়ান্ধকার বারান্দায় চুপ করে বসে থাকলাম। দুজনেই পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে এটি সুপ্রীম কোর্টের রায়। ফাইনাল ডিসিশন। কোনভাবেই এর নড়চড় হবেনা। বন্ধুটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"এই প্রথম আমি ফেল মারলাম।"

মিনিট দশেক পর বাবা বারান্দায় ফিরে এলেন। "আমাদের প্ল্যানে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আমি জানতাম না যে চিটাগং থেকে রাতের বেলায় ঢাকা যাবার একটি ট্রেন ছাড়ে। আমরা তাই আজ রাতেই চলে যাবো। আমি স্টেশনে ফোন করে টিকিট বুক করে রেখেছে। রাত দশটার সময় ট্রেন ছাড়বে। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নাও।"

(বাকী অংশ পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ৩:২০
১৪টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×