১।
বৃষ্টির এই অলৌকিক পতন জুড়ে আছে সমস্ত দুপুর। বর্ষার নিজস্ব সন্ধ্যা নেমেছে শহরে। এই উত্তাল বর্ষায়ও জীবনানন্দ কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাকে পাওয়া যাবে সেই কার্তিকে, যখন বর্ষা পেড়িয়ে কুয়াশা দখল নিতে থাকবে চারপাশ আর দূরন্ত নদী শান্ত হবে, আকাশের চাঁদ ছড়াবে শীতল জ্যোৎস্না। কিন্তু এই অন্ধকার করা দুপুর-সন্ধ্যা জুড়ে থাকা বর্ষায় রাবীন্দ্রিক রোমান্টিসিজম নয় আমি চাই বর্ষার নিজস্ব নিসর্গ লেখা হোক জীবনানন্দে।
২।
একটা সিগ্ধ চাঁদ নারিকেল গাছের পাতা বেয়ে উঠছে পূর্ব আকাশে। বরফের মত চাঁদ!
এক কোমল ছায়া-অন্ধকারজ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে ইলেকট্রিসিটিহীন শহরে।
ছাদে যে গান গাচ্ছে তার কন্ঠস্বর কোন অতীত গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে উঠে আসছে যেন, মৃদু অথচ গভীর.....!
৩(ক)।
মধ্য আকাশের ঘোলাটে চাঁদের উপর দিয়ে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল চার টা কাক। সমাপ্তি ঘটলো ভীষণ একটা রাতের। উৎসচিহ্নহীন আবছা একটা আলোয় স্পষ্ট হচ্ছে চারপাশ। এগিয়ে আসছে একটা সকাল। ক্লান্ত একটা সকাল..., যে সকালের জন্য জেগে থাকা শতাব্দী দীর্ঘ এই রাত…
(খ)।
এই যে কয়েক ঘন্টা আগেই আকাশ টাকে কি আপন মনে হয়েছিল
এখন তার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না,
যে চাঁদ টা অন্ধকার ঠেঁলে ছায়া একেঁছিল আমাদের শরীরের
এখন সেখানে একটা গনগনে দানব নক্ষত্র..!
৪।
কিছুটা সময় আয়নায় মনোযোগ দেয়া উচিত নয়তো একদিন হঠাৎ বিস্ময়ে চমকে উঠবো নিজেকে দেখেই। নিজেকে নিজের আততায়ী বলে সনাক্ত করবো। ফটো এ্যালবামে নিজেকে খুঁজে পাবো না কোথাও। আমিতো ভুলেই গেছি নিজের চেহারা!! আর চেহারা শব্দটি ই অতীত-কাল যার কোন বর্তমান নেই।
৫।
সবার ই একটা নদী থাকে, একান্ত ব্যক্তিগত একটা নদী। সে ভাবে তার সবচেয়ে কাছের নদীটিই বুঝি সেটা। বাড়ির পাশের, শহরের পাশের অথবা গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী টি কে ধরে ভেতরে আর একটা নদী গড়ে ওঠে। চেনা অথচ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা নদী। খুব বেশি দূর তাকে দেখা যায় না, উৎপত্তি বা মোহনা কোন টা ই না।
ব্যক্তিগত নদীগুলো দৃষ্টির বাইরে গেলেই ফুরায়। আমারো একটা নদী আছে, সে প্রমত্ত পদ্মার মত নয়, বদ্ধ জলের কপোতাক্ষ ও নয়; ক্ষীণস্রোতা একটা নদী। যার দু তীরে পাখিদের গ্রাম, অনার্য বৃক্ষের সমাজ। আমি যাকে ভুল নাম নবগঙ্গা বলে চিনি।
৬।
এক একটা বাড়ি যত পুরনো হতে থাকে সেটা তত অদ্ভূত ভাবে জীবন্ত ও হতে থাকে। রাস্তার ধারের দুটো জানালাও মাঝে মাঝে এমন মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে, চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ ফেরানো কঠিন। কোন চাকচিক্য নেই, নেই রঙচঙা জৌলুস, পুরনো বাড়ির যত যাদু তার ছায়াময় অন্ধকারে।
৭।
ঝড়! এই একযুগ আগেও ঝড় উঠলে ছাদে উড়ে আসতো কদম কড়ই জাম এর পাতা, শিমুল তুলো, আকন্দের বীজ.. মাঝেমাঝে অচেনা ফুল! তারও আগে প্রায় ই আসতো আহত আর পথভোলা পাখি.. আর এলেই চাল ছোলা রুটি, কৌটা করে পানি, বিস্কুটের বাক্স/ঝুঁড়িতে নরম কাপড় বিছিয়ে সিঁড়িঘরে রেখে দিতাম। কিন্তু এইসব পাখিরা খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্থ হয়, এরা খাদ্য পানি কিছু ছুঁতোই না। এদিকে আমার সারারাত ঘুম হতো না পাখির চিন্তায়। সকালে দেখা যেতো পাখি উড়ে গেছে! তারপরও আমি অপেক্ষায় থাকতাম, কোন একদিন কোন এক পাখি থেকে যাবে এ বাড়ির চিলেকোঠা কে ভালোবেসে!
৮।
প্রতিরাতে জীবনানন্দের কিছু লাইন আউড়ে যেতে ইচ্ছে করে। এমন কিছু লাইন যাতে অচেনা এক শুন্যতা জমে আছে। তীব্র গাঢ় একটা শুন্যতা। এককালে সমস্ত জীবনানন্দ পড়েও আমি ভুলে গেছি জীবনানন্দ শুধু বিষণ্ণতা জাগায় কি না!
৯।
আহত মৃত নক্ষত্রের মত শেষ আলোটুকু আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই- শব্দ, চিহ্ন, সৃষ্টিহীন..
নিজেকে আলোকরে অদৃশ্য, অন্ধকারে-
সমূহ গ্রহ উপগ্রহ গ্রহাণুর সুসজ্জিত বাগান গুটিয়ে আত্মমগ্ন কৃষ্ণবিবর।
১০(ক)।
খুব মোটা তুলি দিয়ে একটা ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে, আলো-চকচকে নয় বরং ছায়া ছায়া অন্ধকার। নিখূঁত নয়, তবে খুঁজলে নিখূঁতভাবে ধরা দেবে পুরোটা। আর আঁকার পর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে ছবির ভেতর।
(খ)
সেখানে কোন দিন নেই, -বার মাস রাত, কোন তীব্র পূর্ণিমা নেই, এক ঘোলাটে সিগ্ধ চাঁদ জেগে জলে ও অন্তরিক্ষে। সেখানে জ্যোৎস্না থেকেও বেশি নক্ষত্র প্রভা। বাতাস ও সেখানে রাতের মতই মৃদু ও কোমল.....মানচিত্র জুড়ে এক জীবনানন্দের মালয় সাগর!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৮:০৪