somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশু শিক্ষা

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেখক হলেই যে আদর্শ মানুষ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। উদাহারণ সরূপ বর্তমানে বাচ্চা কাচ্চাদের আমি ভুল ভাল শিক্ষা দিয়ে চলেছি। সব সময় ভাল, সঠিক এবং উত্তম জিনিস শেখাতে হবে সবাইকে- এ ধরণের লিখিত কোনো কাগজে দস্তখতও দেইনি। আজ সকালে এমডি আসছে দেখে বেশ আগে ভাগে বের হতে হয়েছিল। বেশি সকাল সকাল বেরিয়েছি দেখে ক্ষিধেটাও পেয়ে গিয়েছিল চরম মাত্রায়। ইপিজেডের কাছাকাছি গিয়ে আর থাকতে পারিনি। ভাল একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে গেছি খাওয়ার জন্য। অফিসে গিয়ে নাস্তা করার মত ধৈর্য্য ছিল না। তাছাড়া বর্তমানে পকেটে টাকা টুকা থাকছে দেখে রেস্টুরেন্টের চেহারা দেখে আর আগের মত ভয় পাই না। খাওয়ার জন্যই তো বেঁচে আছি। একটু ভাল মন্দ না খেলে এই টাকা পয়সা দিয়ে কি হবে?
আমি যে সময়টায় অফিসের জন্য আজ বেরিয়েছিলাম সে সময়ে নেভি কলোনির পাবলিক স্কুলটার ছাত্র ছাত্রীতে ইপিজেড ফ্রী পোর্ট এলাকা থৈ থৈ করতে থাকে। পথে ঘাটে, রিক্সায়, বাসে, সিএনজি, টেম্পু- সবখানে স্কুল ড্রেস পরা ছাত্র ছাত্রী। খাবার জন্য যে রেস্টুরেন্টটায় ঢুকেছিলাম- প্রথমে খেয়াল করিনি, খাবার অর্ডার করার পর দেখলাম আমার পাশের সিটেই কোনোমতে ঠেসে ঠুসে স্কুল ব্যাগ কোলে নিয়ে বসেছে গোলগাল এক ছেলে। বেশি বড় হবে না। টু থ্রিতে পড়ে বোধহয়। সঙ্গে অন্যপাশে রয়েছে তেরো চৌদ্দ বছরের রোগা পটকা, কালো আরেকজন। পোশাক আশাকেই বোঝা যাচ্ছে - সম্ভবত বাসার কাজের ছেলে টেলে হবে। স্কুলে এগিয়ে দিতে এসেছে সাহেবের ছেলেকে। তবে স্কুল ব্যাগটা রীতি অনুযায়ি কালো ছেলেটার কাছে থাকা উচিত। মোটা ছেলেটার কোলে কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। দেখলাম কালো ছেলেটা কিছু খাচ্ছে না। তবে মোটাসোটা স্কুল ছাত্রটা একটা বড় কাঁচের বাটিতে ঠাণ্ডা বরফ কুচি দেয়া ফালুদা খাচ্ছে আয়েশ করে। রোগা পটকা ছেলেটা লেলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তার খাওয়া।
যাহোক, মূল কথায় ফিরে আসি। আমি অর্ডার দিয়েছিলাম নেহারি আর নান রুটি। বেশ ভাল নেহারি পাওয়া যায় এই রেস্টুরেন্টটাতে। আগে একবার খেয়েছিলাম। সব সময় আসাও হয় না, পাওয়াও যায় না। নেহারির কারিগর খুব সম্ভব দুদিন পর পর উধাও হয়ে যায়। আজ ভাগ্য ভাল- পাওয়া গেল। এবং ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের দোকান। অর্ডার দিতে না দিতে বিরাট প্লেটে গরম ধোঁয়া ওঠা নেহারি আর বড় বড় সদ্য নামানো গরম নান রুটি এনে হাজির করে দিল ওয়েটার ছেলেটা। নেহারির গন্ধে রেস্টুরেন্টের বাতাস মঁ মঁ করছে। বড় একটা নলা হাড়, সাথে বেশ খানিকটা মাংস আর ঘন একটা ঝোল, ঝোলটা ঠিক টকটকা লালও না, একটু কমলা কমলা রঙের। সেই সাথে মিষ্টি এলাচ আর দারুচিনির ঘ্রাণটা আলাদা ভাবে পাচ্ছি। নেহারির প্রতিটা এলিমেন্টের আলাদা আলাদা অস্তিত্ব সহকারে রাঁধার এই দূর্লভ রেসিপি আগে কোথাও পাইনি। রুটি খানিকটা ছিঁড়ে নেহারির ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দেয়া মাত্রই মনে হল হাইপার ডাইভ দিয়ে স্পেশ আর টাইম অতিক্রম করে ফেরদৌস বেহেশতে চলে এসেছি। নেহারি খাবার কিছু তয়-তরিকা রয়েছে। খাওয়ার সময় খানিকটা গিলে গিলে আর চোখ বুজে বুজে খেতে হয়। ঝোল নিতে হয় বেশি, রুটির অংশ থাকবে কম। সেই ঝোলে খানিকটা করে মাংসের ছেঁড়া টুকরো থাকবে, হালকা পাতলা চর্বি থাকবে। এবং খাওয়ার সময় একেবারে ফরযে কেফায়া যেই অংশ- আপনাকে অবশ্যই আঙুলে ঝোল লাগিয়ে খেতে হবে, এবং অল্প বিস্তর ঝোল অসাবধানে প্যান্টের ওপরেও ফেলবেন। যখন বুঝবেন প্যান্টে ঝোল পড়া শর্ত্বেও আপনি নেহারিটা উপভোগ করছেন- ধরে নেবেন আপনি নেহারি খাওয়াটা স্বর্গীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
আমিও মোটামুটি সেভাবেই নেহারি খাওয়া ধরেছিলাম। ঢুলু ঢুলু চোখে নেহারি খেয়ে যাচ্ছি। আরামে রীতিমত মনে হতে শুরু করেছে যে নেহারি খাওয়া মাত্রই দোকানি নিজে উঠে এসে একটা বাটিতে গরম পানি নিয়ে আমার হাত ধুয়ে দেবে, তারপর বিছানা বালিশ পেতে দেবে ফ্লোরের ওপর। মাথার কাছে একটা টেবিল ফ্যান এনে ছেড়ে দিয়ে গদগদ মুখে বলবে, “সার, একটু ঘুমায়া লন। নিজের ঘর মনে করবেন।...... ঐ কে আছিস, সাররে খুব ঠাণ্ডা দেইখা মিষ্টি ডাব কাইটা আইনা দে। নেহারি খাওয়ার পর মিষ্টি ডাবের পানি খাইয়া ঘুম দেইলে শইলে সেই লেভেলের শক্তি আইবো! কুইক! সার ঘুমায়া যাইতেছে!”
বোধহয় ঘুমের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম খেতে খেতে। অর্ধ নিদ্রা, পূর্ণ তন্দ্রালু অবস্থা। জগৎ ঈষৎ তরল দশায় পৌছে যাচ্ছে। গরুর নলাটা ঘুমের ঘোরেই যেন হাতে নিয়ে একপাশে মুখ লাগিয়ে হুকা ফোঁকার মত টান দিয়েছি ভেতরের মজ্জার জন্য। এর মাঝেই হঠাৎ ভাসা ভাসা ভাবে শুনতে পেলাম রিনরিনে মেয়েলি গলায় পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “আঙ্কেল, এইসব নেহারি খাওয়া মোটেও ঠিক না। আমার আব্বা ডাক্তার। এইসব হাই কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার। খাইলেই হার্ট এটাক হয়ে মারা যাবেন!”
আমার হাড্ডি সাধনা তথা নেহারি ভক্ষণে ছেদ পরলো। নলার ভেতরের মজ্জাটা না খেয়েই অবাক মুখে পাশ ফিরে তাকালাম। দেখি সেই টু থ্রী পড়ুয়া নাদুস নুদুস ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে গম্ভীর, ভাবুক ভাবুক মুখ করে। আমি তাকানো মাত্রই আবার দম নিতে দিতে বলতে লাগলো, “নেহারির মধ্যে হিউজ পরিমাণ তেল থাকে আঙ্কেল। খাবেন না একদম। আমাকে ছোট ভাববেন না। আমি থ্রিতে পড়ি। আমার আব্বা ডাক্তার। প্রত্যেকদিন আমি মানুষের উপকার করার চেষ্টা করি। এইজন্য আপনাকে বললাম। আপনি খাওয়া বন্ধ করলে তখন উপকার হবে।”
আমি থতমত খেয়ে তাকালাম ছেলেটার দিকে, আমতা আমতা মুখে বললাম, “উপকার? মানে?”
ছেলেটা সাথে সাথে আরো গম্ভীর হয়ে গেল। রাশভারী গলায় বললো, “কাজী নজরুল ইসলামকে চিনেন আপনি?”
বোকা বোকা স্বরে বললাম, “হু, কেনো?”
“উনার একটা কবিতা আছে না? খোকার সাধ?” জ্ঞানী জ্ঞানী মুখে বলল।
আমি মনে করতে পারলাম না। খোকার সাধ নামে কোনো কবিতা লিখেছিল নাকি নজরুল? কিছু বলার আগেই অবশ্য উত্তর পেয়ে গেলাম। ছেলেটা নিজে থেকেই গড়গড় করে আবৃতির সুরে বলে উঠল-
“আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
'হয়নি সকাল, ঘুমো এখন'- মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, 'আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না কো!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!'
ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠব পাহাড়-চূড়ে,
দেখব নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে,
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলব আমি 'ভোর হল যে, সাগর ছুটে আয়!
ঝর্ণা মাসি বলবে হাসি', 'খোকন এলি নাকি?'
বলব আমি নই কো খোকন, ঘুম-জাগানো পাখি!'
ফুলের বনে ফুল ফোটাব, অন্ধকারে আলো,
সূয্যিমামা বলবে উঠে, 'খোকন, ছিলে ভাল?'
বলব 'মামা, কথা কওয়ার নাই ক সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙ ঘুমের দ্বার।'
রবির আগে চলব আমি ঘুম-ভাঙা গান গেয়ে,
জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে!”
আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কবিতাটা হালকা পাতলা মনে ছিল। কিন্তু নামটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। বহু বছর পর কবিতাটা শোনা হল। ছেলেটা বিশাল কবিতাখানা আবৃতি করে হা করে দম নিতে লাগলো। হাঁপিয়ে গেছে বেচারা। সে থামতেই আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কবিতাটা তো শুনেছি, কিন্তু উপকারের কথা যে বললে, সেটা বুঝলাম না।”
জোরে জোরে দম নিতে নিতে বলল, “বুঝেন নাই এখনো? এই কবিতা পড়ে আমি ঠিক করেছি এখন থেকে প্রতিদিন আমি মানুষের উপকার করবো। এই যে দেখান না, শাহজাহানের আজকে ব্যাগ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাগ আমিই নিয়েছি? মানুষের উপকার করলাম। মানুষের উপকার করলে মনে প্রশান্তি আসে।” দেখলাম প্রশান্তি শব্দটা বেশ ভেবে চিনতে উচ্চারণ করলো ছেলেটা। নতুন শিখেছে বোধহয়। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে ছিলাম- সে সময়ে বই পড়ে নতুন একটা শব্দ শিখেছিলাম। ‘লুণ্ঠন’। প্রথম প্রথম সে শব্দটার অর্থ বুঝতাম না। ভাবতাম লণ্ঠন, মানে হারিকেনের প্রতিশব্দ হয়তো। পরে জেনেছিলাম ওটা মানে হচ্ছে ছিনতাই করা, লুঠ করা। এবং শব্দটার অর্থ শেখার পর থেকেই যেখানেই পারতাম সেই শব্দটা প্রয়োগ করে সম বয়সী আর বড়দের তাক লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। একবার তো ক্লাসের পিয়াস নামের এক ছেলের সাথে আমার সেই রকমের মারা মারা বেঁধেছিল। শার্টের পকেট ছিঁড়ে পতাকা হয়ে গেছে দুজনের। ক্লাস টিচার ফরিদ স্যার জালি বেত হাতে ডেকেছেন আমাদের দুজনকেই টিচার্স কমন রুমে। কার কি দোষ- তা নিয়ে আগে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
“ফরহাদ? তুই পিয়াসকে এইভাবে মেরেছিস কেন? সত্য কথা বলবি। তাহলে মার কম খাবি। মিথ্যা বললেই বেতিয়ে পাছার চামড়া তুলে নেবো। চেয়ারে বসতে গেলেও এই ফরিদ উদ্দিন ভুঁইয়াকে মনে করবি!”
আমি মিনমিনে গলায় সেদিন বলেছিলাম, “স্যার, আমার কুনো দোষ নাই। পিয়াস আমার চাচা চৌধুরীর দুইটা কাটুন বই লুণ্ঠন করছে ব্যাগ থেকে। ফেরত পর্যন্ত দেয় নাই!”
ফরিদ স্যার আমার শব্দ চয়ন দেখে মুগ্ধ হওয়ার বদলে উলটো ক্ষেপে গিয়ে বেধরক ধোলাই দিয়েছিলেন সেদিন। স্কুলে কমিকস আনা নেয়া নিষেধ ছিল দেখে সেবার লুণ্ঠিত হওয়ার পরেও মার খেয়েছিলাম আচ্ছামত। আজ এতদিন পর এই নাদুস নুদুশ ছেলের শব্দ চয়ন দেখে ফরিদ স্যারের মত না রেগে বরং মুগ্ধই হলাম!
“বাহ্‌! আর কি কি উপকার করলে আজ?”
“এই যে, আপনাকে কোলেস্টেরল খেতে নিষেধ করলাম। এইটাও তো উপকার। মানব সেবা। নজরুল তো এসবের কথাই বলে গেছেন তাই না আঙ্কেল? নেহারি খাবেন না প্লিজ।” মাস্টারের মত করে বলল কথাটা। ফরিদ স্যারের গলার সাথে কোথায় যেন মিল রয়েছে ছেলেটার কথায়।
আমি ঠিক মনে করতে পারলাম না যে খোকার সাধ কবিতায় নজরুল ঠিক কোন জায়গাটায় পরিষ্কার ভাবে মানব সেবার কথা বলে গেছেন। তবে বলে তো গেছেন এটা ঠিক। ছেলের কথায় সত্যতা আছে। মানব সেবা পরম ধর্ম। এইভাবে নেহারি না খেতে বলে বসায় একটু মন খারাপ হয়ে গেল আমার। নজরুল সাহেব সাত সক্কালে কোত্থেকে একটা দেড় ফুট লাটিম পাঠিয়ে দিয়ে আমার বেহেশতি খানা মাটি করে দিলেন!
সামনের প্লেটে পড়ে থাকা গরুর রসালো নলা আর ঝোলগুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। করুণ চোখে তাকালাম হাতের রুটিটার দিকে। এখন ভাপ উঠে মচমচে হয়ে এসেছে ওটা। টিপতেই কড়কড় করে ভেঙে যায়! এ অবস্থায় রেখে দেয়া সম্ভব না। যত বড় উপকারই করতে আসুক না কেন এই ছেলে।
মুখে ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে কেবল বললাম, “নেহারি খেলে কিছু হয় না খোকা। তাছাড়া আমার শরীরে অনেক শক্তি। অল্প সল্প কোলেস্টেরল গেলে কিচ্ছু হবে না।” রুটির টুকরা ঝোলে ডুবিয়ে আবার মুখে দিলাম কিছু হয়নি এমন ভাব করে।
কিন্তু ছেলেটা মুখ কালো করে ফেলেছে, “আঙ্কেল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? তাই না? আমার আব্বা ডাক্তার। আব্বা বলেছে নেহারিতে অনেক ফ্যাট। খেলেই হার্ট এটাক করে। আপনি মরে যেতে চান?” মৃত্যু পথযাত্রীর দিকে আত্মীয় স্বজন যেই চাহুনিটা দেয়- সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কি যন্ত্রণা! ফালুদা খাওয়ার জন্য এই ছেলে কি আর ভাল জায়গা খুঁজে পায়নি? আমার পাশেই বসতে এসেছিল? শান্তি মত নেহারিটাও দেখি খেতে পারছি না এখন। রুটি শেষ করে ঝোলগুলো চামচে নিয়ে নিয়ে খাবো ভেবেছিলাম- এখন দেখি আলোচনা করে করেই আমার নেহারির ঝোল সব জমিয়ে শুকিয়ে দেবে!
নেহারি খাওয়ার বেলা সব সময় এক গ্লাস ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি দিতে বলি আমি। আজকেও দিয়েছিল। খাওয়া হয়নি সেটা। রুটির টুকরাটা হাত থেকে নামিয়ে গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে গিলে ফেললাম পুরোটা। শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখলাম। বোধহয় একটু জোরেই খটাস শব্দে রেখেছিলাম গ্লাসটা, কারণ রেস্টুরেন্টের আশেপাশের মানুষগুলো ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো আমার দিকে। বিরক্ত হয়েছে। পাশের জ্ঞানী নাদুস নুদুস ছেলেটাও সামান্য চমকে উঠল শব্দে।
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বসলাম ছেলেটার দিকে, চেয়ারে আলগাছে হেলান দিলাম পেছন দিকে। গলা খাকারি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললাম, “কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু নেহারি খুব ভালবাসতেন- এটা জানো?”
ছেলেটা হকচকিয়ে তাকায়।
“ওনার বিদ্রোহী কবিতাটা পড়েছো কখনো?”
মাথা এপাশ ওপাশ নাড়ালো। পড়েনি।
“বল বীর, চির উন্নত মম শির- শোনোনি?”
এবারে মাথা ওপরে নিচে দোলালো। শুনেছে সে।
“শোন, কবি নজরুল এই কবিতাটা কখন লিখেছিলেন জানো? তিনি যখন একটা নান রুটি আর নেহারির দোকানে কাজ করতেন- তখন। তিনি সেই সময়ে অভাবের মাঝে কারো সামনেই মাথা নত করেননি। কিন্তু নেহারির সামনে করেছিলেন। এবং নেহারির মাহত্ম নিয়ে বিদ্রোহী কবিতাও লিখে গেছেন। জগতের সমস্ত অভাব, দূর্যোগ আর অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন সেই কবিতায়। এবং সাথে লিখে গিয়েছিলেন নেহারি খেলেই কীভাবে এসব অসাধ্য সাধন করা যায়। বুঝেছো?”
এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ালো। বোঝেনি।
একটা সুক্ষ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে হালকা আবৃতির সুরে বললাম,
“বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
দেখেছো? কবি তৃতীয় লাইনেই কিন্তু নেহারির কথা বলে গিয়েছেন। বলেও গেছেন এই শির, মানে মাথা শুধু নেহারি খাওয়ার জন্যই ঝুকবে। নাহলে হিমাদ্রিও কিছু না!”
নুদুস সাহেব এই প্রথম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। কাজী নজরুল ইসলাম যে নেহারি নিয়েও কবিতা লিখে গেছেন- জানা ছিল না তার।
“এখন তুমিই বলো? কোলেস্টেরল যদি সত্যিই থাকতো- উনি খোকার সাধ কবিতা লিখে আবার নেহারির জন্য বিদ্রোহী কবিতাও রেখে যেতেন? তোমার কি তাই মনে হয়?”
গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন বেচারা! দীর্ঘ এক মিনিট ধরে আকাশ পাতাল কি কি যেন ভাবতে লাগলো ছেলেটা। সেই ফাঁকে গরুর নলাটাতে তৃপ্তির সাথে একটা টান দিতে পারলাম। সবে মাত্র গরম গরম তুলতুলে মজ্জাটা মুখের ভেতর এসে পরেছে- ছেলেটা উজ্জ্বল মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আঙ্কেল, আপনি ঠিকই বলেছেন। কাজী নজরুল এতো বড় ভুল করতে পারে না। নিশ্চই আব্বা কোথাও ভুল করেছেন। নেহারি সবার খাওয়া উচিত। নেহারি খুব ভাল জিনিস! ফালুদা খেয়ে ফেলেছি দেখে এখন আর পেটে জায়গা নাই। থাকলে আমিও এক প্লেট খেয়ে দেখতাম!”
আমি উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে ওর পিঠ চাপড়ে দিলাম সন্তুষ্ট মুখে, “গুড। ভেরি গুড! এখন থেকে নজরুলের সব কবিতা খুব মন দিয়ে পড়বে। কেমন? হাজার হোক, আমাদের জাতীয় কবি বলে কথা। এত অভাবের মাঝে আর কয়জন লিখে গেছে বলো!”
ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা খুশি খুশি মুখে। শাহজাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহজাহান, স্কুলের টাইম হয়ে গেছে। চল যাই। আম্মাকে কিন্তু বলবা না যে ব্যাগ আমি নিয়েছিলাম। ঠিক আছে?”
শাহজাহান মাথা ঝাঁকায় অনুগত ভৃত্যের মত।
দেখলাম নাদুশ নুদুশ ছেলেটা হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। উচ্চতায় দোকানির মুখও দেখতে পাচ্ছে না সে। কিন্তু পকেট থেকে ফালুদার টাকা বের করে হাত ওপরে তুলে বলতে লাগলো, “আঙ্কেল, টাকা নেন। আঙ্কেল?”
দোকানি কাউন্টার থেকে সামনের দিকে প্রায় শুয়ে এসে টাকাটা নিল হাসি মুখে। চেনা জানা হাসি এটা। সম্ভবত নিয়মিত এখানে আসে ছেলেটা খেতে। কারণ বলতে শুনলাম, “ইস্কুলের টাইম হইছে বাজান? যাও তাইলে আজকা। সাবধানে রোড পার হইও। অয় শাজান, আঙ্কেলরে দেইখা নিয়া যাইও।”
আমি তাকালাম না আর সেদিকে। নেহারির ঝোল ঝিমিয়ে পড়া শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি চামচে নিয়ে খেতে লাগলাম। ভেবেছিলাম ছেলেটা চলে গেছে। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝ থেকেও হঠাৎ শুনতে পেলাম রিনরিনে গলাটা, “আঙ্কেল? ও নেহারি আঙ্কেল?”
বিষম খেতে খেতে মুখ তুলে চাইলাম। রেস্টুরেন্টের গেটের কাছে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে তাকিয়েছে আমার দিকে ছেলেটা। আমাকে তাকাতে দেখেই হাত নাড়লো হাসি মুখে, টা টা দিচ্ছে।
কি মনে হল জানি না। ঝোল গলার ভেতরে লেগেছে বিষম খাওয়াতে। কাশি আসছে। চাপতে চাপতে কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, ভাল কথা। তোমার নামটা কি? নেম প্লেটটা খেয়াল করিনি।”
দাঁত বের করে সরল ভাবে হাসলো বাচ্চাটা, “মোঃ ফরহাদ চৌধুরী।”
আমি তাকিয়ে রয়েছি বাচ্চাটার দিকে। টুকটুক করে ছোট ছোট লাফ দিতে দিতে রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছে। রিক্সার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমার ক্ষুদে মিতা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×