বহু..বহু...বছর পরের কোন এক দিন...(দ্বিতীয় খন্ড)
৪-১ এর শুরুতেই একটা ধাক্কা খেলাম ! এই টার্মে সবার থিসিস সুপারভাইজার দেয়া হল। আগের রাতেই আমি আনোয়ারকে বলছিলাম যে, “কুত্তা আজিম-এর আন্ডারে যে পড়বো, তার তো খবরই আছে রে, ঐ হালা তো কোপায়া খাল বানায়া দিবো ”। নিয়তির খেলা বোঝা বড় দায়। পরদিন আমি-ই যখন নিজ হাতে লটারীতে কুত্তা আজিমের নাম তুললাম তখনই তা পরিষ্কার হল। আমি একাই নই, আমার মত আরও পাঁচজন রয়েছে। সবারই মুখ কালো। ঐ শালা যে কি থিসিস দিল কিছুই বুঝলাম না। বি সেকশনের কয়েকজন অবশ্য বোঝার চেষ্টা করেছিল। তারাই যা কিছু করার করত। প্রতিদিনই উল্টাপাল্টা ইকোয়েশন ডিরাইভ করে নিয়ে যেতাম, আর তার ...“তোমাদের মত স্টুপিড তো আমি জীবনেও দেখিনি...ইউ ফিলথি র্যাট...শব্দ করে নাক টানছো কেন...বাইরে গিয়ে নাক পরিষ্কার করে আসো...তোমাদের এখানে পড়ার যোগ্যতা আছে বলে তো মনে হয় না...রাবিশ...ননসেন্স...এই তুমি বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছ কেন...ক্যাপ ছাড়া কলম দিলে কেন...হাতের লেখা এমন কেন...এখানে নীল কালি কেন...চেয়ার টানতে শব্দ হয় কেন...তোমার মুখ হাসি হাসি কেন...”-আমি কুত্তা আজিমের ঝাড়ি শুনে খিক খিক করে হাসতাম। আমার পাশে রাসেলেরও একই অবস্থা। প্রতিদিন আমার বন্ধুরা উৎসুক হয়ে থাকতো কুত্তা আজিম কি করলো জানার জন্য। আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে তাদের সব বলতাম। অবশেষে যখন তার আচরণ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন বাধ্য হয়েই আমরা ডিপার্টমেন্টাল হেড হেলালী স্যারের কাছে লিখিত জানালাম। দেখা যাক কি হয় ! এই টার্মে হয়েছিল আমাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান "মেকানিক্যাল ফেস্টটিভ্যাল”। এ বছর ফেস্টটিভ্যালের টি-শার্ট ডিজাইন করার কাজ দেয়া হয়েছিল আমাকে। আমি তো বেশ কায়দা করে ডিজাইন করলাম, কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল ছাপা নিয়ে। এসব ডিজাইন ছাপাতে গেলে খরচ বেড়ে যাবে। বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে খুব সাদামাটা ভাবে একটি ডিজাইন দাঁড় করালাম। পেছন দিকে একটি আই. সি. ইঞ্জিনের পাওয়ার স্ট্রোক। সামনে পকেটে মামুরের দেয়া অসাধারণ একটি লোগো, দেখে মনে হয় একটি গিয়ার কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায় তা আসলে M.E. লেখা। আর ডান পাশে বিয়াসের লেখা "We MECH the World Move" । এই টার্মই আমরা সবাই প্রথমবারের মত দল বেঁেধ বেড়াতে গিয়েছিলাম। না, খুব বেশী দূরে নয়...নন্দন এমিউজমেন্ট পার্ক। সেখানে তখন লালমাটিয়া মহিলা কলেজের একটি দলও ছিল। না..না.. কিছুই হয় নি। আমরা আমাদের মত ...তারা তাদের মত। তা প্রতনু বরাবরই একটু জলি টাইপের। একবার মেয়েদের একটি গ্র“প আসতে দেখে তাদের সামনে গিয়ে এমনভাবে পোজ দিল যাতে প্রতনুর ছবি তুললে সবগুলো মেয়ের ছবিই আসে। ক্যামেরা নিয়ে সবাই রেডি। মেয়েদের দলটি কাছে আসার সংগে সংগে প্রতনু পেছনদিকে ফিরে প্রায় শব্দ করে বলল “ওই, সবগুলাই তো ফাউল...বাদ দে...শুধু শুধু ফিল্ম নষ্ট” ! তো এই টার্মটি আমরা শেষ করলাম প্রায় এক বছরে। কারণ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল। এ কারণে কয়েক দফা পরীক্ষা পেছালো। শেষ পর্যন্ত তা ছাত্র-পুলিশ সংর্ঘষে রূপ নিল। পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেল। এই সুযোগে আমিও একটু আকটু শরীরচর্চা শুরু করলাম। একটা জীমে ভর্তি হলাম। আমার সাথে ছিল বি সেকশনের ফারুক আর মিনহাজ। তো আমার বন্ধুদের(!) কল্যাণে এবারও যথারীতি পচানি খাইলাম। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হইয়া জীম ছাইড়াই দিলাম। ভেবেছিলাম একটু ফিগার বানিয়ে...মানে...দৃষ্টি আকর্ষণ আর কি ! ধুর হালা, তাউ হইলো না। যাউক গিয়া।
অবশেষ আমরা ৪-২ তে উঠলাম। বুয়েট জীবনের শেষ টার্ম। পড়াশোনাও তুলনামূলক সহজ। চারদিকে কেমন যেন সবকিছু ছেড়ে যাবার একটা আয়োজন। এই টার্মে আমাদের ছয়জনকে নতুন তিনজন থিসিস সুপারভাইজার দেয়া হল। আমি আর রাসেল পড়লাম ড. আশরাফুল ইসলাম স্যার এর আন্ডারে। ইনি খুবই ভালো মানুষ। আগেরজনের ঠিক বিপরীত। তো আমাদের প্রজেক্ট এগিয়ে চলছে। মিড টার্মের ছুটিতে আমরা গেলাম সুন্দরবন ট্যুরে। তা সব মিলিয়ে প্রায় একশ জনের মত ছিল। মেকানিক্যালের ছিল মাত্র ছয় কি সাতজন। সে গল্প না হয় অন্য একদিন করা যাবে। তো সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব। অনেকেই ঠিকমত ক্লাস করে না। বেশ সাফল্যের সাথে একে একে অনেকের প্রক্সি দেয়া শুরু করলাম। দিনে তিন/চারটা হচ্ছে ! শেষ যেদিন আমরা সেশনাল করলাম সেদিন আয়োজন করা হল সামান্য খানাপিনার। এবং সেদিন আমি ঘোষনা দিলাম যে আমি আমার সব সেশনাল পার্টনারদের খাওয়াবো। শেরাটন, সোনার গাঁ, রেডিসান বাদে যেকোন জায়গা ! মূলত সেশনালে ডায়না, জাকারিয়া আর রাব্বির যে কন্ট্রিবিউসান আর একজন নিরীহ দর্শক হিসেবে আমার যে ভূমিকা, সেটাকে স্বীকার করে পাপ মোচনের একটা চেষ্টা। পোলাপান অবশ্য এই লইয়া আমারে কম পচায় নাই। ঠিক হলো পহেলা ফাল্গুন যাওয়া হবে। প্রথমেই ঝামেলা তৈরী করলো রাব্বি। সে যাদের সাথে গত দুই বছর কথা বলেনি(!) তাদের সাথে সে যেতে পারবে না। আমরা সবাই প্রস্তুত, জাকারিয়া তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছে। আবার মেহেদীর ডেটিং আছে, তাকে ছেড়ে দিতে হবে তিনটার মধ্যে। ক্লাস শেষে রিটা, ডায়না আর এমি ললনাত্রয়ের আবদার, আজ তারা সবাই একসঙ্গে থাকবে। তাই আজ না গেলে ভালো হয় ! আমি আর মনন চরম বিরক্ত। তা, তোরা এইগুলা আগে কইলি না ক্যান ? যাওনের সময় দুনিয়ার কথা খেয়াল হইসে। অবশেষে প্রোগ্রাম ক্যানসেল। জাকারিয়া স্বভাবতই ক্ষিপ্ত। সে বলল, প্রোগ্রাম যেদিন খুশি সেদিন কর ! আমি আর যাচ্ছি না ! ধুরররর...হালা সব ফাউল। এ লেখা জমা দেয়ার পূর্ব মুর্হূত পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয় নি। যাই হোক, সময় চলে যাচ্ছে। দিন কেটে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবই শেষ হচ্ছে...শেষ সেশনাল, শেষ ক্লাস, শেষ একসাথে বসা, শেষ একসাথে খাওয়া, শেষ পরীক্ষা, শেষ বুয়েটে আসা, শেষ দেখা...।
এতদিনকার পরিচিত সব মুখকে হঠাৎ কেন যেন আজ খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে ! হঠাৎ করেই সবাই যেন কেমন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ ব্যস্তু কাছের বন্ধুকে না জানিয়ে সি.ভি. তৈরী আর জমা নিয়ে। কেউ কেউ এ.জ.ঊ. বা ওঊখঞঝ নিয়ে। কেউবা ব্যস্ত নতুন কোন প্রেমিকার সন্ধানে, কেউবা পুরানোজনকে নতুন করে ধরে রাখার চেষ্টায়। আর আমি....? বরাবরের মত এবারও একজন দর্শক। জীবনের অনেকগুলো বসন্ত একাই কেটে গেল। সবগুলো ভ্যালেন্টাইন ডে শেষ হয়ে যায় গদ্যময় ক্লাস কিংবা ছন্দহীন সেশনালের মাঝে। শেষ ভ্যালেন্টাইন ডে বিশেষ কোন একজনের সাথে কাটাবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কেন যেন তা আর হলো না। যাকে আমি বিশেষ বলে ভেবেছিলাম সে হয়তো আমাকে সাধারণের কাতারে ফেলেছিল ! যাই হোক, দিনটি কাটালাম প্রজেক্ট আর থিসিস নিয়ে ! এতদিন বুয়েটের মাঝে থেকে কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি। জীবনের এতটা পথ একা একা পাড়ি দেয়ার পর আজ কেন যেন নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ‘০২ ব্যাচের ছাত্ররা ভ্যালেন্টাইন ডে-তে গতবছর টি শার্ট বের করেছিল। ডিজাইন ছিল -একটি হার্ট আর তার উপর ক্রস চিহ্ন দেয়া। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। চ্যানেল আই’র নিউজে দেখালো “বুয়েট ছাত্রদের ব্যতিক্রমী ভালবাসা দিবস পালন...”। হয়তো আসলেই খুব হৃদয়হীন হয়ে গিয়েছি আমরা !
..........................(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৩ সকাল ১০:১৪