somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাবলিনের ডায়েরী - আট (২ অগাস্ট ২০০৮)

০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ রাত ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি কোন দিনও কল্পনা করিনি পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমি ঘুমাতে যাবো, আবার পাহাড়ের কোল ঘেসে জেগে ওঠা সূর্য সকালে তুলে দেবে আমায় ঘুম থেকে। সবই মাঝে মাঝে স্বপ্নের মত মনে হয়। কোথা থেকে যেন কি হয়ে গেলো....। তাকিয়ে আছি মুগ্ধ চোখে পাহাড়ের দিকে। আমার জানালার পর্দা সরানো, আর তা দিয়ে দেখা যাচ্ছে উত্তর ডাবলিনের পাহাড়। রাত সাড়ে নয়টায়ও আজ বেশ আলো রয়েছে। যদিও গ্রীষ্মের সময়টায় সাড়ে দশটার আগে অন্ধকার নামে না। একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। কিভাবে দেখতে দেখতে প্রায় নয় মাস চলে গেলো। এখনো মনে হয়, এইতো সেদিন এলাম এখানে!

আজ বেশ কিছু কাজ করেছি। রুমটা ভয়াবহ নোংরা ছিল। সেটা পরিষ্কার করলাম। কিচেনটা পরিষ্কার করে গ্রিন বিন এবং ব্ল্যাক বিনে ময়লাগুলো আলাদা ভাবে ভরে পরিবেশটা বেশ ঝকঝকে করে ফেলেছি। পালাক্রমে চলছে ওয়াশিং মেশিন এবং ড্রায়ারে কাপড় ধোয়া এবং শুকানোর কাজ। আগের রান্না কিছুটা রয়েছে, তাই সেই ঝামেলায় আর গেলাম না। তাছাড়া তাড়া নেই। তিনদিনের উইক এন্ড। সময় পালিয়ে যাচ্ছে না। আহ... সময়টা বেশ যাচ্ছে।

সিনেমা দেখার পোকাটা মাথায় বেশ ভালো ভাবে গেঁথেছে। সুযোগ হলেই একটা সিনেমা দেখতে চলে যাই। কালও গিয়েছিলাম। এক্স ফাইলস-এর ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে। কিন্তু ছবিতো দেখা হলোই না, বরং চার ঘন্টা যা করলাম, নিজেকে এখন খুব ছোট মনে হচ্ছে। আসলেই, মাঝে মাঝে নিজের উপর নিয়ন্ত্রনটা চলে যায়। তখনই বোধয় মানুষের আসল পরীক্ষার সময় আসে। সে পরীক্ষায় কাল আমি শুন্য পেয়ে ফেইল করেছি। ফারহানের সাথে এখন কথা হয় গুগলে। বেশ ভালো ছেলে। সবচেয়ে ভালো ওর চিন্তাগুলো। কাল আমাকে একটা পরামর্শ দিয়েছে। সারারাত সেটা নিয়ে ভাবলাম। ঠিক করেছি এর পর থেকে মাথায় পাগলামীগুলো আসলে ফারহানের কথা মত ব্যবস্থা নেব। দেখা যাক কাজ হয় কি না!

গত বুধবার খুব ভালো একটা দিন গিয়েছে। ভালো এ জন্য যে সেদিন আমার সুপার ভাইজার সম্ভবত প্রায় তিন মাস পর আমার পড়াশোনার প্রোগ্রেস দেখে খুশি হয়েছেন। বিষয়টা আসলে এতটা হাল্কা নয়। প্রথন দিকে স্টিফান বেশ অনুপ্রেরনা যোগাতেন। তার সব ছাত্রদের সাথে পড়ার বাহিরেও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতেন এবং মজা করতেন। এমনকি ছুটিতে জার্মানী গেলে বেশ কিছু চকলেটও নিয়ে এসেছিলেন আমাদের জন্য। প্রায়ই একটা কথা বলেন স্টিফান, সেটা হলো স্ট্যাডির জন্য চাই মোটিভেশন। কিন্তু সেই মোটিভেশনটাই আমি পাচ্ছিলাম না গত তিন মাস।

এপ্রিলের দিকে স্টিফানকে জানিয়ে ছিলাম আমি মাস্টার্স করে পি.এইচ.ডি করতে লন্ডন শিফ্ট করতে চাই। আমার স্কলারশীপ এম.এস.সি লিডিং টু পি.এইচ.ডি। অতএব স্টিফান জানতেন আমি একবারে পি.এইচ.ডি করে তারপর যাবো। কিন্তু যখন শুনলেন আমি মাস্টার্সের পর চলে যেতে চাইছি, তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল তার। যারা আমার অগের ব্লগগুলো পড়েছেন তারা জানেন স্টিফান কি কষ্টটাই না করেছে আমার স্কলারশীপের জন্য। সেই আমি যখন অকৃতজ্ঞের মত এভাবে চলে যেতে চাইছি, সেটা তার খারাপ লাগারই কথা। তবে কি করবো আমি? আমিওতো মানুষ। আমারওতো ইচ্ছে করে আরো ভালো কোথাও থেকে পি.এইচ.ডিটা করি। যাইহোক, স্টিফান জেন্টেলম্যান স্পিরিট থেকে বলেছিলেন কোন সমস্যা নেই কিন্তু এর পর থেকে মোটিভেশনের সেই উচ্ছাসটা হারিয়ে গিয়েছিল। গত বুধবার সেই উচ্ছাসটা আবার দেখতে পেলাম তার কন্ঠে। বারবার বলছিল, "দিস্ স্যুড বি দ্যা ওয়ে টু স্ট্যাডি।" আমার থিসিসের প্রি-ড্রাফট দেখাচ্ছিলাম স্টিফানকে। সেটা এবং কাজের অগ্রগতি দেখে খুশি হয়ে এই মন্তব্য করেছেন। হাসিটাও ছিল আগের মত সাবলিল।

এখানে সুপারভাইজারদের প্রেস্টিজ ইস্যু তাদের ছাত্ররা। কারো ছাত্র খারাপ করলে আড়ালে তাদের নিয়ে হাসা হয়। স্টিফান এবং আমিও মাঝে মাঝে অনেককে নিয়ে হাসাহাসি করতাম। কিন্তু সময় বদলে যাবার পর দেখা গেলো সেই খোশ গল্পও এখন আর হয় না। মনেমনে ঈশ্বরকে বলেছি, আমাকে শক্তি দাও। আমি যেন অন্তত যাওয়ার আগে একটা ভালো থিসিস জমা দিয়ে যেতে পারি। কেউ যেন বলতে না পারে স্টিফানের ছাত্র গা-ছাড়া কাজ করে পাশ করে গিয়েছে। স্টিফানের হাসিটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ন। আমি সেটা সব সময় বজায় রাখতে চাই।

কালকে আমার ইলেক্ট্রিকালের বন্ধু শিনার সাথে দেখা। শিনা নাইজেরিয়ার ছেলে। কনভোকেশন নিয়েছে গত সপ্তাহে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে ক্যাম্পাসে বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরছে। হঠাৎ দেখা। জিজ্ঞেস করলাম কি করছে এই অসময়ে। বললো, স্মৃতি হাতড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পি.এইচ.ডির জন্য কানাডা চলে যাবে, কুইনস ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ হয়ে গিয়েছে। তাই ট্রিনিটিকে একটু ঘুরে দেখছে। হয়তো আর আয়ারল্যান্ড কখনই আসা হবে না। শিনার কাছেই শুনলাম একটা অদ্ভুত কথা। ট্রিনিটির কনভোকেশন হয় ল্যাটিন ভাষায়! মাথা মুন্ডু কিছু বোঝা যায় না। সার্টিফিকেট সহ সব ডকুমেন্টও ল্যাটিনে! আয়ারল্যন্ড ইংরেজী ভাষী রাষ্ট্র হয়েও সব ল্যাটিনে কেন করছে? এই প্রশ্ন শিনারও ছিল। জবাব হলো, ল্যাটিন নাকি জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য পশ ভাষা! গত চারশ বছর ধরে ট্রিনিটির কনভোকেশন এভাবেই হয়ে আসছে। তবে সার্টিফিকেটের একটা ইংরেজী ট্রান্সলেশন সাথে দেয়া হয়। শুনে বললাম ব্যপারটা তাহলে এমন দাড়াচ্ছে আসল সার্টিফিকেটটা একটা পোট্রেট ছাড়া আর কিছু নয়, ট্রান্সলেশনটাই মূখ্য। শিনা হেসে বললো যথার্থ। কারন সার্টিফিকেটটা একটা বিশাল সাইজের ছবির সমান। ওটা নিয়ে চলাচলও করা যায় না!!!

আজ বন্ধু দিবস। সবাই বেশ করে পোস্ট দিচ্ছে। ফেইসবুকের ফান ওয়ালের মেইলে জিমেইল ভরে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে কি এগুলো কমার্শিয়াল জগতের ব্যবসার আরেকটা নব্য ধারা নয়? পিজা হাটে অগ্নি মূল্যে পিজা খাবে সবাই। কে.এফ.সি-তে গিয়ে বন্ধুত্বের নামে বেশ কিছু টাকা পূজিবাদী বুর্জুয়াদের হাতে শঁপে দিয়ে আসবে। আর্চি আর হলমার্কের কার্ডগুলো বিক্রি হবে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে। কি আজব! যেন সারা বছর বন্ধুত্বের কোন স্মারকই ছিল না! একুশ শতকের মিডিয়া আমাদের যেভাবে নাচায়, আমরা সেভাবে নাচি। ভ্যালেন্টাইনস ডে'র নামে চলতো নোংরা উৎসব, এখন বন্ধু দিবসের নামে মধ্যবিত্তের পকেট কাটার নুতন পন্থা। কোন এক ধনীর দুলালকে পোর্শে গাড়ী নিয়ে পিজা হাটে যেতে দেখে, মধ্যবিত্তের ছেলেটিকেও অন্তত রিক্সায় করে হলেও ওখানে যেতে হবে! অন্তত বিশেষ কিছু দিন। কিন্তু কেন? কেন এই লোক দেখানো ভালোবাসার নামে ভালোবাসারই অপমান? এক দিকে মধ্যবিত্ত হবে রিক্ত। অন্য দিকে পকেট ফুলে উঠবে লতিফুর রহমানদের। পিজা হাটের পর এনেছে কে.এফ.সি; এর পর আসবে ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং। অবুঝ ছেলেমেয়েরা তারুন্যের আনন্দ উপভোগ করতে যথারীতি যাবে এবং কেনার পরিবর্তে আসলে বিক্রি করে দিয়ে আসবে নিজের স্বকিয়তাকে।

আফসোস, আজ ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের মত পবিত্র অনুভুতিগুলো আর হৃদয়ে জন্মায় না, কে.এফ.সি-তে তৈরী হয়!

২ অগাস্ট ২০০৮
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ রাত ৩:৩৬
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×