তিন মাসের বেশি হবে আমি ডায়েরী লিখি না। আসলে ব্লগ থেকেই দূরে ছিলাম বেশ কিছু দিন। এখন নিঃসঙ্গ জীবনে কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করে সব সময়। ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। পরিবার থেকে অনেক অনেক দূরে, সম্পূর্ন একা। মাস্টার্স প্রায় শেষ কিন্তু পি.এইচ.ডি-এর স্কলারশীপটা এখনও নিশ্চিত নয়। খালুর মৃত্যু এবং মামার রোড এক্সিডেন্ট। সবকিছু যেন এক সাথে চেপে ধরে আছে আমার চারপাশকে। প্রতিনিয়ত কেমন যেন একটা অনুভুতি, আরেকটা খারাপ সংবাদ শোনার ভয়। আসলে এখন যেন কোন ভালো খবর আশাই করতে পারিনা। খবর বলতে এখন সবই যেন খারাপ খবর। তবুও জীবন চলছে, অন্যভাবে বলা যায় চালাতে হয়।
এমনটা নয় যে আমি ডাবলিনে খুব খারাপ আছি। আগে রান্না করে, ঘর গুছিয়ে তারপর পড়াশোনা করতে বেশ কষ্ট হতো। এমনও দিন গিয়েছে যে মনে হতো আর পারছি না। এখন সে দিন আর নেই। বেশ রান্না করছি, ঘর গোছাচ্ছি। নিজের কাজ নিজে করে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সায়মা শুনে বলে, "বেশতো, আমাকে রেধে খাওয়াবা"। আমি হাসি। ভালোবাসার মানুষের আবদারেও বোধয় ভালোবাসা থাকে।
যতই দিন যাচ্ছে, অনুভব করছি জীবনটা যেন সরে সরে যাচ্ছে। সূর্য নাকি তার গ্যালাক্সির চারপাশে ঘোরে। আমিও ঘুরছি। আমার জীবনের চারপাশে। একটা সময় ছিল যখন প্রবল জাতীয়তাবোধ ছিল। আব্বু বলতেন এ্যামেরিকা গিয়ে স্যাটেল করার কথা। শুনে আমি বিরক্ত হতাম। বলতাম তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিকত্বের দরকার নেই আমার। তখন বুঝিনি, আব্বু আসলে মনেমনে আরো বড় দেশে স্যাটেল করার কথা চিন্তা করে রেখেছিলেন। আব্বু চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। আম্মু, ছোটবোন আর আমি। ছোট হয়ে এলো সংসার। একসময় আমিও চলে আসলাম পরবাসে। মাঝেমাঝে শুনি আমাদের বাসাটা নাকি খা খা করে। জোরে গান শুনলে আম্মু বিরক্ত হতো। হয়তো এখন সেই বিরক্তিটাকে মিস করে আম্মু। জীবনটাই এমন। প্রতিনিয়ত ঘুরছে। কাল যা অপছন্দের ছিল, আজ তাই পছন্দের হয়ে যায়। এখন ইচ্ছে করে বাহিরে স্যাটেল হতে। ছোটবোনকে বলি মাঝে মাঝে। শুনে হাসে। উপর থেকে আব্বুও হয়তো হাসছেন। বলছেন, "আমি বলেছিলাম না....?"।
অতীতের আয়নায় তাকালে অবাক লাগে। দেখতে দেখতে একবছর কেটে গেলো। মাঝেমাঝে মনে হয় এইতো সেদিন আমি ট্রিনিটির সামনে এসে নামলাম। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে, শূন্যের কাছাকাছি ঠান্ডায় লাগেজ হারিয়ে আমি অসহায়ের মত ট্রিনিটির গেটে এক ভোরে এসে দাড়িয়েছিলাম। ২০০৭ সনের নভেম্বরের তের তারিখ। এখন আরেক নভেম্বর। গাছের পাতাগুলো সব পড়ে যাচ্ছে। আবার নুতন পাতা গজাবে আর মনে করিয়ে দেবে আরেকটি বছর চলে যাচ্ছে। তবুও আমি যুদ্ধ করেই যাবো, যেন আমার এ যুদ্ধের কোন শেষ নেই।
ভাবের কথা অনেক হয়েছে। ডায়েরী লিখতে বসেছি, গদ্য নয়। ডায়েরী হওয়া উচিত দিনের প্রত্যক্ষ বর্ননা সমৃদ্ধ। বরং তাই করা যাক। আজ সারা দিন কি করেছি? সকালে উঠে সপ্তাখানেকের জমে থাকা দাড়ি সেভ করলাম। খুব ভাবের সাথে তিনদিন পর সাওয়ার নিলাম। মনে পড়ছিল গত ডিসেম্বরে ১৪দিন সাওয়ার ছাড়া ছিলাম। আবার সেই বাতিক ফিরে আসবে নাকি? আসলে মন্দ হয় না। একবার আব্বুর সাথে বাজী লেগেছিলাম। দুই সপ্তাহ সাওয়ার না নিলে দুই হাজার টাকা। আম্মুর যন্ত্রনায় পারিনি। আব্বু যখন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তখন এমন হতো। অনেক সময় দুই তিন সপ্তাহ গোসল কি জিনিস সেটা চোখে দেখতেন না। ভাবতেই কেমন যেন লাগে। আব্বু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন। আচ্ছা, ভয় লাগতো না? আমি কি পারবো? নিশ্চিৎ ভাবে বলতে পারি, পারবো না। তাহলে আব্বুরা পেরেছিলেন কি করে? উত্তরটা খুব সুন্দর করে দিয়েছেন জহির রায়হান। দুই শব্দের উত্তর - সময়ের প্রয়োজনে।
আবার ভাবের কথায় চলে গেলাম। ফিরে আসা যাক দিনের বর্ননায়। এত ফিট-ফাট বাবু সেজে বের হবার উদ্দেশ্য ছিল বটে। আজকে ভিসা এক্সটেন্ড করাতে গিয়েছিলাম। লাইনে যেই দাড়াতে যাবো, একজন এসে বললো আজ আর টিকেট দেয়া হবে না। এগারোটায় ক্লোজ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১১.০১ বাজে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। ল্যাবে ফিরে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। লাঞ্চটা করে এলেমেলো হাটার জন্য বের হয়ে পড়লাম। অনেকদিন এভাবে হিমু টাইপ হাটা হয় না। কিন্তু তাতেও বিপত্তি। মন এখন কেমন যেন রুটিনের ছক বেঁধে চলে। হাটতে হাটতে চলে আসলাম সিনে ওয়ার্ডের সামনে। মনে হলো একটা মুভি দেখে যাই। আর বেশি চিন্তা না করেই দ্রুত ঢুকে পড়লাম। টিকেট কাটলাম এক মুভির, দেখতে ঢুকলাম আরেকটা। মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস গার্ল। দেখে মনে হলো হলিউডের কি এতই খারাপ দিন পড়লো যে বলিউডকে নকল করবে? পেয়ার ইশক অর মোহাব্বতের ঘষামাজা একটা হলিউড ভার্সন। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হিন্দীটার থেকে অনেক বেশি গোছানো এবং সুন্দর হয়েছে এই মুভিটা।
ছবি দেখে বের হয়ে আসার পর আবার হাটা শুরু করলাম। এবার এক অদ্ভুত হাটা। ট্রামের রাস্তা ধরে হাটছি তো হাটছি। উদ্দেশ্য যখন হাপিয়ে যাবো, ট্রামে উঠে পড়বো। এভাবেই হাটতে হাটতে চলে আসলাম ডাবলিনের এক ভিক্টোরিয়ান এলাকায়। এখানে দূর থেকে বার কয়েক চোখ গিয়েছিল কিন্তু কোন দিন যাওয়া হয়নি। পুরো এলাকাটা একটা ক্লাসিক ছবির সুটিং স্পটের মত। যদিও ডাবলিন শহরটাই ভিক্টোরিয়ান লুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে, এই অংশটা যেন তার রাজধানী। গাড়ী খুব একটা চলতে দেয়না। পিচের রাস্তার পরিবর্তে কালো ইটের রাস্তা। মাঝে ট্রামের লাইন চলে গিয়েছে। চারপাশে পুরোনো দিনের স্থাপত্যের নিদর্শন। ক্যাফে আর পাবগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে। টুরিস্টরা এলোমেলো হাটছে। কেউকেউ ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি তখন পুরোই হিমু। হাটছিতো হাটছি। কোন দিকে নজর নেই। কেবল হেটেই চলেছি। চোখে পড়লো আইরিশ ফিল্ম আর্কাইভ সেন্টার, বড় একটা চার্চ, কিছু বেশ দামী হোটেল আর অনেক অনেক ক্যাফে। জয়তুন নামে একটা পারস্যের ক্যাফে ছিল। ভেতরে উকি দিয়ে যে দাম দেখলাম, তাতে ঢোকার ইচ্ছা দরজাতেই শেষ হয়ে গেলো।
আবার হাটা শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে দুটো মেয়ে উঠে এসে খিলখিল করে হাসছে। তাদের হাসির বেগ এতটাই ছিল যে একজন আরেকজনের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। বিষয়টা কি? কৌতুহলী মন দেখার জন্য তৎপর হয়ে উঠলো। উঁকি দিয়ে দেখি একটা দোকান। তাতে লেখা - "কনডম পাওয়ার এ্যাডাল্ট শপ"। বুঝতে বাকি রইলো না মেয়ে দুটোর হাসির রহস্য। আজ মেজাজ অন্যরকম ছিল। তাই আর বিশেষ মনোযোগ দিলাম না দোকানটার দিকে। অন্যকোন দিন গিয়ে দেখবো বলে ঠিক করে উঠে আসলাম। আবার হাটা। হাটতে হাটতে একসময় দেখি ট্রিনিটির সামনের বড় রাস্তায় চলে এসেছি। অবাক হলাম। শুরু করেছিলাম ট্রিনিটি থেকে, শেষও হলো ট্রিনিটির সামনে এসে। এটাই মনে হয় জীবন। ক্রমাগত আমরা ঘুরছি। কখনও জেনে, কখনও অজান্তে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে। রাস্তায় আসার সময় ওভারকোটের মোটা কাপড় ভেদ করে যেন ঠান্ডাটা শরীরে ছুরির মত বসে যাচ্ছিল। অথচ কষ্টের পরিবর্তে একটা ভালোলাগা আছে তাতে। যতক্ষন বরফশীতল বাতাসের মধ্যে থাকি, অন্যরকম একটা আরাম অনুভুত হয়। সারা দিনের ক্লান্তি যেন একটু একটু করে শুষে নেয় এই বাতাস। জীবনের ম্যারাথন দৌড়ে এই পরশটুকুর খুব দরকার। আমার নিজের ঘর ছেড়ে আজ আমি হাজার মাইল দূরে, অথচ সারাদিনের ব্যাস্ততা শেষে ফিরে এলে এক রুমের এই বাসাটাও যেন আমার কাছে মনে হয় শান্তির নীড়। হয়তো অনেক দূর থেকে আব্বু আজও বলেন, "বলেছিলাম না...?"
২৮ নভেম্বর ২০০৮
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।