শিল্পজগতের প্রবাদপুরুষ রং-তুলির কারিগর, দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোকাহত আমরা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
দীর্ঘ জীবনে যিনি ছবির মাধ্যমে শিল্পরসিক বাঙালিকে বাংলার রূপ, রস, গন্ধ দেখিয়েছেন তিনি শিল্পজগতের প্রবাদপুরুষ স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। যিনি আমাদের দৃষ্টি রুচিটাই ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছেন তাঁর সুক্ষ্ম তুলির আঁচড়ে। অনেকেই বলেন, কাইয়ুম চৌধুরীর ভেতর শিল্পী জয়নুল আবেদীন এবং কামরুল হাসানের ধারাকে দেখা যায়। শুধু ক্যানভাসই নয়, বইয়ের প্রচ্ছদে ও অলঙ্করণেও সেই রূপকে তুলে এনেছেন তিনি, অবদান রেখেছেন বাঙালির শিল্পরুচি গঠনে। প্রায় ছয় দশকের অধিক সময় ধরে একাগ্র শিল্পচর্চায় আমাদের চারুকলার জগেক যিনি ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছেন, আমগ্ন নিষ্ঠাবান সাধনা দ্বারা অনুপ্রাণিত করেছেন বহু শিক্ষার্থী ও শিল্পীকে। সত্যিকার অর্থে কাইয়ুম চৌধুরী একজন বিশ্বমানের চিত্রশিল্পী। সত্যজিৎ রায়ের পর গ্রাফিকস কিংবা প্রচ্ছদশিল্পকে অন্যরকম অবস্থানে নিয়ে গেছেন। এ জন্য তিনি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শিল্পজগতের প্রবাদপুরুষ স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আর নেই। রবিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার সময় হঠাৎ পড়ে যান তিনি।
জানা গেছে, কাইয়ুম চৌধুরী বক্তৃতা দিয়ে নেমে যাওয়ার পরে রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দিতে দাঁড়ান। এ সময় কাইয়ুম চৌধুরী আবার ফিরে এসে বলেন- ‘আমার একটি কথা বলার রয়েছে’। ঠিক ওই মুহূর্তে তিনি মঞ্চে পড়ে যান। মঞ্চে পড়ে মাথায় আঘাত পান প্রবীণ চিত্রশিল্পী। এরপর প্রবীণ এই চিত্রশিল্পীকে সম্মিলিত সামারিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন।
শিল্পজগতের প্রবাদপুরুষ দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোকাহত আমরা।
বরণ্যে চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ ফেনী জেলার এক সম্ভ্রান্ত জমিদা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ক্ষয়িঞ্চু যে-জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম সেখানে বিত্তের পূর্বতন জৌলুস বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, কিন্তু এই পরিবারে শিক্ষা ও উদার মানসের ছিল জোরদার অবস্থান। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও পিতার সামাজিক যোগাযোগও ছিল অনেক বিস্তৃত। তার পিতা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় বিভাগের পরিদর্শক। পরবর্তীতে তিনি সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী বাংলার অনেক এলাকায় ঘুরে ফিরেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর শিক্ষার হাতেখড়ি মক্তবে , তারপর ভর্তি হন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে যান নড়াইলে। চিত্রা পাড়ের এই শহরে কাটে তাঁর তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপ এসে ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ও পরে কারগিল হাই স্কুলে। এরপর নোয়াখালী জেলা সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে তাঁর ঠাঁই বদল হয় ফেনীতে। ভর্তি হলেন ফেনী হাই স্কুলে, সেখানে থেকে যান ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ এসে ১৯৪৯ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে যখন ম্যাট্রিক পাশ করেন।
স্কুল জীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক দেখা গিয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ করেছেন । তেল রঙ, জল রঙ, কালি-কলম, মোমরং, রেশমছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাইয়ুম চৌধুরী কাজ করেছেন। তাঁর প্রকটি প্রবণতা জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ। বস্তুতঃ তাঁর ছবি নকশা প্রধান। বর্ণিল পটভূমিতে মোটাদাগের নকশা তাঁর প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। লাল, নীল, সবুজ এই তিনটি রং তিনি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেন। এই বর্ণভঙ্গী তাঁর চিত্ররীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ক্যানভাসের আয়তন প্রায়শঃ বর্গাকার। এছাড়া তাঁর চিত্রাবলিতে এদেশের লোকশিল্পসুলভ পুতুল, পাখা, হাড়িঁ, মীতলপাটি, কাঁথা ইত্যাদির পুনঃপৌণিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
(কলকাতায় দুই বাংলার চিত্রকরদের আর্ট ক্যাম্পে উদ্বোধনী ছবি আঁকছেন কাইয়ুম চৌধুরী)
১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে জহির রায়হানের 'শেষ বিকেলের মেয়ে' গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার অধ্যায় উন্মোচন শুরু করে আবদুশ শাকুরের 'ক্ষীয়মাণ' এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ 'একদা এক রাজ্যে' প্রকাশ দ্বারা। এই দুই প্রকাশনা সংস্থার কাজের পেছনে বরাবরই কাইয়ুম চৌধুরী সক্রিয় থেকেছেন। তিনি আরও প্রচ্ছদ আঁকেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজাভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। ব্যক্তিগত জীবনে কাইউম চৌধুরী ১৯৬০ সালে তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিনয়-বন্দনে আবদ্ধ হন।তাহেরা খানম ছিলেন আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া প্রথম চারজন ছাত্রীর একজন। তাঁর শৈল্পিক প্রয়াসের জন্য অনুকূল ছিল এবং স্ত্রীর ভূমিকা প্রেরণাদায়ক ছিল।
মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী সংস্কৃতিতে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীসহ ৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন। স্বাধীনতা পুরস্কার হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ পদক দেয়া হয়। আগামী ২৫ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মনোনীত ব্যক্তি ও তাঁদের প্রতিনিধিদের হাতে মর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনতা পদক তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ পুরস্কারের জন্য মনোনীতরা একটি করে স্বর্ণপদক এবং একটি সম্মাননাসূচক প্রত্যয়নপত্র পাবেন। এর সঙ্গে নগদ পুরস্কার হিসেবে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদক এবং ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদক লাভ করেন।
বাংলাদেশে শিল্পী হিসাবে যারা কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য শিল্পজগতের প্রবাদপুরুষ স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি হাজার বছর বেঁচে থাকবেনৃ আমাদের মাঝে তার নিপুন শিল্পের মাঝে। রংতুলির কারিগর কাইযুম চৌধুরীর মৃত্যুদিনে সামু ব্লগের পক্ষ থেকে তার আত্মার মাগফিরাত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা
তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান
উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!
এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।
"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কে কাকে বিশ্বাস করবে?
করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।
সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন