ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ও বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। ঢাকাশহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। দেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, চিন্তক ও প্রগতিশীল চেতনার ধারক মুনতাসীর মামুন একাধারে কিশোর সাহিত্য রচয়িতা, ছোটগল্পকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকার। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক গবেষক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, শিল্প সমালোচক, শিল্প সংগ্রাহকসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চার মতো সৃজনশীল কাজেও তিনি নিয়োজিত। নানান প্রতিকূলতা যেমন, মৃত্যুর হুমকি, মুরতাদ ঘোষণার পরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কীর্তিমান শিক্ষক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’-এর বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক। শিক্ষক হিসেবে লেখন, পঠন ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কলমযোদ্ধা হিসেবে রাজপথ থেকে কারাবরণ পর্যন্ত বহুমাত্রিক ভূমিকা তাকে এনে দিয়েছে জনসমাজে বিশিষ্টতার আসন। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ একটি জনরাষ্ট্রে পরিণত করতে অধ্যাপক মামুনের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা অনন্য। আজ এই লেখকের ৬৬তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে অধ্যাপক ড.মুনতাসীর মামুনের জন্য ফুলেল শুভেচ্ছ।
প্রতিথযশা লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, পুরো নাম মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন। জন্ম ১৯৫১ সালের ২৪ মে ঢাকার ইসলামপুরে নানার বাড়িতে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মিসবাহউদ্দিন এবং মায়ের নাম জাহানারা খান। পিতামাতার তিন পুত্রের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। মুনতাসীর মামুনের শৈশব-কৈশর কেটেছে চট্টগ্রামের চাঁটগায়। চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাষ্ট প্রাইমারি ও হাইস্কুলে এবং চট্টগ্রাম কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৭২ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই বিভাগ থেকে ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনিই প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই দৈনিক বাংলা/বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মুনতাসীর মামুন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি ঢাকাশহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউটে' সন্মানিক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ১৯৯৯-২০০২সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। কৈশর থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত হয়ে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু লেখক হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর অনুবাদ, চিত্র সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচনা করেন অনেক বই। তাঁর লেখালেখি ও গবেষনার বিষয় উনিশ, বিশ ও একুশ শতকের পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ ও ঢাকা শহর। ঢাকার ইতিহাস চর্চার সঙ্গে ড. মুনতাসীর মামুনের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গত দু’দশকে তাঁর নিরলস চেষ্টায় ঢাকার ইতিহাস আক্ষরিক অর্থে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ঢাকা নিয়ে গবেষণার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি এই পদে থেকে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ নিয়ে গবেষণা করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ডাকসুর প্রথম নির্বাচনে মুনতাসীর মামুন ছিলেন সম্পাদক। একই সময়ে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি। ডাকসুর মুখপত্র "ছাত্রবার্তা" প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায়। তিনি বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যথাক্রমে প্রথম যুগ্ম আহ্ববায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক। তিনি জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং জাতীয় আর্কাইভসের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ঢাকার ইতিহাস চর্চার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্টার ফর ঢাকা ষ্টাডিজ (ঢাকা চর্চা কেন্দ্র)। এ কেন্দ্র থেকে ঢাকা ওপর ধারাবাহিক ভাবে ১২টি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাংলা একাডেমীর একজন ফেলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিনেটের নির্বাচিত সদস্য হয়েছেন কয়েকবার। '৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তিনি একজন প্রতিষ্ঠাতা ও সক্রিয় সদস্য। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ফাতেমা মামুন প্রতিষ্ঠা করেছেন মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা মামুন ট্রাস্ট। এ ট্রাস্ট গরিব শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের নিয়মিত সাহায্য করছে।
মুনতাসীর মামুনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২০। গল্প, কিশোর সাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষনা, চিত্র সমালোচনা, অনুবাদ সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুনতাসীর মামুনের বিচরণ থাকলেও ইতিহাসই তার প্রধান কর্মক্ষেত্র। । তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ
• প্রশাসনের অন্দরমহল, • ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, • বাংলাদেশের রাজনীতিঃ এক দশক, • ১৯ শতকের ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা,
• ১৯ শতকে পূর্ববঙ্গের মুদ্রণ ও প্রকাশনা, • আইন, আদালত ও জনতা, • ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়া, • ১৯৭১ চুকনগরে গণহত্যা, • আমার ছেলেবেলা , • দুঃসময়ের দিনগুলি, • ঢাকার স্মৃতি ৯ এবং ১০, • ঢাকার স্মৃতি ৮,
লেখকের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার সমূহঃ
• বাংলা একাডেমী পুরস্কার, • লেখক শিবির পুরস্কার, • সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, • একুশে পদক (২০১০), • নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, • হাকিম হাবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক পুরস্কার, • ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, • অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার
• অলক্ত স্বর্ণপদক পুরস্কার, • ডঃ হিলালী স্বর্ণপদক, • প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৩), • মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিয়েন্স শহর তাঁকে 'অনারেবল ইন্টারন্যাশনাল অনারারী সিটিজেনশিপ' প্রদান করে।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী ফাতেমা মামুন একজন ব্যাংকার। মুনতাসির মামুনের দুই ছেলে মিসবাহউদ্দিন মুনতাসীর ও নাবীল মুনতাসীর এবং কন্যা রয়া মুনতাসীর। তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। আজ এই লেখকের ৬৬তম জন্মদিন। জন্মদিনে তার জন্য ফুলেল শুভেচ্ছা।
উৎসর্গঃ জনাব চাঁদগাজী। যিনি কখনোই আমাকে জীবিত গুণীজনদের নিয়ে লেখা পড়ার সুযোগ পান নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:২৫