(প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার)
না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। বার্তা কক্ষে তিনি তার মৃত্যু প্রত্যাশা করলেও সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ১৩ আগস্ট সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত নয়টা পঁচিশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমসহ সারা দেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। এছাড়াও তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, জাসদ একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু জাফর সূর্য প্রমুখ। জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, শিশু সাহিত্যিক ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠনও তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে । কিংবদন্তি সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
গোলাম সারওয়ার ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায় জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা এবং মাতা মরহুমা সিতারা বেগম। ছোটবেলা থেকেই তার লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল। তার সাংবাদিকতার জীবন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৬৩ সালে দৈনিক পয়গম দিয়ে। এর আগে তিনি চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে তিনি দৈনিক সংবাদে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। এরপর নিজ এলাকা বানারীপাড়ায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৭২ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানেই যথাক্রমে প্রধান সহ-সম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তিনি। এর ছয় বছর পর ২০০৫ সালে আরেকটি নতুন দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রবীণ এ সাংবাদিক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে যান সে দায়িত্ব। গোলাম সারওয়ার দৈনিক সমকালের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সমকালের সম্পাদক ছাড়াও গোলাম সারওয়ার বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান, সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি সেন্সর বোর্ডের আপিল বিভাগের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। একাধিকবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন খ্যাতিমান এ সাংবাদিক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রচুর বই লিখেছেন গোলাম সারওয়ার। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ছড়াগ্রন্থ ‘রঙিন বেলুন’ এবং প্রবন্ধ সংকলন ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে সরকার প্রথিতযশা এ সাংবাদিককে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি ২০১৬ সালে কালচারাল জার্নালিস্টস ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) আজীবন সম্মাননা এবং ২০১৭ সালে আতাউস সামাদ স্মারক ট্রাস্ট আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন।
গোলাম সারওয়ার দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। সোমবার দুপুরের পর থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন গোলাম সারওয়ারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বিকেল ৫টায় লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় তাকে। তখন চিকিৎসকরা তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছিলেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে। দেশবরেণ্য সাংবাদিক, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং প্রেস ইন্সটিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক সফল সাংবাদিকের জীবনের সমাপ্তি ঘটল। প্রয়াত এ সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যরা তার মরদেহের সঙ্গে সিঙ্গাপুরেই অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তার মৃতদেহ দেশে নিয়ে এসে দাফন করা হবে। গোলাম সারওয়ারের মরদেহ আজ মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা রয়েছে। আগামী ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন গোলাম সারওয়ার। কিংবদন্তি সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:০৪