উপন্যাস " মারিজুয়ানা" পর্ব ১৮
লেখকঃ নুরুন নাহার লিলিয়ান
দুই সপ্তাহ পর ।হঠাৎ এক বিকেলে মারিজুয়ানার মোবাইল কল এল । এর মধ্যে গুঞ্জন নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিল ।ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিষয়ে গুঞ্জন শিক্ষকতা করে । সুন্দরবন থেকে ফিরে আসার পর মারিজুয়ানার সাথে তেমন কোন যোগাযোগ হয়নি । মোবাইল কলটা দেখে গুঞ্জন বেশ খুশি হল ।মারিজুয়ানা মোবাইলে জানাল যে সে গুঞ্জনদের বাসায় আসতে চায় । গুঞ্জন আন্তরিক ভাবেই পরবর্তী বন্ধের দিন আসতে বলল । মোবাইলে আর তেমন কথা হয়নি । তবে কণ্ঠ শুনে বুঝা গেল গলাটা বেশ ভারী । কারও ঠাণ্ডা লাগলে কিংবা কান্না করলে যেমন হয় । ঠিক তেমন অস্থির ভাঙ্গা গলা ।
সেদিন শুক্রবার ।বিকেলের দিকে মারিজুয়ানা আসে ।সাথে নাতালি ও আছে । তাঁরা দুজনেই প্রায় একই রঙের শাড়ি পড়া । দুজনে বেশ গুছিয়ে শাড়ি পড়েছে ।দেখতে ভাল লাগছে । নাতালিকে একদম বাঙালি মনে হচ্ছে । দুজনেই গুঞ্জনের মুখোমুখি সোফায় বসল।গুঞ্জন দুজনকেই জিজ্ঞেস করল ," আপনারা কি পছন্দ করেন চা না কফি?"
মারিজুয়ানা লাজুক ভঙ্গিতে উত্তর দিল,"আরে আমাদের কিছু দিতে হবে না । এখানেই বসেন গল্প করি ,"
গুঞ্জন বলল ," গল্পের সাথে অল্প কিছু তো থাকতে হবে । নয়তো গল্প জমে উঠবে না ।"
মারিজুয়ানা জিজ্ঞেস করল ," ভাইয়া বাসায় নেই ?"
গুঞ্জন বলল ," না । মিশর থেকে এক দল ভিজিটর সায়েন্টিস্ট আসছে । তাদের কে নিয়ে মিটিংয়ে আছে ।"
মারিজুয়ানা আবার জিজ্ঞেস করল ," ভাইয়া কখন ফিরবে ?"
গুঞ্জন স্বাভাবিক ভাবে বলল ," ঠিক বলতে পারছি না । ডিনার করে ফিরবে । আপনারা এতো চিন্তা করবেন না তো । আমি ফ্রি আছি "
মারিজুয়ানা বলল ," তাহলে শাড়ি পড়েন । আমরা ধানমন্ডি লেকে ঘুরতে যাই । "
গুঞ্জন বলল ," সত্যি ?"
নাতালি আন্তরিক ভাবে ভাঙ্গা বাংলায় বলল ,"আপনি ও শাড়ি পড়েন । "
গুঞ্জন লক্ষ্য করল মারিজুয়ানার মুখটা বেশ ক্লান্ত । আর নাতালি শাড়ি পরার আনন্দে উচ্ছ্বসিত । গুঞ্জন জিজ্ঞেস করল ," তাহলে ড্রাইভারকে ফোন করি । কখন বের হতে চাচ্ছেন ?"
মারিজুয়ানা বলল ," আরে আমরা আজকে স্বাধীন ভাবে রিক্সায় ঘুরব । আপনি রেডি হলেই বের হব ।"
গুঞ্জন বলল ," ধানমন্ডি লেকে বিকেলের দিকে গেলে ভাল হত । সব কিছু উপভোগ করা যেতো । এখন সন্ধ্যায় মানুষের ভিড় ছাড়া আর কিছুই নেই ।"
মারিজুয়ানা এবং নাতালি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল । ঠিক বুঝতে পারল না কি করবে । মারিজুয়ানা বলল ," আপনি আগে শাড়ি পড়েন । তারপর দেখা যাক কি করা যায় । "
গুঞ্জন ভেতরে গেল । মারিজুয়ানাদের জন্য চা নাস্তা তৈরি করতে । এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হল । একদম ঝুম বৃষ্টি । তিন জনই মজা পেল । বারন্দায় দাড়িয়ে মে মাসের ঝুম বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগল । দুজনে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে গালে ছুঁয়ে দেখে ।গুঞ্জন সবাইকে সাবধান করল বজ্রপাত সম্পর্কে । ইদানিং আবহাওয়া ভীষণ রকম অভিমানী হয়ে উঠেছে । প্রতিদিন পত্রিকায় বজ্রপাতে মানুষ মারা যাওয়ার খবর ছাপা হয় । খুব চিন্তার বিষয় ।
আগের মতো বৃষ্টির পানিতে দলবেঁধে ভেজা , গোসল করা , কিংবা রিক্সায় ঘুরতে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি আর নেই ।তাছাড়া পরিবারের সবাইকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার সংস্কৃতি অনেক আগেই বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে । মানুষ আজকাল এতো বেশি ব্যস্ত যে পরিবার নিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করার সময় কারও নেই ।
গুঞ্জন ভীষণভাবে স্মৃতিতে আক্রান্ত হল । ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বৃষ্টির দিন গুলোতে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ভ্যান ভাড়া করে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরতো । সে সময় পুরো ক্যাম্পাস কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ্গে পরিবেশ বেশ রক্তিম হয়ে উঠত । বান্ধবিরা হাতে হাত ধরে গান গাইতে গাইতে কৃষ্ণচূড়ার আর বৃষ্টির বিলাসিতায় মেতে উঠত । আহা জীবন!
হঠাৎ মারিজুয়ানার ডাকে তাঁর সম্বিৎ ফিরে এল ।
" ভাবি আসেন আপনাকে আমি শাড়ি পড়িয়ে দেই ।"
গুঞ্জন বলল ," কোন শাড়িটা যে পরব বুঝতে পারছি না ।"
মারিজুয়ানা বলল ," হাল্কা বা রঙিন যেটা আপনার ভাল লাগে ।"
গুঞ্জন দুজন কে চা নাস্তা দিয়ে শাড়ি বের করে নিয়ে এল । শাড়ি পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করল , "
আপনাকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে কেন ?"
মারিজুয়ানা যেন বলার জন্য উদগ্রীব ছিল ।শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বলল ," আমার শাশুড়ি খুব অসুস্থ । কয়দিন পর পর মহিলা অসুস্থ হয় আর আমার উপর দিয়ে ট্রনেডো চলে । সব কাজ তো কাজের লোক করতে পারে না !"
গুঞ্জন জিজ্ঞেস করল ," এখন কেমন আছে ?"
মারিজুয়ানা ভীষণ বিরক্তি আর অভিমান নিয়ে বলল ," এখন ভাল আছে । আরে উনি অসুস্থ হলে কি হবে । মুখের জোর তো কমে না । আমাকে নবাবজাদী আর হারামজাদি ছাড়া কথাই বলে না । প্রচুর বকাবাজি করতেই থাকে । "
গুঞ্জন বলল ," তাহলে খুব খারাপ কথা । অসুস্থ হলে আরও উচিত সবার সাথে ভাল ব্যবহার করা । সবার কাছ থেকে দু'আ নেওয়া । কার হৃদয়ের দু'আ যে কবুল হয় কেউ জানে না ।"
মারিজুয়ানা বলল ," উনি সব ছেলেদের বউদের সাথেই খারাপ ব্যবহার করে । আর প্রচুর অহংকার । সব সময় শফিককে গালি দিতে থাকে নানা রকম বাজে কথা বলবে । "
গুঞ্জন একটু কৌতূহলী হয়ে বলল ," কিছু মনে করবেন না । কি ধরনের বাজে কথা বলে ?"
মারিজুয়ানা বলল ,"শফিকের কান ভারী করতে বলে । আমি অল্প বয়সী । আমি নাকি শফিককের মাথা একশ বার বিক্রি করতে পারব । আমাকে নাকি আমার বাবা মা লোভে বয়স্ক লোকের কাছে বিয়ে দিয়েছে । তাই শফিক কে সব সময় সাবধান করতে থাকে । "
নাতালি গালে হাত দিয়ে মনোযোগ সহকারে কথা বুঝার চেষ্টা করছিল । গুঞ্জনের কথা শোনার স্টাইল দেখে গুঞ্জন হেসে দিল । তারপর জিজ্ঞেস করল ," নাতালি আমাদের সব কথা বুঝেছ ?"
নাতালি লাজুক হাসি দিয়ে ভাঙ্গা বাংলায় বলল ," কিছু কিছু ভাল করে বুঝিনি । তবে মায়ের কষ্টের অনুভূতি গুলো বুঝতে পারি ।"
মারিজুয়ানা কপাল কুঁচকে নাতালিকে দেখিয়ে ইশারা করে বলল ," এই মেয়ে আসার পর আরও ভেজাল বেড়েছে । ওর কথা বিশ্বাস করবেন না । অনেক নাটক আর ন্যাকামি জানে ।"
গুঞ্জন আসতে করে জিজ্ঞেস করল ," আস্তে বলুন । ও বাংলা বুঝে।"
মারিজুয়ানা খুব রাগী একটা মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশ করল । তারপর বলল ," মনেহয় বাপ মাইয়া দুইডারে ভাতে বিষ মিশাইয়া মাইরা ফালাই । আমার জীবনডা তেনা তেনা । এই ঝুলাডা জাপান থন আহার পর জীবনডা এক্কেরে তেজপাতা ।"
গুঞ্জন শুধু হাত দিয়ে তাকে থামতে ইশারা করল । মনে মনে ভাবল মহিলার ভীষণ নিয়ন্ত্রনহীন রাগ আছে ।দেখে বুঝা যায়না । নাতালিকে সে যে সহ্য করতে পারছে না তা একদম পরিস্কার । এটা ও সত্য ডিভোর্সের পর নাতালির মায়ের সাথে বাবার কোন যোগাযোগ ছিল না । বাবার ভালোবাসা পাওয়া নাতালির অধিকার । সে কি তাঁর বাবার কাছে আসবে না ?মারিজুয়ানা রেগে গেলে পটুয়াখালীর ভাষায় বলা শুরু করে । মারিজুয়ানার এই বিষয়টা গুঞ্জন একদম পছন্দ করল না। তার রাগ আর রেগে গিয়ে পটুয়াখালীর ভাষায় কথা বলার স্টাইল দেখে হেসে দিল ।কিন্তু নিজের মনের কথা গুলো বুঝতে দিল না । নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকাল ।
তারপর বলল ,' মনেহচ্ছে আজকে বাইরে আর যাওয়া হবে না । আজকে আপনাদের আমি কোরাল মাছের সাসলিক খাওয়াব । তারচেয়ে বাসায় গল্প করি।"
এতক্ষণে মারিজুয়ানা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে । যাওয়া জন্য পিড়াপীড়ি শুরু করল । গুঞ্জন আন্তরিকতা নিয়েই বলল ,"বৃষ্টির দিন! তিন জন শাড়ি পরেছি । এমন সুন্দর সন্ধ্যা উপভোগ করব না !আরে বসেন তো । "
মারিজুয়ানা বলল ," দেরি হয়ে যাবে । আপনার ভাই রাগ করবে । "
গুঞ্জন দুজনকে বসতে বলে ভেতরে গেল কোরাল মাছের সাসলিক তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে।
চলবে ...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:০২