
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির পরীক্ষাগারে যখন গবেষণা করছি কিভাবে ইদুর H3N2 নামক সোয়াইন-ফ্লু সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, ঠিক তখনই পত্রিকা-টিভিতে একটাই খবর। আর তা হলো ইবোলা ভাইরাস। এ যেন হঠাত মৃত্যুদ্যুতের আবির্ভাব এই ধরাধামে! ইবোলা ভাইরাস এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পরেছে মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনে ৫০ থেকে ৯০ জন্ই মারা যাচ্ছে! সিয়েরা লিওন এবং লায়বেরিয়াতে এখন পর্যন্ত ৩,৪০০ জন লোক মারা গেছে এই ভাইরাস এর সংক্রমনে। শুধুমাত্র সিয়েরা লিয়নেই প্রতি ঘন্টায় পাঁচ জন নতুন করে ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছে! আফ্রিকার গন্ডি পেরিয়ে ইবোলা চলে এসেছে আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াতে। আমেরিকার টেক্সাস এ ইবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি মারা গেছে গতকাল। স্পেইনে আক্রান্ত নার্স মহিলাটির অবস্থাও আশংকাজনক। বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাজ্যেও ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যাবে! বৃটেনের বিমান বন্দরগুলোতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে। যারাই আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসছে তাদের শরীরের তাপমাত্রা বা জ্বর মাপা হচ্ছে। চারদিকে এক ভীতিকর অবস্থা! ইবোলা প্রতিরোধে নেই কোনো যথার্থ চিকিত্সা, প্রতিরোধের জন্য নেই কোনো ভাকসিন!
ইবোলা ভাইরাস কি এবং কতটা ভয়াবহ?
ইবোলা হলো এক ধরনের আর.এন.এ ভাইরাস, আকৃতিতে অতি ক্ষুদ্র পাচ্যানো নালীর মত জীবাণু। আফ্রিকার কঙ্গো দেশের ইবোলা নদীর নাম এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘ইবোলা ভাইরাস’। ইবোলার ভয়ঙ্কর দিকটি হচ্ছে এই ভাইরাসটি সাংঘাতিক সংক্রমক সেই সাথে সাথে মারাত্মক। ইবোলা সংক্রমণ কিন্তু এবারই প্রথম নয়। ১৯৭৬ সালে কঙ্গোতে সর্ব প্রথম ইবোলা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, এবং সেবার সংক্রমিত ৩১৮ জনের মধ্যে ২৮০ জনই মারা যায়, অর্থাত মৃত্যুর হার ছিল ৮৮%। পরবর্তিতে কঙ্গোসহ সুদান, উগান্ডা এবং গেবনে বিভিন্ন ধরনের ইবোলা সংক্রমণ দেখা দেয়। তবে এবারের ইবোলা ভাইরাস সংক্রমনে মৃত্যের হার পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। গত ৩৬ বছরে ইবোলাতে যত লোক না মারা গেছে এবার এক বারেই মারা গেছে তার চয়ে বেশি লোক। এবারের ইবোলা মহামারী আকার ধারণ করেছে।
ইবোলা কি খুবই সক্রামক?
অন্যান্য ফ্লু ভাইরাসের মত ইবোলা কিন্তু বাতাসে ছড়ায় না। ইবোলা রোগীর সাথে সরাসরি সংস্পর্শে না আসলে এ রোগের জীবানু একজন থেকে আরেকজনে সঞ্চালিত হয় না। ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে নিসৃত রস যেমন লালা, থুথ, চোখের পানি, রক্ত এবং বীর্যের মাধমে জীবানু আক্রান্ত দেহ থেকে সুস্থ দেহে সংক্রামিত হয়। যেখানে একজন হামের রোগী মিজেলস ভাইরাস ছড়ায় ১৮ জন সুস্থ দেহে, একজন এইডস রুগী এইচ.এই.ভি ভাইরাস ছড়ায় ৪ জন সুস্থ দেহে, সেখানে একজন ইবোলা রোগী ভাইরাস ছড়ায় মাত্র ২ জন সুস্থ মানুষের মধ্যে।
ইবোলা ভাইরাস এলো কোথা থেকে?
ধারণা করা হয় বাঁদুর হলো ইবোলা ভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট। বাঁদুর থেকে ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পরে বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি প্রভৃতি বন্য প্রাণীতে এবং তারা আক্রান্ত হয়। মানুষ যখন এই আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে আসে তখন তারাও ইবোলাতে আক্রান্ত হয়। এর পর এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে একজন থেকে আরেক জনে। ইবোলা ভাইরাস রোগ থেকে সেরে ওঠার ৭ সপ্তাহ পরেও এক জন পুরুষ তার বীর্যের মাধ্যমে এই রোগের জীবানু ছড়িয়ে দিতে পারে একজন সুস্থ নারীর দেহে।
ইবোলা ভাইরাস রোগের লক্ষণ এবং রোগ নির্ণয় পদ্ধতি:
ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রাথমিক লক্ষণ গুলো অন্যান্য ভাইরাস জনিত রোগের লক্ষণ সমূহের মতোই। যেমন:
১. হঠাত করে শুরু হবে জ্বর, সে সাথে মাথা ব্যথা, গা ব্যথা এবং গলা ব্যথা।
২.এর পর শুরু হবে বমি এবং ডায়রিয়া।
৩. সাথে থাকবে ত্বকে লালচে দাগ।
৪. ধীরে ধীরে কিডনি এবং লিভার অকার্যকর হয়ে পড়বে।
৫. এর সাথে কখনো কখনো দাঁতের মাড়ী থেকে রক্ত পড়তে পারে এবং সেই সাথে পায়খানার সাথে রক্ত।
রোগ নির্ণয় করা হয় লক্ষণ দেখে এবং তা নিশ্চিত করা হয় রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পিসিআর এর মাধ্যমে ইবোলা ভাইরাসের জিন ডিটেকশন এর মাধ্যমে। রক্তে ইবোলা ভাইরাসের এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও রোগ সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়।
চিকিত্সা এবং প্রতিরোধ পদ্ধতি:
দুক্ষজনক হলেও সত্য যে ইবোলা ভাইরাস রোগের কোনো যথাযথ চিকতসা নেই। চিকিত্সা যা দেয়া হয় তা হলো সিমটোম্যাটিক। পানিশুন্যতা রোধে মুখে এবং শিরাপথে স্যালাইন দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো ভ্যাকসিন নেই। তবে দুটি ভ্যাকসিন পরীক্ষা মূলক ভাবে খুব তারাতারিই চালু করা হবে। এখন পর্যন্ত ইবোলা ভাইরাস বিস্তার প্রতিরোধে সবচয়ে শক্তিশালী পদ্ধতি হচ্ছে Containment. রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে সতর্কতার সাথে চিকিত্সা দিতে হবে। চিকিত্সক এবং নার্স দের নিতে হবে অতিরিক্ত প্রটেকটিভ শিল্ড। ইবোলাতে কেও মারা গেলে তার মৃত দেহ সতর্কতার সাথে মাটির অনেক গভীরে পুতে ফেলতে হবে। সর্বপরি এ রোগের বিস্তার প্রতিরোধে সকলের মাঝে জন সচেনতা গড়ে তুলতে হবে।
খোন্দকার মেহেদী আকরাম
শেফিল্ড
১০ অক্টোবর ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ২:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




