somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিন্নরদল ( বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় )

০৪ ঠা জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিন্নরদল
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

পাড়ায় ছ’সাত ঘর ব্রাহ্মণের বাস মোটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধোর করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।
আগেই বলেছি, সকলের অবস্থা খারাপ এবং খানিকটা তার দরুন, খানিকটা অন্য কারণে সকলের চেহারা খারাপ। কিশোরী মেয়েদেরও তেমন লালিত্য নেই মুখে, ছোট ছোট ছেলেরা এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং এমন পাকা পাকা কথা বলে যে, তাদের আর শিশু বা বালক বলে মনে হয় না। কাব্যে বা উপন্যাসে যে শৈশবকালের কতই প্রশস্তি পাঠ করা যায়, মনে হয় সে সব এদের জন্য নয়, এরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে একেবারে প্রবীণত্বে পা দিয়েছে।
পাড়ায় একঘর গৃহস্থ আছে, তারা এখানে থাকে না, তাদের কোঠাবাড়িটা চাবি দেওয়া পড়ে আছে আজ দশ-বারো বছর। এদের মস্তবড় সংসার ছিল, এখন প্রায় সবাই মরে হেজে গিয়ে প্রায় পাঁচটি প্রাণীতে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির বড় ছেলে পশ্চিমে চাকরি করে, মেজ ছেলে কলেজে পড়ে কলকাতায়, ছোট ছেলেটি জন্মাবধি কালা ও বোবা—পিসিমার কাছে থেকে মূকবধির বিদ্যালয়ে পড়ে। বড় ছেলে বিবাহ করেনি, যদিও তার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হয়েছে। সে নাকি বিবাহের বিরোধী, শোনা যাচ্ছে যে এমনিভাবেই জীবন কাটাবে।
পাড়ার মধ্যে এরাই শিক্ষিত ও সচ্ছল অবস্থার মানুষ। সেজন্য এদের কেউ ভালো চোখে দেখে না, মনে মনে সকলেই এদের হিংসে করে এবং বড় ছেলে যে বিয়ে করবে না বলছে, সে সংবাদে পাড়ার সবাই পরম সন্তুষ্ট। যখন সবাই ছোট ও গরিব, তখন একঘর লোক কেন এত বাড় বাড়বে? বড় ছেলে বিয়ে করলেই ছেলেমেয়ে হয়ে জাজ্বল্যমান সংসার হবে দুদিন পরে, সে কেউ সহ্য করতে পারবে না। মেজ ছেলে মোটে কলেজে পড়ছে, এখন সাপ হয় কী ব্যাঙ হয় তার কিছু ঠিক নেই, তার বিষয়ে দুশ্চিন্তার এখনো কারণ ঘটেনি, তবে বয়েসও বেশি নয়।
মজুমদার-বাড়িতে ভাঙা রোয়াকে দুপুরে পাড়ার মেয়েদের মেয়ে-গজালি হয়। তাতে রায়-গিনি্ন, মুখুজ্যে-গিনি্ন, চক্কত্তি-গিনি্ন প্রভৃতি তো থাকেনই, অল্প-বয়সী বৌয়েরা ও মেয়েরাও থাকে। সাধারণত যেসব ধরনের চর্চা এ মজলিসে হয়ে থাকে, তা শুনলে নারীজাতি সম্বন্ধে লিখিত নানা সরল প্রশংসাপূর্ণ বর্ণনার সত্যতার সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ যাঁর উপস্থিত না হবে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন খুব বড় ধরনের অপটিমিস্ট।
আজ দুপুরে যে বৈঠক বসেছে, তাতে আলোচিত বিষয়গুলো থেকে মোটামুটি প্রতিদিনের আলোচনা ও বিতর্কের প্রকৃতি অনুমান করা যেতে পারে।
বোস-গিনি্ন বলছিলেন—আরে বাপু দিচ্ছি তো রোজই, আমার গাছের কাঁটাল খেয়েই তো মানুষ, আমাদের যখন কাঁটাল পাড়ানো হয়, ছেলেমেয়েগুলো হ্যাংলার মতো তলায় দাঁড়িয়ে থাকে—ঘেয়ো কী ভুয়ো এক-আধখানা যদি থাকে তো বলি, যা নিয়ে যা। তোদের নেই, যা খেগে যা। তা কি পোড়ার মুখে কোনো দিন সুবাক্যি আছে? ওমা, আজ আমার মেয়ে দুটো নেবু তুলতে গিয়েছে ডোবার ধারের গাছে, তা বলে কি না রোজ নেবু তুলতে আসে, যেন সরকারি গাছ পড়ে রয়েছে আরকি—চব্বিশ ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিলে মন্টুর মা। আচ্ছা বলো তো তোমরাই—
মন্টুর মা—যাঁকে উদ্দেশ করে এ কথা বলা হচ্ছিল, তিনি এঁদের মজলিসে কেবল আজই অনুপস্থিত আছেন নইলে রোজই এসে থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে সবাই তাঁর চালচলন, ধরন-ধারণ, রীতি-নীতির নানারূপ সমালোচনা করল।
প্রিয় মুখুজ্যের মেয়ে শান্তি—ষোল-সতেরো বছরের কুমারী—তার মায়ের বয়সী মন্টুর মায়ের সম্বন্ধে অমনি বলে বসল—ওঃ, সে কথা আর বোলো না খুড়িমা, কী ব্যাপক মেয়েমানুষ ওই মন্টুর মা। ঢের ঢের মেয়েমানুষ দেখিচি, অমন লঙ্কাপোড়া ব্যাপক যদি কোথাও দেখে থাকি, ক্ষুরে নমস্কার, বাবা বাবা!
ছোট মেয়ের ওই জ্যাঠামি কথার জন্য তাকে কেউ বকলে না বা শাসন করলে না, বরং কথাটা সকলেই উপভোগ করলে।
তারপর কথাটার স্রোত আরো কত দূর গড়াত বলা যায় না, এমন সময় রায়-বাড়ির বড়বৌ হঠাৎ মনে-পড়ার ভঙ্গিতে বললেন—হাঁ, একটা মজার কথা শোনোনি বুঝি। শ্রীপতি যে বিয়ে করেছে, বটঠাকুরের কাছে চিঠি এসেচে, শ্রীপতির মামা লিখেচে।
সকলে সমস্বরে বলে উঠল—শ্রীপতি বিয়ে করেচে!
তারপর সকলেই একসঙ্গে নানারূপ প্রশ্ন করতে লাগল :
—কোথায়, কোথায়?
—কবে চিঠি এলো?
—তবে যে শুনলাম শ্রীপতি বিয়ে করবে না বলেচে।
শ্রীপতির বিয়ের খবরে অনেকেই যেন একটু দমে গেল। খবরটা তেমন শুভ নয়। কারো উন্নতির সংবাদ এদের পক্ষে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা অসম্ভব। তাদের যখন উন্নতি হলো না, তখন অপরের উন্নতি হবে কেন? কিন্তু এরপরেই যখন রায়-বৌ মুখ টিপে হেসে আস্তে আস্তে বললেন—বৌটি নাকি বামুনের মেয়ে নয়—তখন সকলে খাড়া হয়ে সটান উঠে বসল, তাদের মরা-মরা ভাবটা এক মুহূর্তে গেল কেটে। একটা বেশ সরস ও মুখরোচক পরনিন্দা আর ঘোঁটের আভাস ওরা পেলে, রায়-বৌয়ের চাপা ঠোঁটের হাসি থেকে।
শান্তি উৎসুক চোখে চেয়ে হাসিমুখে বললে—ভেতরে তাহলে অনেকখানি কথা আছে!
বোস-গিনি্ন বললেন—তাই বল! নইলে এমনি কোথাও কিছু নয় শ্রীপতি বিয়ে করলে, এ কি কখনো হয়। কি জাত মেয়েটার? হিঁদু তো?
অর্থাৎ তাহলে রগড়টা আরো জমে। রায়বৌ বললেন—হিঁদুই, মেয়েটা বদ্দি বামুন।
এদেশে বৈদ্যকে বলে থাকে ‘বদ্দি বামুন’—এ অঞ্চলের ত্রিসীমানায় বৈদ্যের বাস না থাকায় বৈদ্যজাতির সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে এদের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। কারো বিশ্বাস ব্রাহ্মণের পরেই বৈদ্যের সামাজিক স্থান, তারা একপ্রকারের নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ, তার চেয়ে নিচু নয়—আবার কারো বিশ্বাস তাদের স্থান সমাজের নিম্নতর ধাপের দিকে।
শান্তি বললে—বৌয়ের বয়েস কত?
ওঃ, তা অনেক। শুনচি চব্বিশ-পঁচিশ—
সকলে সমস্বরে আবার একটা বিস্ময়ের রোল তুললে। চব্বিশ-পঁচিশ বছর পর্যন্ত মেয়ে আইবুড়ো থাকে ঘরে! এ আবার কোথাকার ছোট জাত, রামোঃ। ছিঃ—
শান্তির মা বললেন—তাহলে মেয়ে আর নয়, মাগী বল! পাঁড় শসা—বাপ-মা বুঝি ঘরে বীজ রেখেছিল!
কে একজন মুখ টিপে হেসে বললেন—বিধবা না তো?
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে কিছু আছে নাকি মাগীর!
এ কথায় শান্তিই আগে মুখে আঁচল দিয়ে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল—তারপরে বাকি সকলে তার সঙ্গে যোগ দিলে। হ্যাঁ, এটা একটা নতুন ও ভারি মজার খবর বটে, মেয়ে-গজালির কিছুদিনের মতো খোরাক সংগ্রহ হলো। আমচুরি কাঁটালচুরির গল্প একটু একঘেঁয়ে হয়ে পড়েছিল।
ঠিক পরের দিনই এক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। শ্রীপতির মেজ ভাই উমাপতি গাঁয়ে এসে বাড়ির চাবি খুলে লোক লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লাগল। তার দাদা বৌদিদিকে নিয়ে শীগ্গির আসবে এবং কিছুদিন নাকি গাঁয়েই বাস করবে। বৌদিদি পাড়াগাঁ কখনো দেখেননি,—গ্রামে আসবার তাঁর খুব আগ্রহ। তার দাদাও কলকাতায় বদলি হবার চেষ্টা করছে।
মেয়ে মজলিসে সবাই তো অবাক। শ্রীপতি কোন্ মুখে অজাতের বউ নিয়ে গাঁয়ে এসে উঠবে। মানুষের একটা লজ্জা-শরমও তো থাকে, করেই ফেলেছিস না হয় একটা অকাজ। এসব কি খিরিস্টানি কাণ্ডকারখানা, কালে কালে হলো কী! আর সে ধিঙ্গি মাগীটারই বা কী ভরসা, ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্মণপাড়ায় বিয়ের বউ সেজে সে কোন সাহসে আসবে।
শ্রীপতি অবিশ্যি বৌ নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে আসার বিষয়ে এঁদের মত জিজ্ঞাসা করেনি। একদিন একখানা নৌকো এসে গ্রামের ঘাটে দুপুরের সময় লাগল এবং নৌকো থেকে নামল শ্রীপতি, তার নববিবাহিত বধূ, একটা ছোক্রা চাকর ও দুটি ট্রাঙ্ক ও একটা বড় বিছানার মোট, একটা ঝুড়ি-বোঝাই টুকিটাকি জিনিস। ঘাটে দু-একজন যারা অত বেলায় স্নান করছিল, তারা তখুনি পাড়ার মধ্যে গিয়ে খবরটা সবাইকে বললে। তখন কিন্তু কেউ এলো না, অত বেলায় এখন শ্রীপতিদের বাড়ি গেলে তাদের খেতে বলতে হয়। অসময়ে এখন এসে তারা রান্নাবান্না চড়িয়ে খাবে, সেটা প্রতিবেশী হয়ে হতে দেওয়া কর্তব্য নয়, সুতরাং সে ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে করবার চেয়ে এখন না যাওয়াই বুদ্ধির কাজ।
কিন্তু রাসু চক্কতি আর প্রিয় মুখুজ্যের বাড়ির মেয়েরা অত সহজেই রেহাই পেলেন না। শ্রীপতি নিজে গিয়ে একেবারে অন্তঃপুরের মধ্যে ঢুকে বললে—ও পিসিমা, ও বৌদিদি, আপনারা আপনাদের বৌকে হাতে ধরে ঘরে না তুললে কে আর তুলবে? আসুন সবাই। বাধ্য হয়ে কাছাকাছির দু-তিন বাড়ির মেয়েরা শাঁক হাতে, জলের ঘটি হাতে নতুন বৌকে ঘরে তুলতে এলেন—খানিকটা চক্ষুলজ্জায়, খানিকটা কৌতূহলে। মজা দেখবার প্রবৃত্তি সকলের মধ্যেই আছে। ছোটবড় ছেলেমেয়েও এলো অনেকে, শান্তি এলো, কমলা এলো, সারদা এলো।
শ্রীপতিদের বাড়ির উঠোনে লিচুতলায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দূর থেকে মেয়েটির ধপ্ধপে ফর্সা গায়ের রং ও পরনের দামি সিল্কের শাড়ি দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। সামনে এসে আরো বিস্মিত হবার কারণ ওদের ঘটল—মেয়েটির অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী দেখে। কী ডাগর ডাগর চোখ! কী সুকুমার লাবণ্য সারা অঙ্গে। সর্বোপরি মুখশ্রী—অমন ধরনের সুন্দর মুখ এসব পাড়াগাঁয়ে কেউ কখনো দেখেনি।
সকলে আশা করেছিল গিয়ে দেখবে কালো কালো একটা মোটা-মতো মাগী আধ-ঘোমটা দিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে চেয়ে রয়েছে ওদের দিকে। কিন্তু তার পরিবর্তে দেখল, এক নম্রমুখী সুন্দরী তরুণী মূর্তি…। মুখখানি এত সুকুমার যে, মনে হয় ষোল-সতেরো বছরের বালিকা।
বিকেলে ওপাড়ার নিতাই মুখুজ্যের বৌ ঘাটের পথে চক্কত্তি-গিনি্নকে জিজ্ঞেস করলেন—কী দিদি, শ্রীপতির বৌ দেখলে নাকি? কেমন দেখতে?
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—না, দেখতে বেশ ভালোই—
চক্কত্তি-গিন্নির সঙ্গে শান্তি ছিল, সে হাজার হোক ছেলেমানুষ, ভালো লাগলে পরের প্রশংসার বেলায় সে এখনো কার্পণ্য করতে শেখেনি, সে উচ্ছ্বসিত সুরে বলে উঠলে—চমৎকার, খুড়িমা, একবার গিয়ে দেখে আসবেন, সত্যিই অদ্ভুত ধরনের ভালো।
নিতাই মুখুজ্যের বৌ পরের এতখানি প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন না—বুঝতে পারলেন না শান্তি কথাটা ব্যঙ্গের সুরে বলছে, না সত্যিই বলছে। বললেন—কী রকম ভালো?
এবার চক্কত্তি-গিনি্ন নিজেই বললেন—না, বৌ যা ভেবেছিলাম তা নয়। বৌটি সত্যিই দেখতে ভালো। আর কেনই বা হবে না বলো শহরের মেয়ে, দিনরাত সাবান ঘষছে, পাউডার ঘষছে, তোমার-আমার মতো রাঁধতে হতো, বাসন মাজতে হতো, তো দেখতাম চেহারার কত জলুস বজায় রাখে।
এই বয়সে তো দূরের কথা, তাঁর বিগত যৌবন দিনেও অজস্র পাউডার সাবান ঘষলেও যে কখনো তিনি শ্রীপতির বৌয়ের পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারতেন না—চক্কত্তি-গিন্নির সম্বন্ধে শান্তির একথা মনে হলো। কিন্তু চুপ করে রইল সে।
বিকেলে এ-পাড়ার ও-পাড়ার মেয়েরা দলে দলে বৌ দেখতে এলো। অনেকেই বললে, এমন রূপসী মেয়ে তারা কখনো দেখেনি। কেবল হরিচরণ রায়ের স্ত্রী বললেন—আর বছর তারকেশ্বরে যাবার সময় ব্যান্ডেল স্টেশনে তিনি একটি বৌ দেখেছিলেন, সেটি এর চেয়েও রূপসী।
মেয়ে-মজলিসে পরদিন আলোচনার একমাত্র বিষয় দাঁড়াল শ্রীপতির বউ। দেখা গেল তার রূপ সম্বন্ধে দু-মত নেই সভ্যদের মধ্যে, কিন্তু তার চরিত্র সম্বন্ধে নানারকম মন্তব্য অবাধে চলেছে।
—ধরন-ধারণ যেন কেমন-কেমন—অত সাজগোজ কেন রে বাপু?
—ভালো ঘরের মেয়ে নয়। দেখলেই বোঝা যায়—
—বাসন মাজতে হলে ও-হাত আর বেশিদিন অত সাদাও থাকবে না, নরমও থাকবে না।
—ঠ্যালা বুঝবেন পাড়াগাঁয়ের। গলায় নেক্লেস ঝুলুতে আমরাও জানি—
—বেশ একটু ঠ্যাকারে। পাড়াগাঁয়ে মাটিতে যেন গুমরে পা পড়ছে না, এমনি ভাব। বামুনের ঘরে বিয়ে হয়ে ভাবছে যেন কী—
—তা তো হবেই, বদ্দি বামুনের মেয়ে, বামুনের ঘরে এসেছে, ওর সাত-পুরুষের সৌভাগ্যি না?
নববধূর স্বপক্ষে বললে কেবল শান্তি ও কমলা। শান্তি ঝাঁজের সঙ্গে বললে—তোমরা কারো ভালো দেখতে পার না বাপু! কেন ওসব বলবে একজন ভদ্দর ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে? কাল বিকেলে আমি গিয়ে কতক্ষণ ছিলাম নতুন বৌয়ের কাছে। কোনো ঠ্যাকার নেই, অহংকার নেই, চমৎকার মেয়ে!
কমলা বললে—আমাদের উঠতে দেয় না কিছুতেই—কত গল্প করলে, খাবার খেতে দিলে, চা করলে—আর, খুব সাজগোজ কি করে? সাদাসিধে শাড়ি সেমিজ পরে তো ছিল। তবু খুব ফর্সা কাপড়চোপড়—ময়লা একেবারে দুচোখে দেখতে পারে না—
শান্তি বললে—ঘরগুলো এরই মধ্যে কী চমৎকার সাজিয়েছে! আয়না, পিক্চার, দোপাটি ফুলের তোড়া বেঁধে ফুলদানিতে রেখে দিয়েছে—শ্রীপতিদার বাপের জন্মে কখনো অমন সাজানো ঘরদোরে বাস করেনি—ভারি ফিটফাট গোছালো বৌটি—
দিন দুই পরে ডোবার ঘাটে নববধূকে একরাশ বাসন নিয়ে নামতে দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। চারদিকে বনে ঘেরা ঝুপসি আধ-অন্ধকার ডোবাটা যেন মেয়েটির স্নিগ্ধ রূপের প্রভায় এক মুহূর্তে আলো হয়ে উঠল, একথা যারা তখন ডোবার অন্যান্য ঘাটে ছিল, সবাই মনে মনে স্বীকার করলে। দৃশ্যটাও যেন অভিনব ঠেকলে সকলের কাছে, এমন একটা পচা এঁদো জঙ্গলে ভরা পাড়াগেঁয়ে ডোবার ঘাটে সাধারণত কালো কালো, আধ-ময়লা শাড়িপরা শ্রীহীনা ঝি-বৌ বা ত্রিকালোত্তীর্ণ প্রৌঢ়া বিধবাদের গামছা-পরিহিতা মূর্তিই দেখা যায়, বা দেখার আশা করা যায়—সেখানে এমন একটি আধুনিক ছাঁদে খোঁপা বাঁধা, ফর্সা শাড়ি ব্লাউজ-পরা, রূপকথার রাজকুমারীর মতো রূপসী, নব-যৌবনা বধূ সজনেতলার ঘাটে বসে ছাই দিয়ে নিটোল সুগৌর হাতে বাসন মাজছে, এ দৃশ্যটা খাপ খায় না। সকলের কাছেই এটা খাপছাড়া বলে মন হলো। প্রৌঢ়ারাও ভেবে দেখলে গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি এই ক্ষুদ্র ডোবার ইতিহাসে।
রায়পাড়ার একটি প্রৌঢ়া বললেন—আ-হা, বৌ তো নয়, যেন পিরতিমে—কিন্তু অত রূপ নিয়ে কি এই ডোবায় নামে বাসন মাজতে! না ও হাতে কখনোই ছাই দিয়ে বাসন মাজা অভ্যেস আছে! হাত দেখেই বুঝেছি।
তার পর থেকে দেখা গেল ঘর-সংসারের যা কিছু কাজ শ্রীপতির বৌ সব নিজের হাতে করছে।
ইতিমধ্যে শ্রীপতির কলকাতায় বদলি হবার খবর আসতে সে চলে গেল বাড়ি থেকে। পাড়ার মেয়েদের মধ্যে শান্তি ও কমলা শ্রীপতির বৌয়ের বড় ন্যাওটা হয়ে পড়ল। সকাল নেই বিকেল নেই, সব সময়েই দেখা যায় শান্তি ও কমলা বসে আছে ওখানে।
পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মেয়ে, অমন আদর করে কেউ কখনো রোজ রোজ ওদের লুচি-হালুয়া খেতে দেয়নি।
একদিন কমলা বলে—বৌদিদি, তোমার ঘরে কাপড়-মোড়া ওটা কী?
শ্রীপতির বৌ বলল, ওটা এসরাজ।
—বাজাতে জানো বৌদি?
—একটুখানি অমনি জানি ভাই, কিন্তু এ্যাদ্দিন ওকে বার পর্যন্ত করিনি। কেন জানো গাঁয়েঘরে কে কী হয়তো মনে করবে।
শান্তি বলল, নিজের বাড়ি বসে বাজাবে, কে কী মনে করবে? একটু বাজিয়ে শোনাও না, বৌদি!
একটু পরে রায়-গিন্নি ঘাটে যাবার পথে শুনতে পেলেন বাড়ির মধ্যে কে বেহালা না কী বাজাচ্ছে, চমৎকার মিষ্টি। কোনো ভিখিরি গান গাচ্ছে বুঝি? দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুনে তিনি ঘাটে চলে গেলেন।
ঘাটে গিয়ে তিনি মজুমদার-বৌকে বললেন কথাটা।
ওই শ্রীপতির বাড়ি কে একজন বোষ্টম বেহালা বাজাচ্ছে শুনে এলাম। কী চমৎকার বাজাচ্ছে দিদি, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।
দুপুরের মেয়ে-মজলিশে শান্তির মা বললেন—শ্রীপতির বৌ চমৎকার বাজাতে পারে, এসরাজ না কী বলে, এ রকম বেহালার মতো। শান্তিদের ওবেলা শুনিয়েছিল—
রায়-বৌ বললেন, ও! তাই ওবেলা নাইতে যাবার সময় শুনলাম বটে। সে যে ভারি চমৎকার বাজনা গো, আমি বলি বুঝি কোনো ফকির বোষ্টম ভিক্ষে করতে এসে বাজাচ্ছে।
এমন সময় শান্তি আসতেই তার মা বললেন, ওই জিজ্ঞেস কর না শান্তিকে।
শান্তি বলল, উঃ, সে আর তোমায় কী বলব খুড়িমা, বৌদিদি যা বাজাল, অমন কখনো শুনিনি—শুনবে তোমরা? তাহলে এখন বলি বাজাতে—বললেই বাজাবে।
শান্তি শ্রীপতিদের বাড়ি চলে যাবার অল্প পরেই শোনা গেল শ্রীপতির বৌয়ের এসরাজ বাজনা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কথা রইল না।
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আহা, বড় চমৎকার বাজায় তো!
সকলেই স্বীকার করল শ্রীপতির বৌকে আগে যা ভাবা গিয়েছিল, সে-রকম নয়, বেশ মেয়েটি।
এসরাজ বাজনার মধ্য দিয়ে পাড়ার সকলের সঙ্গে শ্রীপতির বৌয়ের সহজভাবে আলাপ পরিচয় জমে উঠল। দুপুরে, সন্ধ্যায় প্রায়ই সবাই যায় শ্রীপতিদের বাড়ি বাজনা শুনতে।
তারপর গান শুনল সবাই একদিন। পূর্ণিমার রাত্রে জ্যোৎস্নাভরা ভেতর-বাড়ির রোয়াকে বসে বৌ এসরাজ বাজাচ্ছিল, পাড়ার সব মেয়েই এসে জুটেছে। শ্রীপতি বাড়ি নেই।
কমলা বলল, আজ বৌদি একটা গান গাইতেই হবে—তুমি গাইতেও জানো ঠিক—শোনাও আজকে।
বৌদি হেসে বলল, কে বলেছে ঠাকুরঝি আমি গাইতে জানি?
—না, ওসব রাখো—গাও একটা।
সকলেই অনুরোধ করল। বলল, গাও বৌমা, এ পাড়ায় মানুষ নেই, আস্তে আস্তে গাও, কেউ শুনবে না।
শ্রীপতির বৌ একখানা মীরার ভজন গাইল।
রাণাজি, ম্যায় গিরধর কে ঘর যাঁহু
গিরধর মেরা সাচো প্রিতম্ দেখত রূপ লুভাঁউ।
গায়িকার চোখে-মুখে কী ভক্তিপূর্ণ তন্ময়তার শোভা ফুটে উঠল গানখানা গাইতে গাইতে—শান্তি একটা গন্ধরাজ আর টগরের মালা গেঁথে এনেছিল বৌদিদিকে পরাবে বলে—গান গাইবার সময়ে সে আবার সেটা বৌয়ের গলায় আলগোছে পরিয়ে দিল—সেই জ্যোৎস্নায় সাদা সুগন্ধি ফুলের মালা গলায় রূপসী বৌয়ের মুখে ভজন শুনতে শুনতে মন্টুর মায়ের মনে হলো এই মেয়েটিই সেই মীরাবাই, অনেককাল পরে পৃথিবীতে আবার নেমে এসেছে, আবার সবাইকে ভক্তির গান গেয়ে শোনাচ্ছে।
মন্টুর মা একটু বাইরের খবর রাখতেন, যাত্রায় একবার মীরাবাই পালা দেখেছিলেন তার বাপের বাড়ির দেশে।
তারপর আর একখানা হিন্দিগান গাইল বৌ, এঁরা অবিশ্যি কিছু বুঝলেন না। তবে তন্ময় হয়ে শুনলেন বটে।
তারপর একখানা বেহাগ। বাংলা গান এবার। সকলে শুয়ে পড়ল। শান্তির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। অনেকে দেখল বৌয়েরও চোখ দিয়ে জল পড়ছে গান গাইতে গাইতে—রূপসী গায়িকা একেবারে যেন বাহ্যজ্ঞান ভুলে গিয়েছে গানে তন্ময় হয়ে।
সেদিন থেকেই সকলে শ্রীপতির বৌকে অন্য চোখে দেখতে লাগল।
ওর সম্বন্ধে ক্রমে উচ্চ ধারণা করতে সকলে বাধ্য হলো আরো নানা ঘটনায়। পাড়াগাঁয়ে সকলেই বেশ হুঁশিয়ার, এ কথা আগেই বলেছি। ধার দিয়ে—সে যদি এক খুঁচি চাল কি দু পলা তেলও হয়—তার জন্যে দশবার তাগাদা করতে এদের বাধে না। কিন্তু দেখা গেল শ্রীপতির বৌ সম্পূর্ণ দিলদরিয়া মেজাজের মেয়ে। দেবার বেলায় সে কখনো না বলে কাউকে ফেরায় না, যদি জিনিসটা তার কাছে থাকে। একেবারে মুক্তহস্ত সে বিষয়ে—কিন্তু আদায় জানে না, তাগাদা করতে জানে না, মুখে তার রাগ নেই, বিরক্তি নেই, হাসিমুখ ছাড়া তার কেউ কখনো দেখেনি।
শ্রীপতির বৌয়ের আপন-পর জ্ঞান নেই, এটাও সবাই দেখল। পাশের বাড়িতে চক্কত্তি-গিন্নি বিধবা, একাদশীর দিন দুপুরে তিনি নিজের ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন, শ্রীপতির বৌ এক বাটি তেল নিয়ে এসে তাঁর পায়ে মালিশ করতে বসে গেল। যেন ও তাঁর নিজের ছেলের বৌ।
চক্কত্তি-গিন্নি একটু অবাক হলেন প্রথমটা। পাড়াগাঁয়ে এ রকম কেউ করে না, নিজের ছেলের বৌয়েই করে না তো অপরের বৌ।
—এসো, এসো মা আমার এসো। থাক থাক, তেল মালিশ আবার কেন মা? তোমায় ওসব করতে হবে না, পাগলি মেয়ে—
এই পাগলি মেয়েটি কিন্তু শুনল না। সে জোর করেই বসে গেল তেল মালিশ করতে। মাথার চুল এসে অগোছালোভাবে উড়ে এসেছে মুখে, সুগৌর মুখে অতিরিক্ত গরমে ও শ্রমে কিছু কিছু ঘাম দেখা দিয়েছে—চক্কত্তি-গিন্নি এই সুন্দরী বৌটির মুখ থেকে চোখ যেন অন্যদিকে ফেরাতে পারলেন না। বড় স্নেহ হলো এই আপন-পর জ্ঞানহারা মেয়েটার ওপর।
ইতিমধ্যে কমলার বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ে সে শ্রীপতির বৌয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, বৌদিদি, তোমায় কী করে ছেড়ে থাকব, ভাই? মাকে ছেড়ে যেতে কত কষ্ট না হচ্ছে, তত হচ্ছে তোমায় ছেড়ে যেতে।…এই এক ব্যাপার থেকেই বোঝা যাবে শ্রীপতির বৌ এই অল্প কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামের তরুণ মনের কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল।
পূজার সময় এসে পড়েছে। আশ্বিনের প্রথম, শরতের নীল আকাশে অনেক দিন পরে সোনালি রোদের মেলা, বনশিমের ফুল ফুটেছে ঝোপে ঝোপে, নদীর চরে কাশফুলের শোভা। পাশের গ্রাম সত্রাজিৎপুরে বাঁড়ুজ্যে-বাড়ি পুজো হয় প্রতিবছর, এবারও শোনা যাচ্ছে মহানবমীর দিন তাদের বাড়ি আর বছরের মতো যাত্রা হবে কাঁচড়াপাড়ার দলের।
শ্রীপতির বৌ গান-পাগলা মেয়ে, এ কথাটা এত দিনে এ গাঁয়ের সবাই জেনেছে। তার দিন নেই, রাত নেই, গান লেগে আছে, দুপুরে রাত্রে রোজ এসরাজ বাজায়। গান সম্বন্ধে কথা সর্বদা তার মুখে। শান্তির এখনো বিয়ে হয়নি; যদিও সে কমলার বয়সী। সে শ্রীপতির বৌয়ের কাছে আজকাল দিনরাত লেগে থাকে গান শেখবার জন্যে।
একদিন শ্রীপতির বৌ তাকে বলল, ভাই শান্তি, এক কাজ করবি, সত্রাজিৎপুরে তো যাত্রা হবে বলে সবাই নেচেছে। আমাদের পাড়ার মেয়েরা তো আর দেখতে পাবে না? তারা কি আর অপর গাঁয়ে যাবে যাত্রা শুনতে? অথচ এরা কখনো কিছু শোনে না—আহা! এদের জন্যে যদি আমরা আমাদের পাড়াতেই থিয়েটার করি?
শান্তি তো অবাক। থিয়েটার? তাদের এই গাঁয়ে? থিয়েটার জিনিসটার নাম শুনেছে বটে সে, কিন্তু কখনো দেখেনি। বলল, কী করে করবে, বৌদি কী যে তুমি বলো। তুমি একটা পাগল।
শ্রীপতির বৌ হেসে বলল, সেসব বন্দোবস্ত আমি করব এখন। তোকে ভেবে মরতে হবে না—দ্যাখ না কী করি।
সপ্তাহখানেক পর শ্রীপতি যেমন শনিবারের দিন বাড়ি আসে তেমনি এলো। সঙ্গে তিনটি বড় মেয়ে ও দুটি ছোট মেয়ে ও চার-পাঁচটি ছেলে। বড় মেয়ে তিনটির ষোলো-সতেরো এমনি বয়স, সকলেই ভারি সুন্দরী, ছোট মেয়ে দুটির মধ্যে যেটির বয়স তেরো, সেটি তত সুবিধে নয়, কিন্তু যেটির বয়স আন্দাজ দশ—তাকে দেখে রক্তমাংসের জীব বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন মোমের পুতুল। ছেলেদের বয়স পনেরোর বেশি নয় কারো। সকলেই সুবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
শান্তি, শান্তির মা এবং চক্কত্তি-গিন্নি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। শ্রীপতির বৌ ওদের দেখে ছুটে গেল রোয়াক থেকে উঠোনে নেমে। উচ্ছ্বসিত আনন্দের সুরে বলল, এই যে রমা, পিন্টু, তারা, এই যে শিব, আয় আয় সব কেমন আছিস? ওঃ কত দিন দেখিনি তোদের—
রমা বলে ষোলো-সতেরো বছরের সুন্দরী মেয়েটি ওর গলা জড়িয়ে ধরল, সকলেই ওকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিল।
—দিদি কেমন আছিস, ভাই—
—একটু রোগা হয়ে গেছিস দিদি—
—ওঃ, কত দিন যে তোকে দেখিনি—
—দাদাবাবু যখন বললেন তোর এখানে আসতে হবে, আমরা তো—
—আহিরীটোলাতে মিউজিক কম্পিটিশন ছিল—নাম দিয়েছিলাম—ছেড়ে চলে এলাম—
মেয়েগুলোর মুখ, রং, গড়ন শ্রীপতির বৌয়ের মতো। রমা তো একেবারে হুবহু ওর মতো দেখতে, কেবল যা কিছু বয়সের তফাত। জানা গেল মেয়ে দুটির মধ্যে রমা ও তার ছোট সতী, এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে বারো বছরের ফুটফুটে ছেলে শিবু শ্রীপতির বৌয়ের আপন ভাইবোন, বাকি সবই কেউ খুড়তুতো, কেউ জ্যাঠাতুতো ভাইবোন।
ক্রমে আরো জানা গেল শ্রীপতির বৌ এদের চিঠি লিখিয়ে আনিয়েছে থিয়েটার করানোর জন্যে।
পাড়ার সবাই এদের রূপ দেখে অবাক। এসব পাড়াগাঁয়ে অমন চেহারার ছেলেমেয়ে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। দশ বছরের সেই ছেলেটির নাম পিন্টু, সে শান্তির বড় ন্যাওটা হয়ে গেল। সে আবার একটা সাঁতার দেবার নীল রঙের পোশাক এনেছে, সিক্ত নীল পোশাক সুগৌর দেহে যখন সে নদীর ঘাটে স্নান করে উঠে দাঁড়ায়—তখন ঘাটসুদ্ধ মেয়েরা, বোস-গিন্নি, মন্টুর মা, শান্তির মা, মজুমদার-গিন্নি ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। রূপ আছে বটে ছেলেটির! শান্তি দস্তুর মতো গর্ব অনুভব করে, যখন পিন্টু অনুযোগ করে বলে, আঃ শান্তিদি, আসুন না উঠে, ভিজে কাপড়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? আসুন বাড়ি যাই।
পূজা এসে পড়ল। এ-গাঁয়ে কোনো উৎসব নেই পূজার, গরিবদের গাঁয়ে পূজা কে করবে? দূর থেকে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির ঢাক শুনেই গাঁয়ের মেয়েরা সন্তুষ্ট হয়। ভিনগাঁয়ে গিয়ে মেয়েদের পূজা দেখবার রীতি না থাকায় অনেকে দশ-পনেরো কি বিশ বছর দুর্গাপ্রতিমা পর্যন্ত দেখেনি। মেয়েদের জীবনে কোনো উৎসব-আমোদ নেই এ গাঁয়ে।
শ্রীপতির বৌ তাই একদিন শান্তিকে বলেছিল, সত্যি কী করে যে তোরা থাকিস ঠাকুরঝি—একটু গান নেই, বাজনা নেই, বই পড়া নেই, মানুষ যে কেমন করে থাকে এমন করে।
বোধ হয় সেই জন্যেই এত উৎসাহের সঙ্গে ও লেগেছিল থিয়েটারের ব্যাপারে।
শ্রীপতিদের বাড়ির লম্বা বারান্দায় একধাপে তক্তপোশ পেতে দড়ি টাঙিয়ে হলদে শাড়ি ঝুলিয়ে স্টেজ করা হয়েছে।
শ্রীপতির বৌ ভাইবোনদের নিয়ে সকাল থেকে খাটছে।
শান্তি বলল, তুমি এত জানলে কী করে, বৌদি।
রমা বলল, তুমি জানো না দিদিকে শান্তিদিদি। দিদি অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে—
শ্রীপতির বৌ ধমক দিয়ে বোনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, নে, নে—যা, অনেক কাজ বাকি, এখন তোর অত বক্তৃতা করতে হবে না দাঁড়িয়ে—
রমা না থেমে বলল, আর খুব ভালো পার্ট করার জন্যেও সোনার মেডেল পেয়েছে…।
যতবার পয়লা বোশেখের দিন আমাদের বাড়িতে থিয়েটার হয়, দিদিই তো তার পাণ্ডা—জানো আমাদের কি নাম দিয়েছেন জ্যাঠামশায়?
শ্রীপতির বৌ বলল, আবার?
রমা হেসে থেমে গেল।
মহাষ্টমীর দিন আজ। শুধু মেয়েদের আর ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে থিয়েটার দেখবে। শুধু মেয়েরাই—সমস্ত পাড়া কুড়িয়ে সব মেয়ে এসে জুটেছে থিয়েটার দেখতে।
ছোট্ট নাটকটি। শ্রীপতির বৌয়ের জ্যাঠামশায়ের নাকি লেখা। রাজকুমারকে ভালোবেসেছিল তাঁরই প্রাসাদের একজন পরিচারিকার মেয়ে। ছেলেবেলায় দুজনে খেলা করেছে। বড় হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরুলেন রাজপুত্র, অন্য দেশের রাজকুমারী ভদ্রাকে বিবাহ করে ফিরলেন। পরিচারিকার মেয়ে অনুরাধা তখন নব-যৌবনা কিশোরী, বিকশিত মলি্লকা-পুষ্পের মতো শুভ্র, পবিত্র। খুব ভালো নাচতে-গাইতে শিখেছিল সে ইতিমধ্যে। রাজধানীর সবাই তাকে চেনে, জানে—নৃত্যের অমন রূপ দিতে কেউ পারে না। এদিকে ভদ্রাকে রাজ্যে এনে রাজকুমার এক উৎসব করলেন। সে সভায় অনুরাধাকে নাচতে-গাইতে হলো রাজপুত্রের সামনে ভাড়া করা নর্তকী হিসেবে। তার বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ সে একটা কথাও বলল না, নৃত্যের মধ্য দিয়ে সংগীতের মধ্য দিয়ে জীবনের ব্যর্থ প্রেমের বেদনা সে নিবেদন করল প্রিয়ের উদ্দেশে। এর পরে কাউকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে পরদিন একা একা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
শ্রীপতির বৌ অনুরাধা, রমা ভদ্রা। ওর অন্য সব ভাই-বোনও অভিনয় করল। শ্রীপতির বৌ বেশভূষায়, রূপে, গলে দোদুল্যমান জুঁইফুলের মালায় যেন প্রাচীন যুগের রূপকথার রাজকুমারী, রমাও তাই, গানে গানে অনুরাধা তো স্টেজ ভরিয়ে দিল, আর কী অপূর্ব নৃত্যভঙ্গি! সতী, রমা, পিন্টুও কি চমৎকার অভিনয় করল, আর কী চমৎকার মানিয়েছে ওদের!
তারপর বহুকাল পরে পথের ধারে মুমূর্ষু অনুরাধার সঙ্গে রাজপুত্রের দেখা। সে বড় মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্য! অনুরাধার গানের করুণ সুরপুঞ্জে ঘরের বাতাস ভরে গেল। চারদিকে শুধু শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ, শান্তি তো ফুলে ফুলে কেঁদে সারা।
অভিনয় শেষ হলো, তখন রাত প্রায় এগারোটা। গ্রামের মেয়েরা কেউ বাড়ি চলে গেল না। তারা শ্রীপতির বৌকে ও রমাকে অভিনয়ের পর আবার দেখতে চায়। শ্রীপতির বৌ ও তার ভাইবোনদের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে চক্কত্তি-গিন্নি, শান্তির মা ও মন্টুর মা খেতে বসিয়ে দিলেন আর ওদের চারিধার দিয়ে পাড়ার যত মেয়ে।
ও পাড়ার রাম গাঙ্গুলীর বৌ বললেন, বৌমা যে আমাদের এমন তা তো জানিনে! ওমা এমন জীবন তো কখনো দেখিনি—
মন্টুর মা বললেন, আর ভাইবোনগুলোও কি সব হিরের টুকরো! যেমন সব চেহারা তেমনি গান—
শান্তি তো তার বৌদিদির পিছু পিছু ঘুরছে, তার চোখ থেকে অভিনয়ের ঘোর এখনো কাটেনি, সেই জুঁইফুলের মালাটি বৌদির গলা থেকে সে এখনো খুলতে দেয়নি। ওর দিক থেকে অন্যদিকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না যেন।
চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আর কী গলা আমাদের বৌমার আর রমার। পিন্টু অতটুকু ছেলে, কী চমৎকার করল।…
শান্তির মা বললেন, পিন্টু খাচ্ছে না, দেখ সেজ বৌ। আর একটু দুধ দি, কটা মেখে নাও বাবা, চেঁচিয়ে তো খিদে পেয়ে গিয়েছে।…কী চমৎকার মানিয়েছিল পিন্টুকে, না সেজ বৌ?
—একে ফুটফুটে সুন্দর ছেলে…
শ্রীপতির বৌ হাজার হোক ছেলেমানুষ, সকলের প্রশংসায় সে এমন খুশি হয়ে উঠল যে খাওয়াই হলো না তার। সলজ্জ হেসে বলল, জ্যাঠামশায় আমাদের বলেন কিন্নর দল—এখন ঐ নামে আমাদের—
রমা হেসে ঘাড় দুলিয়ে বলল, নিজে যে বললে দিদি, আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমায় তবে ধমক দিলে কেন তখন?
তারা বলল, নামটি বেশ, কিন্নর দল, না? আমাদের শ্যামবাজারের পাড়ায় কিন্নর দল বলতে সবাই চেনে—
রমা বলল, কৃত্রিম গর্বের সঙ্গে—প্রায় এক ডাকে চেনে—হুঁ হুঁ—
তারপর এই রূপবান বালক-বালিকার দল, সকলে একযোগে হঠাৎ খিলখিল করে মিষ্টি হাসি হেসে উঠল।
সতী হাসতে হাসতে বললে—বেশ নামটি, কিন্নর দল, না?
এমন একদল সুশ্রী চেহারার ছেলেমেয়ে, তার ওপর তাদের এমন অভিনয় করার ক্ষমতা, এমন গানের গলা, এমন হাসি-খুশি মিষ্টি স্বভাব, সকলেরই মন হরণ করবে তার আশ্চর্য কী?
মন্টুর মা ভাবলেন, কিন্নর দলই বটে।…
ওদের খেতে খেতে হাসি গল্প করতে মহাষ্টমীর নিশি ভোর হয়ে এলো!
শ্রীপতির বৌ বলল, আসুন, বাকি রাতটুকু আর সব বাড়ি যাবেন কেন? গল্প করে কাটানো যাক।
শ্রীপতি বাড়ি নেই, সে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির নিমন্ত্রণে গিয়েছে, আজ রাত্রের যাত্রা দেখে সকালে ফিরবে। সেই জন্যে সকলে বলল, তা ভালো, কিন্তু বৌমা তোমাকে গান গাইতে হবে!
শান্তি বলল, বৌদি, অনুরাধার সেই গানটা গেও আরেকবার, আহা, চোখে জল রাখা যায় না শুনলে।
শ্রীপতির বৌ গাইল, রমা এসরাজ বাজাল। তারপর রমা ও তারা একসঙ্গে গাইল। একটিমাত্র তেড়ো-পাখি বাঁশগাছের মগডালে কোথায় ডাক আরম্ভ করেছে। রাত ফরসা হলো।
সে মহাষ্টমীর রাত্রি থেকে গ্রামের সবাই জানল শ্রীপতির বৌ কী ধরনের মেয়ে।
কেবল তারা জানল না যে শ্রীপতির বৌ-প্রতিভাশালিনী গায়িকা, সত্যিকার আর্টিস্ট। সে ভালোবেসে শ্রীপতিকে বিয়ে করে এই পাড়াগাঁয়ের বনবাস মাথায় করে নিয়ে, নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেড়েছে, যশের আশা, অর্থের আশা, আর্টের চর্চা পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। তবু গানের ঝোঁক ওকে ছাড়ে না—ভূতে পাওয়ার মতো পেয়ে বসে—দিনরাত তাই ওর মুখে গান লেগেই আছে, তাই আজ মহাষ্টমীর দিন সেই নেশার টানেই এই অভিনয়ের আয়োজন করেছে।
শান্তি কিছুতেই ছাড়তে চায় না ওকে। বলে, তুমি কোথাও যেও না, বৌদিদি, আমি মরে যাব, এখানে তিষ্ঠুতে পারব না। শান্তি আজকাল শ্রীপতির বৌয়ের কাছে গান শেখে, গলা মন্দ নয় এবং এদিকে খানিকটা গুণ থাকায় সে এরই মধ্যে বেশ শিখে ফেলেছে। কিছু কিছু বাজাতেও শিখেছে। গান-বাজনায় আজকাল তার ভারি উৎসাহ। শ্রীপতির বৌ গান-বাজনা যদি পেয়েছে, আর বড় একটা কিছু চায় না, শান্তির সংগীত শিক্ষা নিয়েই সে সব সময় মহাব্যস্ত।
অগ্রহায়ণ মাসের দিকে বৌয়ের বাড়ি থেকে চিঠি এলো রমা কী অসুখ হয়ে হঠাৎ মারা গিয়েছে। শ্রীপতি কলকাতা থেকে সংবাদটা নিয়ে এলো। শ্রীপতির বৌ খুব কান্নাকাটি করল। পাড়াসুদ্ধ সবাই চোখের জল ফেলল ওকে সান্ত্বনা দিতে এসে।
শান্তি সব সময় বৌদির কাছে কাছে থাকে আজকাল। তাকে একদিন শ্রীপতির বৌ বলল, জানিস শান্তি, আমাদের কিন্নর দল ভাঙতে শুরু করেছে, রমাকে দিয়ে আরম্ভ হয়েছে, আমার মন যেন বলছে…
শান্তির বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ধমক দিয়ে বলল, থাক ওসব কী যে বলো বৌদি!
কিন্তু শ্রীপতির বৌয়ের কথাই খাটল।
সে ঠিকই বলেছিল, শান্তি ঠাকুরঝি, কিন্নর দলে ভাঙন ধরেছে।
রমার পরে ফাল্গুন মাসের দিকে গেল পিন্টু বসন্ত রোগে। তার আগেই শ্রীপতির বৌ মাঘ মাসে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, শ্রাবণ মাসের প্রথমে প্রসব করতে গিয়ে সেও গেল।
এ সংবাদ গ্রামে যখন এলো, শান্তি তখন সেখানে ছিল না, সেই বোশেখ মাসে তার বিবাহ হওয়াতে সে তখন ছিল মোটরি বাণপুরে, ওর শ্বশুরবাড়িতে। গ্রামের অন্য সবাই শুনল, অনাত্মীয়ের মৃত্যুতে খাঁটি অকৃত্রিম শোক এ রকম এর আগে কখনো এ গাঁয়ে করতে দেখা যায়নি। রায়-গিন্নি, চক্কতি-গিন্নি, শান্তির মা, মন্টুর মা কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন। ঐ মেয়েটি কোথা থেকে দুদিনের জন্যে এসে তার গানের সুরের প্রভাবে সকলের অকরুণ, কুটিলভাবে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, সে পরিবর্তন যে কতখানি, ওই সময়ে গাঁয়ের মেয়েদের দেখলে বোঝা যেত। ওদের চক্কত্তি-বাড়ির দুপুরবেলায় আড্ডায়, স্নানের ঘাটে শ্রীপতির বৌয়ের কথা ছাড়া অন্য কথা ছিল না।
চক্কত্তি-গিন্নি পেয়েছিলেন সকলের চেয়ে বেশি। শ্রীপতির বৌয়ের কথা উঠলেই তিনি চোখের জল সামলাতে পারতেন না। বলতেন, দুদিনের জন্যে এসে মা আমায় কী মায়াই দেখিয়ে গেল! আমার পেটের মেয়ে অমন কক্ষনো করেনি…আহা! আমার পোড়া কপাল, সে কখনো এ কপালে টেকে!
মন্টুর মামা বলতেন, সে কি আর মানুষ! দেবী অংশে ওসব মেয়ে জন্মায়। নিজের মুখেই বলত হেসে হেসে, ‘আমরা কিন্নর দল খুড়িমা’, শাপভ্রষ্ট কিন্নরীই তো ছিল।…যেমন রূপ, তেমনি স্বভাব, তেমনি গান…ও কি আর মানুষ, মা!
কথা বলতে বলতে মন্টুর মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ত।
এসবের মধ্যে কেবল কথা বলত না শান্তি। তার বিবাহিত জীবন খুব সুখের হয়নি, ভেবেছিল বাপের বাড়ি এসে বৌদিদির সঙ্গে অনেকখানি জ্বালা জুড়োবে। পূজার পরে কার্তিক মাসের প্রথমে বাপের বাড়ি এসে সব শুনেছিল। বৌদিদি যে তার জীবন থেকে কতখানি হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, তা এরা কেউ জানে না। মুখে সেসব পাঁচজনের সামনে ভ্যাজ ভ্যাজ করে বলে লাভ কী? কী বুঝবে লোকে?
বছর দুই পরে একদিনের কথা। গাঁয়ের মধ্যে শ্রীপতির বৌয়ের কথা অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে। শ্রীপতিও অনেকদিন পরে আবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা করছে শনিবারে কিংবা ছুটিছাঁটাতে।
শ্রীপতিদের বাড়ি থেকে শান্তিদের বাড়ি বেশি দূর নয়, দুখানা বাড়ির পরেই। শান্তি তখন এখানেই ছিল। অনেক রাত্রে সে শুনল শ্রীপতিদাদাদের বাড়িতে কে গান গাইছে। ঘুমের মধ্যে গানের সুর কানে যেতেই সে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল—
বিরহিণী মীরা জাগে তব অনুরাগে, গিরিধর নাগর—
এ কার গলা? ওর গা শিউরে উঠল। ঘুমের ঘোর এক মুহূর্তে ছুটে গেল। কখনো সে ভুলবে জীবনে এ গান, এ গলা? সেই প্রথম পরিচয়ের দিনে ওদের রোয়াকে জ্যোৎস্না রাত্রে বসে এই গানখানা বৌদি প্রথম গেয়েছিল! সেই অপূর্ব করুণ সুর, গানের প্রতি মোচড়ে যেন একটি আকাঙ্ক্ষার প্রাণঢালা আত্মনিবেদন! এ কি আর কারো গলার—ওর কুমারী জীবনের আনন্দভরা দিনগুলোর কত অবসর প্রহর যে এ কণ্ঠের সুরে মধুময়!
ও পাগলের মতো ছুটে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল।
রাত অনেক। কৃষ্ণাতৃতীয়ার চাঁদ মাথার ওপর পৌঁছেছে। ফুটফুটে শরতের জ্যোৎস্নায় বাঁশবনের তলা পর্যন্ত আলো হয়ে উঠেছে।
ঠিক যেন তিন বছর আগেকার সেই মহাষ্টমীর রাত্রির মতো।
শান্তির মা ইতিমধ্যে জেগে উঠে বললেন, ও কে গান করছে রে শান্তি? তারপর তিনিও তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন। শ্রীপতিদের বাড়ি তো কেউ থাকে না, গান গাইবে কে? ওদিকে মন্টুর মা, মণি, বাদল সবাই জেগেছে দেখা গেল।
প্রথমেই এরা সবাই ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পরে ব্যাপারটা বোঝা গেল। শ্রীপতি কখন রাতের ট্রেনে বাড়ি এসেছিল, কেউ লক্ষ করেনি। সে কলের গান বাজাচ্ছে। ওদের সাড়া পেয়ে সে বাইরে এসে বলল, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে আজ চেয়ে আনলুম ওর গানখানা। মরবার কমাস আগে রেকর্ডে গেয়েছিল।
সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শান্তি প্রথমে সে নীরবতা ভঙ্গ করে আস্তে আস্তে বলল, ছিরুদা, রেকর্ডখানা আর একবার দেবে?
পরক্ষণেই একটি অতি সুপরিচিত, পরম প্রিয়, সুললিত কণ্ঠের দরদ-ভরা সুরপুঞ্জে পাড়ার আকাশ-বাতাস, স্তব্ধ জ্যোৎস্না রাত্রিটা ছেয়ে গেল। মানুষের মনের কী ভুলই যে হয়! অল্পক্ষণের জন্যে শান্তির মনে হলো তার কুমারী জীবনের সুখের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে, যেন বৌদিদি মরেনি, কিন্নরের দল ভেঙে যায়নি, সব বজায় আছে। এই তো সামনে আসছে পূজা, আবার মহাষ্টমীতে তাদের থিয়েটার হবে, বৌদিদি গান গাইবে। গান থামিয়ে ওর দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে বলবে, কেমন শান্তি ঠাকুরঝি, কেমন লাগল!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×